বিদ্যুৎ খাতে মিটার বাণিজ্যে মূল হোতা ছিলেন নসরুল হামিদ চক্র

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১২ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:২৯ পিএম
বিদ্যুৎ খাতে সাড়ে চার কোটির বেশি গ্রাহককে প্রিপেইড মিটার দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছিল গত আওয়ামী লীগ সরকার। একে একে ছয়টি বিতরণ সংস্থা মিটার আমদানি করতে থাকে। এ নিয়ে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাণিজ্যের সুযোগ তৈরি হয়। আর এ বাণিজ্যের পুরোটার নিয়ন্ত্রণ নেয় সাবেক বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের ‘ভাই–বন্ধু’ চক্র। এমনই এক তথ্য উঠে এসেছে প্রথম আলোর অনুসন্ধানী রিপোর্টে।
প্রিপেইড মিটার স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হয় ২০১০ সালে। মিটার সরবরাহ বাড়তে থাকে ২০২০ সালের পর। চীনের তিনটি কোম্পানি সেনজেন স্টার, হেক্সিং ও ওয়াসিয়ন গ্রুপ একটি চক্রে যুক্ত হয়ে সব মিটার সরবরাহ করে। মিটার–বাণিজ্যের নামে টাকা পাচারেরও অভিযোগ আছে এ চক্রের বিরুদ্ধে। এসব সব কোম্পানিতেই প্রতিমন্ত্রী ও তার ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া গেছে।
আগের কোনো অভিজ্ঞতা ছাড়াই ২০১৯ সালে নেসকোতে মিটার সরবরাহের কাজ পায় ‘অকুলিন টেক’ নামের একটি কোম্পানি। চীনের সেনজেন স্টারের সঙ্গে যৌথভাবে ১০৭ কোটি টাকার এই কাজ পায় তারা। এরপর ২০২১ সালে তারা আবার নেসকোতে পায় প্রায় ৯২ কোটি টাকার কাজ। আর নেসকোতে কাজের অভিজ্ঞতা সনদ নিয়ে সবচেয়ে বড় বিতরণ সংস্থা পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডে মিটার সরবরাহের কাজ নেয় অকুলিন। আর এই কাজের জন্য তদবির করেন তৎকালীন বিদ্যুৎসচিব আহমদ কায়কাউস।
যৌথ মূলধন কোম্পানি ও ফার্মসমূহের নিবন্ধন পরিদপ্তরের তথ্য বলছে, অকুলিন টেকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন শাবাদ সাজিদ। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই কোম্পানির প্রধান কারিগরি কর্মকর্তা হিসেবে হংকং থেকে যোগ দেন কে রুম্মান আখতার। তাঁরা দুজন শেখ রেহানার ছেলে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিকের বন্ধু। এর মাধ্যমে তারা দরপত্র নিয়ন্ত্রণ করে। এর বাইরে কেউ অংশ নিতে চাইলেও তাকে ভয় দেখিয়ে আটকানোর কাজটি করতেন নসরুল হামিদ।
নেসকোর তথ্য বলছে, সাতটি দরপত্রের মাধ্যমে মিটার সরবরাহের কাজ দেয় নেসকো। এর মধ্যে কোনো দরপত্রে দুটির বেশি কোম্পানি অংশ নেয়নি। ৪টি দরপত্রে ৫৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে চীনের সেনজেন স্টার আর তিনটিতে ৪৫০ কোটি টাকার কাজ পেয়েছে ওয়াসিয়ন। সেনজেন স্টারের সঙ্গে দুটিতে অংশীদার ছিল অকুলিন আর দুটিতে ছিল মিটার ডি টেক। সেনজেন স্টারের বাংলাদেশের স্থানীয় প্রতিনিধি ছিলেন নসরুল হামিদের স্ত্রীর বড় ভাই প্রয়াত মোহাম্মদ সুজাত ইসলাম।
এছাড়াও, মিটার উৎপাদন করে দরপত্র ছাড়াই সরাসরি সরবরাহের জন্য দুটি নতুন সরকারি কোম্পানি তৈরি করা হয় নসরুল হামিদের নির্দেশে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড (বেসিকো)। বিতরণ খাতের ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ৫১ শতাংশ ও চীনের হেক্সিং ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে বেসিকোর নিবন্ধন নেয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে।
হেক্সিংয়ের স্থানীয় প্রতিনিধি হলেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের বন্ধু ও রিহ্যাবের সাবেক সভাপতি আলমগীর শামসুল আলামীন। দুজনই আবাসন খাতের পুরোনো ব্যবসায়ী। বাংলাদেশ পাওয়ার ইকুইপমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি লিমিটেড (বিপিইএমসি) নামে আরও একটি কোম্পানি তৈরি করা হয় স্মার্ট প্রিপেইড মিটার তৈরির জন্য। রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ৫১ শতাংশ শেয়ার ও চীনের সেনজেন স্টার ইনস্ট্রুমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড ৪৯ শতাংশ শেয়ার নিয়ে এটি নিবন্ধিত হয়। সেনজেন স্টারের স্থানীয় প্রতিনিধি নসরুল হামিদের আত্মীয় মাহবুব রহমান ওরফে তরুণ। এভাবেই নসরুল হামিদের ‘ভাই–বন্ধু’চক্র দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করা হতো বিদ্যুৎ খাত।