কেন অগ্নিকন্যা বলা হতো মতিয়া চৌধুরীকে

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৬ অক্টোবর ২০২৪, ০৯:৪৫ পিএম
বেগম মতিয়া চৌধুরী, বাংলাদেশের এক কিংবদন্তি রাজনীতিবিদ। ১৬ অক্টোবর বুধবার বার্ধক্যজনিত করণে জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার জীবন ছিল সংগ্রাম, সেবা এবং নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং দেশের সাবেক মন্ত্রী হিসেবে তিনি যেমন নেতৃত্ব দিয়েছেন, তেমনি গণমানুষের জন্য কাজ করে হয়েছেন দেশের প্রভাবশালী একজন রাজনীতিবিদ। আজ আমরা জানবো মতিয়া চৌধুরীর বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন এবং দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে তার অসামান্য অবদান সম্পর্কে।
মতিয়া চৌধুরীর জন্ম ১৯৪২ সালে পিরোজপুর জেলায়। তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্রী এবং শৈশব থেকেই নিজের অদম্য মানসিকতার জন্য বেশ পরিচিত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা শেষে তিনি ছাত্ররাজনীতিতে যুক্ত হন। ছাত্রাবস্থাতেই রাজনীতির প্রতি তার আগ্রহ তৈরি হয়। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে মতিয়া চৌধুরীর প্রবেশ ঘটে ষাটের দশকে, যখন দেশজুড়ে মুক্তিসংগ্রামের চেতনা প্রবল হয়ে উঠেছিল। ১৯৬৯ সালের গণ-আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়, তিনি আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ছিলেন এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শকে হৃদয়ে ধারণ করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে ভূমিকা রাখেন।
মতিয়া চৌধুরী ১৯৭৩ সালে প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তার জনপ্রিয়তা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা দ্রুতই তাকে জাতীয় পর্যায়ে পরিচিতি এনে দেয়। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের মন্ত্রিসভায় শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়ে তিনি দেশের শিক্ষাখাতে বড় পরিবর্তন আনার জন্য কাজ করেন। তার সময়েই জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়, যা বাংলাদেশের শিক্ষাক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত।
রাজনৈতিক জীবনে তিনি সবসময় সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষ করে কৃষকদের উন্নয়ন ও অধিকারের পক্ষে তিনি সোচ্চার ছিলেন। দেশের প্রান্তিক কৃষকদের জন্য তার ভূমিকা ছিল অগ্রণী। এই কারণে মতিয়া চৌধুরী ‘কৃষক নেত্রী’ নামেও পরিচিত ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, দেশের উন্নয়ন করতে হলে কৃষক ও গ্রামের উন্নয়ন অত্যাবশ্যক। তার এ বিশ্বাস থেকে তিনি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প ও কৃষি সংশ্লিষ্ট কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজ করেছেন।
মতিয়া চৌধুরীর জীবনের প্রতিটি অধ্যায়ই ছিল সংগ্রামের গল্পে ভরপুর। একাধিকবার তিনি রাজনৈতিক হামলার শিকার হন এবং কারাগারেও থাকতে হয়। তবে তার মনোবল কখনোই ভাঙেনি। বিরোধী দলে থেকেও তিনি সংসদে কৃষক ও মেহনতি মানুষের পক্ষে কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিলেন। আওয়ামী লীগের দুঃসময়ে তিনি দলের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন এবং দলের ভেতরে ও বাইরে তার নেতৃত্ব সবসময় সম্মানের সঙ্গে দেখা হয়েছে।
ব্যক্তিজীবনে অত্যন্ত সাদামাটা এবং নীতিবান মানুষ ছিলেন মতিয়া চৌধুরী। সর্বদা তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে কাজ করতে ভালোবাসতেন। সংসদ সদস্য হিসেবে নিজ নির্বাচনী এলাকার মানুষের সঙ্গেও তিনি নিবিড় সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। তার রাজনৈতিক জীবন ছিল দেশের জন্য উৎসর্গীকৃত, আর ব্যক্তিগত জীবন ছিল বিনয় এবং মানবিকতায় পূর্ণ।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে এই নেত্রী যে অসামান্য অবদান রেখে গেছেন, তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার কর্মময় জীবনের প্রতিটি অধ্যায় এক একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সাধারণ মানুষের পক্ষে, বিশেষ করে কৃষকদের জন্য অগ্রণী ভূমিকা তাকে দেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় করে রাখবে।