জন্মদিন
এক হƒদয়বান মানবিক স্বজন

শুচি সৈয়দ
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

হারিস ভাইকে নিয়ে লিখতে হবে- কবি রনজু রাইমের হঠাৎ জরুরি আমন্ত্রণ। বলার সঙ্গে সঙ্গেই রাজি, কারণ এটাই একটা- সুবর্ণ সুযোগ আমার জন্য, তাকে নিয়ে লেখার। হারিস ভাইকে নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার দীর্ঘ দিনের, তার প্রতি আমার নিখাঁদ অকৃত্রিম ভালোবাসার কথাটা তাকে জানানোর জন্যই এই লেখার ইচ্ছাটা। নিতান্তই আমার ব্যক্তি অভিজ্ঞতায় তাকে নিয়ে এ লেখার সঙ্গে ঢাকা শহর তো বটেই, একই সঙ্গে দেশের অনেক মানুষেরই অভিজ্ঞতা মিশে যাবে বলে অনেকটা নিঃসংশয়ে, নিঃসংকোচে আমি কলম তুলে নিয়েছি। আমার ধারণা এটি শুধু ‘আমার’ লেখা নয় ‘আমাদের’ লেখা হয়ে দাঁড়াবে।
ডা. হারিসুল হক, অধ্যাপক, দেশের অন্যতম হার্ট স্পেশালিস্টই শুধু নন অসাধারণ হƒদয়বান একজন মানুষ। আমি এই হƒদয়বান মানুষটির প্রতি আমার ভালোবাসা তাকে জানাবার জন্যই লেখাটি লিখছি- তার কবিতা এবং কাজের মূল্যায়ন অন্যরা করুন।
দেশের অন্যতম প্রধান দুই কবি শামসুর রাহমান এবং আল মাহমুদ। দুজনই মানুষ হিসেবে ছিলেন সাংঘাতিক সজ্জন। তাদের সঙ্গে পরিচয় হওয়ার আগে দূর থেকে দুই মেরুর মানুষ বলে মনে হতো তাদের পরস্পরকে। কিন্তু খুব অল্প ঘনিষ্ঠতাতেই আমি এ সত্য জেনেছি তারা প্রায় একই মায়ের পেটের সহোদর- সে মা হচ্ছেন কাব্যল²ী। মোটেই তারা দুই মেরুর মানুষ নন, তারা কবি- বাংলাদেশের অপুষ্ট, অসুস্থ রাজনীতি তাদেরকে দুই মেরুতে নিয়ে গিয়ে কাকতাড়–য়া বানিয়েছে মাত্র। অর্থাৎ স্বার্থান্বেষী রাজনীতি, যে রাজনীতি গণবিরোধী সেই রাজনীতি তাদের দুজনকে অনিচ্ছুক শিকারে পরিণত করেছে মাত্র। আমি এই দুই কবিকে কবি হিসেবে তো বটেই মানুষ হিসেবেও অনেক মহত্তম হিসেবে পেয়েছি আমার অভিজ্ঞতায়।
বাংলা ভাষার মহত্তম কবি শামসুর রাহমান ডা. হারিসুল হককে আপন সহোদরের মতো ভালোবাসতেন। হারিস ভাইয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় রাহমান ভাইয়ের বাড়িতে, যতদূর মনে পড়ে, হারিস ভাইয়ের বাহনে আমি অত্যন্ত স্বচ্ছন্দে একদিন লিফট নিয়েছিলাম। রাহমান ভাইয়ের বাসা হয়ে আমার পরবর্তী গন্তব্য ছিল সেদিন শাহবাগ- রাহমান ভাই সেটা জানতে পেরে বললেন, ‘তুমি হারিসের সঙ্গে যাও, ওর গাড়িতে।’ আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করি এমন পরিস্থিতিতে- অকস্মাৎ কারো কাঁধে চেপে বসে পথ পার হওয়া, তাকে বিব্রত করা, তার নিজস্ব সময়কে নিজস্বতাহারা করা এটা আমার একেবারেই মনোপুত নয়, মনে হয় সেটা একটা অনুচিত কর্ম- অপরাধ। আমি নিজেও বিব্রত হতে চাই না অন্যকে অস্বস্তিতে ফেলে। কিন্তু সেদিন যা ঘটল তা হলো- আমি স্বচ্ছন্দে হারিস ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে চলে এলাম শাহবাগে। আমার মনে হলো না আমি অন্য কোনো লোকের বাহনে শ্যামলী থেকে শাহবাগ এলাম। হারিস ভাই এমনই অনায়াসলব্ধ সহোদর হয় গেছেন সেদিন আমার কাছে। আমার মনে হয় এই হƒদয়বান মানুষটির সঙ্গে হার্দ্যকি সম্পর্ক আমার সেদিনই সম্পন্ন হয়ে গেছে এক সহোদর রূপে।
শুধু আমি নই, তাকে যারা চেনেন তারা সবাই এক বাক্যে এ সাক্ষ্য দেবেন। পরবর্তীতে আমি অবাক হয়ে এটা আবিষ্কার করেছি- আমার প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গেও তার অনায়াস সম্পর্ক; এটি আরো একটি বড় পাওনা।
দুই.
সেই ছোট বেলায় আব্বা আবৃত্তি করে মুখস্থ করাতেন বাল্যশিক্ষার কবিতা- ‘আপনারে বড় বলে বড় সেই নয়/ লোকে যারে বড় বলে বড় সেই হয়।’ আমি আমার অভিজ্ঞতায় হারিস ভাইকে বড় বলছি সেটা হতেই পারে। এবার আমার ঘরের মানুষের অভিজ্ঞতার কথা বলি। আমার স্ত্রী একবার অসুস্থ হলো, একটানা জ¦র যখন সাত দিন পরও অব্যাহত তখন তাকে হাসপাতালে নিতে রাজি করাতে পারলাম। হাসপাতালে ভর্তি হয়েও জ¦র নামছে না, ওষুধ চলছে, আমি প্রায় সপ্তাহ ধরে রাতে জাগছি, নার্সরা রাত ২টায় রুটিন মেনে ওষুধ দিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা শহরে আমার যারা স্বজন, বন্ধু আছেন তারা তাকে হাসপাতালে এসে দেখে যাচ্ছে, আমার কাজিন জলি আপা এলেন তাকে দেখতে। এসেই আমাকে সেই বকাবকি- ‘এখানে কোনো ভালো ডাক্তার নেই, প্রফেসর নেই তাকে পিজিতে ভর্তি করতে হবে, সেই ব্যবস্থা কর!’ আমার বাসা থেকে পিজির দূরত্ব বেশ খানিকটা। বাসায় দুটি পিচ্চি ছেলে-মেয়ে, অফিস করে, হাসপাতালে থেকে আমার তখন এক নাজুক অবস্থা। এমন জ¦র না ছাড়া রোগীকে স্পেশালিস্ট ডাক্তারের কাছে নেয়া কিংবা পিজিতে নেয়ার কথা তখন আমার মাথায়ও আসেনি। জলি আপার বকা এবং প্রচণ্ড প্রেশার আমাকে ভাবতে বাধ্য করল পিজিতে ভর্তি বা প্রফেসরকে দেখাতে হবে। আমার তখন মনে হলো হারিস ভাইয়ের কথা। আমি নির্দ্বিধায় ফোন করলাম হারিস ভাইকে- বললাম জরুরি বোধ করছি। পিজিতে ভর্তি করার জন্য। হারিস ভাই রোগীর বর্ণনা শুনে বললেন, ‘দাঁড়াও আমি ব্যবস্থা করার চেষ্টা করছি- তুমি কাল সকালে ফোন দিও।’ তার কথায় খুবই আশ্বস্ত হলাম। আমার বোনও শান্ত হলো। সেদিনও আমি রাতে হাসপাতালে। রাত সাড়ে ১১টায় ফোন, স্ক্রিনে হারিস ভাইয়ের নাম। রিসিভ করতেই অন্য প্রান্তের প্রশ্ন- ‘শুচি, তুমি কোথায়?’
বললাম, ‘হাসপাতালে রোগীর কাছে।’
‘কত তলায়?’
বললাম, ‘দোতলায় কেবিনে’
অপর প্রান্ত থেকে হারিস ভাই বললেন, ‘আমি তোমার হাসাপাতালের গেটে।’
রাত সাড়ে ১১টায় তার মতো একজন ব্যস্ত ডাক্তার চলে এসেছেন রোগীকে দেখতে। আমি সেদিন তার এই অভাবনীয় উপস্থিতিতে হতবিহ্বল হয়ে পড়েছিলাম। আমি শুধু তাকে বললাম, ‘আপনি ওখানেই দাঁড়ান আমি আসছি।’ দ্রুত দোতলা থেকে সিঁড়ি বেয়ে নামতেই দেখি হাসিমুখে দুহাত প্রসারিত করে সাদা পোশাকে দাঁড়িয়ে আছেন হারিস ভাই। দোতলায় এলে হারিস ভাই আমার স্ত্রীকে দেখে অভয় দিলেন, ‘ঠিক হয়ে যাবে।’ রোগীর কী ওষুধ চলছে। প্রেসক্রিপশন ফাইল আনতে বললেন, নার্স প্রেসক্রিপশন ফাইল নিয়ে এলেন। তার সঙ্গে সঙ্গে একটা ভিড় জমে গেল। তাদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, ফিসফাস, পিজি হাসপাতালের প্রফেসরকে ‘কল দিয়েছেন’ কে? যেন কিছুটা ভীতি বিহ্বলও তারা। যদিও তারা আমার স্ত্রীর চিকিৎসায় তাদের সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে চলেছেন। তারপরও হঠাৎ কেন যেন তাদেরকে অপ্রস্তুত বলে মনে হলো। সে যাই হোক, হারিস ভাই প্রেসক্রিপশন দেখে বললেন, ‘ঠিকই আছে, আমি জাস্ট একটা ওষুধ বদলে দিচ্ছি, এটা খাওয়াও, আর আগামীকাল বউমাকে বাসায় নিয়ে যাও। আশা করি জ¦র সেরে যাবে।’ হারিস ভাই সঙ্গে একটা ব্লাড টেস্ট দিলেন ‘আইসিডিডিআরবি’তে করাবার জন্য। বললেন, জানি রিপোর্ট কী হবে। তবুও করানো থাক।
পরদিন আমার স্ত্রীর ব্লাড স্যাম্পল দিয়ে রিপোর্ট এলে দেখা গেল তার ধারণাই ঠিক- কোনো সমস্যা নেই। রোগীকে বাসায় নিয়ে এলাম এবং সে সেরে উঠল সেদিন থেকেই!
সেদিন সন্ত্রস্ত প্রায় মধ্য রাতে পিজি হাসপাতালের প্রফেসরকে ‘কল’ দিয়েছেন কোন কেউকেটা, তা নিয়ে হাসপাতালের নার্সসহ কর্মীদের জিজ্ঞাসাবাদ জেরার ঠেলায় আমি বুঝে গেলাম আমার কাজিন জলি আপার সেইরকম বকাঝকার মাহাত্ম্য। স্টাফদের আশ্বস্ত করলাম ভয় পাবার কিছু নেই উনি ঊর্ধ্বতন কারো ‘কলে’ আসেননি। এসেছেন হƒদয়ের ‘কলে’, অনুজের প্রতি ভালোবাসার টানে। সেদিন সেই টিপটিপ বৃষ্টি হওয়া মৃদু শৈত্যপ্রবাহের রাতে আমার মতো এক অনুজের পাশে এভাবে অভয় রূপে অগ্রজরূপে তাকে পেয়েছি।
হারিস ভাই একজন বড় মানুষ পেশার ক্ষেত্রে যেমন, মানবতার ক্ষেত্রেও। আমি জানি না, আমার অভিজ্ঞতার টুকরো কথা লিখে তাকে অন্যদিকে ছোট করে ফেলছি কি-না। শুধু অনুভব করি এর চেয়েও তিনি অনেক অনেক গভীরভাবে মানবিক।
তিন.
আরেকটি অভিজ্ঞতার কথা বলি- বাংলা একাডেমির বার্ষিক সভায় আমি সাধারণত যাই কিছু প্রিয় মানুষের সঙ্গে দেখা হয় জন্য। তাদের অন্যতম কবি মাকিদ হায়দার, কবি মাহবুব হাসান, কবি হারিসুল হক, কথাশিল্পী আনিস রহমান, কবি আসাদ মান্নান, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কথাশিল্পী ফিরোজ সারওয়ার, প্রাবন্ধিক স্বপন দাস, কবি সাবেদ আল সা’দ প্রমুখ। এদের সঙ্গে অনায়াসে আড্ডায় মাততে পারি বলে।
সেবার হঠাৎ হারিস ভাই আমাকে বললেন, ‘তোমার ৪০ পেরিয়েছে?’ বললাম, হ্যাঁ, নিজে থেকেই বললেন, ‘তাহলে লিপিড প্রোফাইল করে ফেলো’- কবি ডা. হারিসুল হক এবং গল্পকার ডা. মামুন হুসাইন- এই দুই অগ্রজের কোনো কথা আমার কাছে বেদবাক্য- চিকিৎসা বিষয়ে। হারিস ভাইকে বললাম, ‘পরীক্ষাগুলো কী কী মনে থাকবে না, আপনি লিখে দেন।’ হারিস ভাই একটা কাগজে লিখে দিলেন। আমি সেই কাগজ পকেটে নিয়ে ঘুরি, কিন্তু পরীক্ষাগুলো আর করাতে যেতে পারি না। এর মধ্যে আমার হরফুন মওলা দোস্ত এস এম গোর্কিকে কাগজটা দেখিয়ে বলি, ‘কত টাকা লাগবে রে? এ টেস্টগুলো করাতে?’ ও হিসাব করে বলে, ‘৫-৬ হাজার টাকা।’ গোর্কি চিকিৎসা এবং চিকিৎসক বিষয়ে অভিধান স্বরূপ। খালাম্মাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে যেতে আসতে এবং কিছু ডাক্তার বন্ধুর সান্নিধ্যে ও এ বিষয়ে অনেক বেশি ওয়াকিবহাল। আমি পরীক্ষাগুলো করাতে যাই-যাচ্ছি করতে করতে প্রায় বছর পেরিয়ে ফেললাম। এর মধ্যে একদিন হঠাৎ কোনো কারণে হারিস ভাইয়ের সঙ্গে দেখা। জিজ্ঞেস করলেন, পরীক্ষাগুলো করিয়েছি কি-না! বললাম, ‘না করাইনি তবে অবশ্যই করাব।’ জানি না তিনি কী বুঝলেন। বললেন, ‘ভাইয়া তুমি শোনো, যে কোনো দিন পিজিতে চলে এসো, আমাদের এখানে টেস্টগুলো করাতে খরচও কম এবং নির্ভরযোগ্য।’ আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, তাই ভালো।’ আমি যেন একটা পথ পেলাম। তারও কয়েক মাস পর একদিন তার সঙ্গে কথা না বলেই পিজিতে গেলাম, তার রুম বন্ধ। পিয়নটিও নেই। পাশের রুমের পিয়ন কিছু বলতে পারল না। আমি রুমের সামনে দাঁড়িয়ে ফোন করলাম হারিস ভাইকে। হারিস ভাই বললেন, তিনি চিটাগাংয়ে বিয়ের দাওয়াতে গিয়েছেন। আমি বললাম, ‘ঠিক আছে, আপনি ঢাকা আসেন, এরপর ফোন করে আসব।’ তিনি বললেন, ‘না, তুমি আমার রুমের সামনেই দাঁড়াও, দেখ আমার পিয়নটাকে পাও কি-না।’ আমি পিয়নকে পেলাম না। হারিস ভাই শুধু বললেন, ‘তুমি যাবে না, একটু ধৈর্য ধরে দাঁড়াও।’ কিছুক্ষণ পর দেখলাম সামনের ডাক্তারের অ্যাটেনডেন্ট এসে আমাকে খুঁজে নিলেন। বললেন, ‘স্যার এখানে দাঁড়ান, আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি।’ তিনি দ্রুতই তার কাজ গুছিয়ে এসে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে গিয়ে তার প্যাডে টেস্টগুলোর নাম লিখিয়ে আমাকে নিয়ে পিজির ল্যাবে হাজির হলেন। সেখানে ভিড় দেখে যে কোনো মানুষই ভড়কে যায়। আমিও গেলাম, কিন্তু আমাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে দিলীপ দাদা সব টাকা জমার সিøপ নিয়ে এসে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। এখন আমার কাজ ব্লাড দেয়া, ইউরিন দেয়া ইত্যাদি। সেসব সম্পন্ন হলে আমি আবার হারিস ভাইকে ফোন দিলাম। বললেন, রিপোর্টগুলো নিয়ে দেখা করো। টেস্টগুলো করাতে অর্ধেকেরও কম টাকা লাগল।
এ রকম অভিভূত ঘোর খুব কমই ঘটে জীবনে। আমি জীবনের প্রতি অগাধ আস্থা নিয়ে বাসায় ফেরার পথে রমনা পার্কের গাছগুলোর পাতাঝরা দেখতে দেখতে জীবনের মাধুর্যকে উপলব্ধি করলাম। অনুজদের প্রতি অগ্রজের এমন ভালোবাসা জীবনকে অর্থবহ করে তোলে।
এ তো গেল এক পর্ব- টেস্টগুলো নিয়ে তাকে দেখাতে গেছি। হঠাৎ তার কাছে ফোন এলো কবি আলফ্রেড খোকনের। অনুজপ্রতিম খোকন নাকি হƒদরোগে আক্রান্ত, অনেক দিন দেখা হয় না- ওর সুন্দর নিটোল মুখটা দেখার জন্য আমি বসে রইলাম। ফোনে হারিস ভাই কথা বলছেন, আর আমি তাকে বলছি- ‘ওকে লিফটে আসতে বলেন, লিফটের ৪।’ উনি সে কথা শুনলেই না। প্রায় আধা ঘণ্টা পর খোকন এলো। বেশ ক্লান্ত ভাব, মানে বেচারা সিঁড়ি ভেঙে উঠেছে। অন্যান্য কাজ শেষ করে হারিস ভাই খোকনের দিকে মনোযোগ দিলেন। ওর ফাইল নিয়ে দেখলেন, কথা শুনলেন। খোকনের হার্ট-ব্লক ধরা পড়েছে, চারটা ওষুধ খাচ্ছে, অসুবিধে ফিল করছে, ওর ইচ্ছা ভারতে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবে। ওকে কবি মজিদ মাহমুদ বলেছেন, ‘ভারতের যাবার আগে একটু হারিস ভাইকে দেখিয়ে যাও।’ হারিস ভাই ওর ওষুধগুলো দেখে বললেন, ‘তোমার ওষুধ দুটি কমিয়ে দেই, দেখ ভালো বোধ কর কিনা।’ শুনে খোকন বলল, ও শুনেছে হারিস ভাই কম ওষুধ দেন- সেটা তো আরো ভালো। হারিস ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে একটা অভয় নিয়ে আমি আর আলফ্রেড খোকন নিচে নামলাম। খোকন আমার রিপোর্টগুলো নিয়ে দেখে বলল আপনি অনেক ভালো আছেন। অসুখ-বিসুখ বিষয়ে আমি বেশ অজ্ঞই, কিন্তু খোকন অনেক সচেতন।
চার.
আরো একটা ঘটনা বলি। আমাদের অনেকেই প্রিয় বোন জামিল আকতার বীনু। বীনু আপার একবার হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভূত হলো। কবি মালা মাহবুব, আনিস ভাই, মাহবুব রেজা সবাই আমরা উদ্বিগ্ন। তাকে ডাক্তার দেখানো দরকার, কিন্তু তিনি আমলে নিচ্ছেন না। তিনি নিজেও ডাক্তার এবং হাসপাতাল বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ- আমাদের চেয়ে তো বটেই। কী করা? কীভাবে তাকে ডাক্তারের মুখোমুখি করা যায়! আমি দুর্বিনীতভাবে দায়িত্ব নিলাম- হারিস ভাইকে দিয়ে দেখাই। হারিস ভাইকে বললাম, বীনু আপাকে দেখতে যেতে হবে। হারিস বললেন, ওনার ঘরেই তো ডাক্তার আছে। বললেন, বীনু আপার ভাস্তির নাম। আমি তাকে চিনি না। বললাম, ‘থাকুক আপনাকে যেতে হবে। আমাদের জন্য।’ একটু ভেবে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি কাল সকালে পিজিতে আসো, আমরা একসঙ্গে চলে যাব।’ পরদিন গেলাম পিজিতে, পিজির নতুন ভবনে তাকে দেখতে গেলাম। তাকে ঘিরে অর্ধবৃত্ত রচনা করে দাঁড়িয়ে আছে একদল নবীন চিকিৎসক। তাদের সবার হাতে রোগীর প্রেসক্রিপশন। তিনি একজনেরটা নিচ্ছেন দেখছেন, রোগী সম্পর্কে কথা বলছেন এবং পরামর্শ থাকলে দিচ্ছেন।
আমি ঠিক তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছি এক অপার মুগ্ধতা নিয়ে। কারোরই কোনোদিকে মনোযোগ নেই- ইন্টার্নদের সমস্ত মনোযোগ হারিস ভাইয়ের দিকে এবং হারিস ভাইয়ের পরিপূর্ণ মনোযোগ নবীন শিক্ষার্থীদের দিকে, সেখানে আমি এক অস্তিত্বহীন উপস্থিতি যেন। বাম থেকে ডানে সমবেত ইন্টার্নের প্রেসক্রিপশন, রোগীর তত্ত্ব-তালাশ শেষে তিনি যখন পেছনে ঘুরলেন তখন তার সাদা অ্যাপ্রোন যেন সুফিদের আল্লাখাল্লার খদ্দরের পোশাকের নৃত্যের মতো ডানা ছড়িয়ে দিল। তিনি আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মুহূর্তে হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে বললেন, ‘তুমি এসেছ, চলো আমরা যাই।’ বলে আমার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে তার গাড়িতে উঠলেন। সাদা অ্যাপ্রোনটা খুলে বললেন, ‘চলো আগে শাহবাগে গিয়ে চা খাই।’ আমরা শাহবাগে গিয়ে চা-নাশতা খেয়ে বীনু আপনার ইস্কাটনের বাসায় গেলাম। বীনু আপার সঙ্গে কথা-বার্তা বলে, গল্প করে তারপর চলে এলাম। সে দফা বীনু আপাকে আর হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়নি। আমার ধারণা হারিস ভাইয়ের সঙ্গে মিনিটের কথাবার্তায়ই তিনি অনেক সুস্থতা বোধ করেছিলেন।
আমি জানি, দৃঢ়ভাবেই জানি আমার চেয়েও অনেক হƒদয়স্পর্শী ঘটনা আছে হারিস ভাইকে নিয়ে অন্যদের স্মৃতিতে। কেননা তিনি এক মহৎ হƒদয়বান মানুষ, যথার্থ মানুষ।