হারিসুল হকের কবিতায় জীবন অন্বেষা

সাইফুজ্জামান
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
মেঘনা বহমান। নদীর ভাঙা-গড়া, ঢেউ আর চরাচরের মানুষের জীবন কত যে আনন্দের, বেদনার তার কথা কেউ জানতে পেরেছে কখনো? অনেকে না জানলেও হারিসুল হক জানেন পিতৃস্নেহে অন্ধ তিনি মাঠমগ্ন থাকতে পারেননি। ছোট বেলা থেকেই। লাইব্রেরি ছিল তার আশ্রয়স্থল। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাথী ছিল পড়ার বই। লেখার তৃষ্ণায় আচ্ছন্ন তিনি লিখতেন, পড়তেন। তারপর শুধু লেখালেখি সঙ্গী করে জীবনের অনেকখানি পথ পাড়ি দিয়েছেন। অনেকটা গত্যন্তর না থাকা ও অভ্যস্ততা জীবনের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ, হৃদয়বৃত্তির তোলপাড়ে ছিন্নভিন্ন হারিসুল কবিতার জীবন, জীবনের কবিতা অন্বেষা করেছেন। বের হতে পারেননি কাব্য বলয় থেকে। শুধু তার ভালোবাসা অজেয় কবিতা। সাহিত্য ভালোবাসার কারণে ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজির পরিবর্তে নন ইন্টারভেনশনাল কার্ডিওলজিকে ধারণ করে অধ্যাপক হারিসুল একজন বিশিষ্ট কার্ডিওলজিস্ট। ভীষণ ব্যস্ততার মধ্যে তার দিন রাত্রি কাটে। তবু ভালোবাসা, হৃদয়বৃত্তি থেকে তিনি দূরে থাকতে পারেননি। ২৮টি কাব্যগ্রন্থে ভিন্ন ব্যঞ্জনা, অন্যস্বর, তীব্র তোলপাড় তার ভেতর মেঘনার মতো স্রোতস্বিনী ও প্লাবিত। তিনি ‘সময়ের বিশিষ্ট পেরেক’ দিয়ে আটকে দেন নিজের ভেতর-বাহির ও অন্যের মনোজগতের দশদিক।
২৪টি কাব্যগ্রন্থ, একটি গদ্যগ্রন্থ ও চিকিৎসা শাস্ত্রের পাঠ্যবই, যা জার্মান থেকে প্রকাশিত তাকে মহিমান্বিত করেছে। তাকে বলতে হয় ‘তিরোহিত স্বপ্নের চাদর ও আরাধ্য কষ্টের মহিমা।’ হৃদয় সংক্রান্ত বিদ্যায় তাকে ব্যস্ত থাকতে হয়। তবু এর মধ্যে কাব্য প্রতিমার কাছে সমর্পিত হয়ে নিজেকে রাঙিয়ে দেন। অন্যের মনের অন্ধকারে টর্চের আলো ফেলে জীবনের আনন্দকে মহুমাত্রিক ব্যঞ্জনাময় করে তুলতে দক্ষ। ‘ব্যর্থতা’ শব্দ তার অভিধান থেকে তিরোহিত। আনন্দ-বেদনা দুই সহচর মানুষের নিত্যসঙ্গী। বেদনাকে আনন্দ মন্থন করে তোলার ক্ষমতা রাখে তারচেয়ে সুখী কে থাকতে পারে? একজন কবি ছাড়া কেউ কি আছেন বেদনার প্রতিদ্ব›দ্বী, আনন্দের সহোদর। হারিসুল হক নিশ্চয় উপলব্ধি করেন এই নশ্বর পৃথিবীতে অন্ধকার পলকমাত্র উপস্থিতি জানান দেয়। আনন্দ সব থেকে উজ্জীবিত করে। সত্যও সুন্দরের কাছে তার বারবার প্রত্যাবর্তন এক স্বাভাবিক মনোভঙ্গির গতি। মানুষ ছাড়া কে বলে জীবনের কথা? প্রেম, দ্রোহ, বিরহ বেঁচে থাকার লড়াই, সামাজিক অবস্থা, যৌনতা, বঞ্চনা পরকীয়া, প্রতারণা, বেশ্যাবৃত্তি (পুরুষ ও নারীর), বিকৃতি, আত্মীপীড়ন, একবুক হাহাকার নিয়ে যারা গ্রাম-নগর, আশ্রয়স্থলে এক ধরনের বেসামাল অবস্থায় বসবাস করে। তাদের কথা কে শোনে? কবি তাকে চিকিৎসক বোঝে। ওষুধ থেকেও দামি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা। তার কাছে যাই আমার পাশে আছে কবি- হৃদয় বিশেষজ্ঞ। মানুষের গল্প বিধৃত করা দুঃসাধ্য। একজন সাহিত্যিক জীবন খুঁড়ে তুলে আনেন রতœ-ভাণ্ডার অভিজ্ঞতা, বীক্ষণ সৃষ্টি করে এক অন্য অধ্যায়, হারিসুল কী অবলীলায় উচ্চারণ করেন-
‘এরকম যে ঘটতে পারে আমি জানতাম
আমি জানতাম এরকম না ঘটে পারে না
আমি তো পুরুত নই যে মন্ত্রপাঠে গনেশ
পাল্টে দেবো কিংবা চরণামৃত বিতরণ করে
মনস্তাপের পরিসমাপ্তি ঘটাব
এরকমটা যে ঘটতে যাচ্ছে আমি কেন আগে
থেকেই করতে পারছিলাম
আমি জানি হ্রদের ভেতর জল এবং জলের
ভেতর প্রাণ ধারণের মতো ন্যূনতম রসায়ন থাকে
প্রবাল আর ছত্রাকের কানামাছি খেলবার মতো
যথেষ্ট সংস্থান থাকে আশপাশে
যেমন জলপাই গাছে থাকে বিলোপাসৃত বর্ণ, স্বাদ
জলের অতল অথই যে থাকে সাপেদের
অধোপহাস অন্যরকম
আমি পাহাড়ের কথা বলছি না
বলছি জল আর জলপাইয়ের কথা
..........................................
আমি জানতাম এভাবেই ঘটতে থাকে
এভাবেই ঘটে যায় অদলবদল
এবং এভাবেই ঘটে গেছে নদীর ঘটনা
কে না জানে ঘটনা তা
ঘটে যায় যে সব ঘটন অঘটন
নিবিড় নিমন্ত্রণ
আজকে না হয় রাখলে তুমি আমার আমন্ত্রণ
শিশিরভেজা রাতে না হয় হবে আয়োজন
তোমার সঙ্গে দেখা হবার ভীষণ প্রয়োজন
ভুল করে না রাখো এবার শেষের নিমন্ত্রণ
তোমার সঙ্গে ছিল যত হিসেব নিকেশ পাকা
শুধবো এবার সুদেমূলে স্বপ্ন আছে আঁকা
.........................................
এবার যেন ভুল না হয় নমোবনমালী
আমন্ত্রণের রাতে দুজন শুনব সাওতালী
দুইয়ে দুইয়ে এক হয়ে ফের হারাবো নির্জন
ভাবে সবাই গেছে ওরা নিবিড় নিমন্ত্রণে
(নদীর ঘটনা)
কবিতার বিষয় উপমা চিত্রকল্প ও বর্ণনার মিথস্ক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। হারিসুল হক রোমান্টিক কবি। মানসপ্রবণতার অসাধারণ বাঁকবদল তার কবিতাকে সৌন্দর্যময় করে। তার কবিতার বর্ণনাভঙ্গি, শব্দ যোজনা ও উপমা প্রযুক্তিতে রয়েছে অভিনবত্ব। জীবনের বহুমাত্রিক টানাপড়েন তার কবিতার ভিত্তি ভূমিকে শক্তিময় করে। আশালতা কবিতায় প্রসারিত। ব্যতিক্রমী কবিতা জীবনের উদ্দামতা, ক্লেদ ও যাপিতজীবনকে ধারণ করে। লোকজ জীবন হারিসুল হকের কবিতায় লীন হয়েছে। শব্দের সঙ্গে শব্দের যোজনা স্থাপন করে তার কবিতায় জীবনের অর্থময়তা প্রকট। ধারণা করা অসঙ্গত হবে না নগর জীবনের রুঢ়তা তার কবিতায় একেবারে আসেনি এমন নয়। নাগরিক কবির যাপিত জীবনে খরতাপ ও শুষ্কতা অতিক্রমণের সাধ্য কবির নেই। দৈনন্দিন যা কিছু কবি প্রত্যক্ষ করেছেন তা নিংড়ে কবিতার শরীরের অদলবদল দিয়েছেন হারিসুল। তাইতো তাকে বদল শুনি : জায়গা বদলালেই কি মানুষ বদলে যায়/ অনেকটা রাতের মতো/ দিনের পোশাক পাল্টানোর পর থেকেই হয়ে ওঠে কুণ্ঠাপ্রবণ/ জায়গা বদলালেই কি মানুষ হয়ে যায় ঘুড়ি। আধুনিক মানুষের সাথী নিঃসঙ্গতা, প্রেমকাতরতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতির আলোড়ন। আত্মমুগ্ধতা, বেদনাবোধ কবিকে প্রতিনিয়ত রক্তাক্ত করে। আত্ম জৈবনিক রচনায় কবি স্বপ্ন তাড়িত সংবেদনশীল সত্তার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে থাকেন। মাড়ি মড়ক খরতাপে ভেঙে যায় চারদিক। সহায় সম্বলহীন মানুষ বাঁচে এক তৃষ্ণায়। একাকী হারিসুল হক পরিভ্রমণ এক অমসৃণ ভূমণ্ডল। আত্মমগ্নতা থেকে বেরিয়ে এসে দূর এক প্রান্তরে তিনি নোঙর বাঁধেন।
ফিরে যাওয়া আর ফিরে দেখার মধ্যে হারিসুল হক এক টুকরো পৃথিবীতে দীপ্ত পদক্ষেপে যাত্রা করেন। নির্বাচিত কবিতায় সমকাল উদ্ভাসিত ভবিষ্যৎ একজন স্বপ্নদ্রষ্টা সময়ের কাছে যেভাবে সমর্পিত তার স্বয়ংক্রিয় প্রকাশ, বোধ ও বোধের অন্তরাল সম্মিলন কবিতার গভীর অরণ্যে একজন কবিকে পরিভ্রমণ করতে হয়। গ্রাম-নগর, সাধু-চলিতে ফারাক স্পষ্ট হয়ে প্রেম-বিরহকে বহু রঙ্গে বর্ণিল করে তা হারিসুল হক অনায়াসে শনাক্ত করেন দক্ষতায়, সৃজনে। প্রেম, বিরহ, সমাজ, সমাজের মানুষের অনুভব তার কাছে ইঙ্গিতময়। হারিসুল মৃত রাত্রির কাছে মগ্ন প্রত্যাশায় তাড়িতঃ
একটি মৃত রাত্রির কাছে থাকে না প্রত্যাশা
হারিয়ে যাবার নীড়ে ফিরবার তবু অরণ্য যায়
খোঁজে রাত্রির সম্ভাষণ
পাতারা কাঁপে
নড়ে
ঝড়ে
বন্ধ জানালায়
একটি মৃত রাত্রির কাছে কিছুই থাকে না শুধু
বিশেষ এক ধরনের ভিসা ছাড়া যেমন
কাঠবিড়ালির যাকে হঠাৎ হারাবার
...........................
শুধু একগাদা কষ্ট ছাড়া
কণ্ঠরোধ করা উৎকণ্ঠা ছাড়া
উৎকট গন্ধময় বিচ্ছিরি কফ ছাড়া
তিমির পিঠের মতো স্তব্ধ আকাশ ছাড়া
একটি মৃত রাত্রি আর কিছু প্রসব করে না।
................................
সব ট্রেন থেমে থাকে
শুরুর স্টেশনে
(মৃতরাত্রির কাছে)
হারিসুল হক এক অগ্রসর কবি। তার কবিতার স্নিগ্ধ গতিধারা লাবণ্যময় নারী, নিসর্গ, স্বদেশ, ফুল পাখি আর আনন্দ-বেদনার উষ্ণ প্রস্রবন তার কবিতায় অন্তর্গত বোধ। একজন উন্মূল, উদ্বাস্তু মানুষ জীবনাভিজ্ঞতায় পুষ্ট হয়ে কবিতায় খুঁজে ফেরে অপার আনন্দ-বেদনা। উত্তম পুরুষে উচ্চারিত প্রেম, কাম, বিরহ জীবনের গল্প সূর্যালোকের বিভায় উদ্ভাসিত। আধুনিক মানুষের চিরকালের সঙ্গী
নিঃসঙ্গতা, প্রেম-কাতরতা ও ব্যক্তিগত অনুভূতির আলোড়ন তরাস্পায়িত
রাজনীতি মানুষের হিংস্রতা, বন্ধুত্ব হিংসার ছুরি তার দিকে লকলকে জিভ বের করে উদ্যত সঙ্গীন হয়ে ওঠে বার বার। হারিসুল হক আশা ও স্বপ্নলগ্ন। জীবনভাষ্য, সম্ভাবনা, সংগ্রাম আর পথ অতিক্রমণের মাধ্যমে তিনি অচেনা এক কবিতার জ্ঞাত পরিভ্রমণ করে চলেছেন তিনি। জীবন ও মানুষ তার কাছে রহস্যময়;
নড়ে চড়ে বসতেই মনে হলো আমি ঠিক নেই
ঘরের জায়গায় ঘর, চেয়ারের জায়গায় চেয়ার,
কম্পিউটার টেবিলে সিপিউউ, মনিটর, প্রিন্টার
যে যার জায়গায় ঠিক আছে।
শুধু আমি ঠিক নেই।
এ জীবন যেন এক অশুদ্ধ গণিত
ভ্রান্ত সূত্র ধরে কষে যাচ্ছি, ঐকিক নিয়মে
......................................
যাও তুমি বাতাসে বেলুনের মতো
উড়তে থাকো
ভাসতে থাকো
স্পর্শ করে আটঘর বেহেশতের চাবি
যাও তুমি
যেখানে যাবার যাও
(যেখানে যাবার যাও)
মানুষের তৈরি পৃথিবী শ্রেণি বৈষম্য, সম্প্রদায় বিভক্তি, আশরাফ আতরাফ ও উঁচুনীচু স্তর বিন্যাস করেছে। তাইতো এক অন্তর্বেদনা ধারণ করে হারিসুল হক স্পর্শ করে নিজস্ব পৃথিবী। শস্যক্ষেত্র, আকাশ, মেঘ, বৃষ্টি ও সৌন্দর্য তার কবিতার প্রধান উপজীব্য। শহরকে গ্রাস করছে বহুতল ভবন। মানবিকতা উধাও। হারিসুল হক মানুষের রুচি শিল্প চেতনা, নন্দনতত্ত্বের বিশাল ভুবনে আবদ্ধ।