সম্পর্কটা শুধুই জৈবিক
এক সংগ্রামী নারীর জেগে ওঠার গল্প

সৈয়দ নূরুল আলম
প্রকাশ: ১৭ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

কানাডীয় গবেষক মার্গারেট ডুডির মতে, উপন্যাসের প্রায় দুই হাজার বছরের একটি চলমান ও বিস্তৃত ইতিহাস রয়েছে, যার উৎপত্তি প্রাচীন গ্রিক ও রোমান উপন্যাস, মধ্যযুগীয় ইউরোপীয় প্রেমময় বীরগাথা এবং ইতালীয় রেনেসাঁ যুগের উপন্যাসিকার ঐতিহ্য থেকে।
উপন্যাস আধুনিক কালের সাহিত্যকর্ম হওয়ার ধারণাটি সম্পূর্ণ সঠিক নয়। কবিতা, নাটক ও ছোটগল্পের ন্যায় উপন্যাস সাহিত্যের একটি বিশেষ শাখা।
উপন্যাস লেখার কোনো স্বীকৃত নির্দিষ্ট নিয়ম বা কাঠামো নেই। তবে সচরাচর এগুলো ছোটগল্পের তুলনায় বৃহদাকার হয়ে থাকে। অধিকন্তু উপন্যাসের আখ্যানভাগ ও চরিত্রের বিস্তার লক্ষিত হয়। উপন্যাসে পরিবেশ, বর্ণনা, রূপরেখা, চরিত্র, সংলাপ ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষের জীবনের কাহিনিকে ফুটিয়ে তোলে তার মধ্যে বাস্তব জীবনের কোনো অর্থ বা ভাষ্য প্রকাশ করা হয়, যা পাঠকের কাছে বাস্তব বলে প্রতীয়মান হয়।
উপন্যাসের এই সরল সংজ্ঞাকে সামনে রেখে সম্প্রতি আসমা সুলতানা শাপলার উপন্যাস ‘সম্পর্কটা শুধুই জৈবিক (২য় খণ্ড)’ প্রকাশিত হয়েছে। আর এটা প্রকাশ করেছে অনুপ্রাণন প্রকাশন। এখানে বলা দরকার ১ম খণ্ডও একই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছিল এবং এ কথা সত্য উপন্যাসটির ব্যাপক পাঠকপ্রিয়তা থাকার কারণে অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে ২য় খণ্ডটি প্রকাশিত হলো।
আকারে বৃহদাকার, ২৪০ পৃষ্ঠা হলেও মনস্বিতা, ফারুক, তমালকৃষ্ণ, মাধবী, টুলটুল, হক সাহেব, চারু মজুমদার, এ ধরনের ছয়-সাতটা চরিত্র নিয়ে এ উপন্যাস। এতে করে চরিত্রগুলো মনে রাখা এবং চরিত্রের পারস্পরিক সম্পর্ক স্বরণ রেখে উপন্যাসের ভেতরে ঢোকা সহজ-আরামদায়ক হয়েছে, লেখকের এটা একটা গুণ বলে ধরে নেয়া যায়। অনেক উপন্যাস চরিত্রের ভারে মার খেয়ে যায়, এর উদাহরণ ভূরিভূরি আছে।
এই উপন্যাসে দুটি ধারা সমান্তরালভাবে এগিয়েছে। একটা ফারুক-মনস্বিতা, স্বামী স্ত্রীর মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্ব›দ্ব।
পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর ওপর যে অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন হয় তার একটা বাস্তব চিত্র লেখক ফারুক ও মনস্বিতা চরিত্রের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন। যা বর্তমান সমাজে অহরহ দেখা যায়, বিশেষ করে কর্মজীবী নারীর ক্ষেত্রে এই নির্যাতন আরো ভয়াবহ, যেটা চাকরিজীবী মনস্বিতার ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাই। আর সন্দেহপ্রবণ বেকার স্বামী হলে তো কথাই নেই। একই ভাবধারায় উপন্যাসে বাবার বয়সি তমালকৃষ্ণের সঙ্গে মনস্বিতার পরকীয়ার সম্পর্ক আছে এই ভেবে ফারুক মনস্বিতার ওপর অকথ্য ভাষা ব্যবহার করে। উপন্যাসের অনেকটা জায়গাজুড়ে রয়েছে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে এই টানাপড়েন। এরা-ই উপন্যাসের মূল দুটি চরিত্র। লেখক আসমা সুলতানা শাপলা মমতা ঢেলে চরিত্র দুটি সৃষ্টি করেছেন। পড়তে পড়তে মনে হবে এ ঘটনা বাস্তবে নিত্যদিন ঘটছে।
লেখকের লেখার আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য তরতর করে পড়া যায়, উপন্যাসের মধ্যে একবার ঢুকলে, শেষ না করে আর বের হতে মন চাইবে না।
উপন্যাসের অন্য ধারাটি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট। যে অংশটুকু নেতৃত্ব দিয়েছেন তমালকৃষ্ণ। লেখকের ভাষায়- তমাল কৃষ্ণ নকশাল। তিনি মনে এখনও ধারণ করে আছেন সাম্যবাদ। কমরেড চারু মজুমদারের দলিল নিয়ে, জীবনের শঙ্কা নিয়ে চড়ে বেড়াচ্ছেন নেপালের ভয়ানক সীমান্তে। এখানে মূলত নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপট, ঘটনা প্রবাহ, চারু মজুমদার, দেবী প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সরোজ দত্ত- তাদের সংশ্লিষ্টতা, সংগ্রাম, তুলে এনে রাজনৈতিক উপন্যাসের রূপ দিয়েছেন লেখক, এতে করে ইতিহাসনির্ভর কিছু চরিত্র, কিছু ঘটনা, পাঠক মুগ্ধতার সঙ্গে ধারণ করতে পারবেন।
তাই বলা যায় দুটি ধারার সংমিশ্রণে একটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস তৈরিতে কথা সাহিত্যিক আসমা সুলতানা শাপলা সার্থক। সার্থক মনস্বিতার মতো সংগ্রামী, আপসহীন, দৃঢ়চেতা এক নারী চরিত্র সৃষ্টিতে।
মনস্বিতা চরিত্রের কিছু আদল দেখে নিই- ফারুকের সামনে নিজের ভাঙন সেদিনও খুলে ধরেনি মনস্বিতা। আজও না। তার গোপন-গভীর প্লাবন সে বিশ্বচরাচরকে দেখতে দেবে না। ঘরে তার বিরুদ্ধ বাতাস। কাঁদবার ফুরসৎ নেই। ফারুকের চোখে ধরা পড়েনি টেলিফোনে মনস্বিতার বাবার সঙ্গে কথোপকথনের শব্দ। তাকিয়ে দেখেনি মনস্বিতা চোখের রং। বোঝার মতো সময় হয়নি বাপ-কন্যার কথায় ভাবাবেগের ব্যাকুল যাতনার বিশদ। চিরকাল মনস্বিতার সব যাতনা এমনই বোবা (পৃষ্ঠা ৮২, লাইন ১৭)। এভাবেই লেখক উপন্যাসের মূল চরিত্র মনস্বিতাকে চিত্রিত করছেন। তার ভাষা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ, মেদহীন, ভাদ্র মাসের রোদের মতো খটখটে। শুধু উপরের কয়েকটি লাইনেই নয়, পুরো উপন্যাসে এ ভাষার বৈশিষ্ট্য দেখা যাবে।
নারী সব সময়, সব পরিস্থিতিতে স্নেহময়, মমতাময়ী, দায়িত্বশীল। এই চিরন্তন সত্য থেকে লেখক বের হয়ে আসেননি বা আসতে চাননি, তাই তো ফারুক ফুলদানিটা মনস্বিতাকে লক্ষ্য করে ছুড়ে মারলে সেটা মনস্বিতার মাথায় লেগে কেটে গিয়ে রক্ত ঝরে পড়তে থাকে। এরপরও পরক্ষণে লেখক লেখেন- কোনোভাবেই এই দুর্বল শরীরে মনস্বিতা নিজেকে ক্ষমা করতে পারে না। কেন সে এতটা রেগে গেছিল। কেন সে ফারুককে এভাবে বলতে গেছে এসব, ভেবে অনুশোচনা হয়। কিন্তু করারই-বা কি ছিল; আবর্জনা দিনে দিনে জমতে জমতে কখন যেন পাহাড় হতে শুরু করেছে যার ভার মনস্বিতা একা আর নিতে পারছে না। এভাবেই আসমা সুলতানা শাপলা তার উপন্যাসের চরিত্রের ওপর বিশ্বস্ত থেকে উপন্যাসের প্রাণ দিয়েছেন। তবে উপন্যাসে তথ্যগত একটা বিভ্রাট চোখে পড়ে। সেটা পাঠক হিসেবে আমার বোঝার ভুলও হতে পারে। যেমন- মনস্বিতার বাবার কথা বলতে গিয়ে লেখক এক জায়গায় লেখেন- হক সাহেবের বয়স পঁচাত্তর বছর। মুখে পাকা দাড়ি। একমাথা সাদা ঘন চুল তার। মাঝারি গড়নের শরীর। ধীরগতিতে ভেতরের ঘরের দিকে আগান। তার মায়ের পাঠানো কিছু জিনিসপত্র হাত থেকে নামাতে ভুলে যান।
অন্য এক জায়গায় লেখেন- প্রিয়তম সন্তানের সংসারে বিধ্বংসী পতনের সামনে হঠাৎ এসে রহমত আলী সাহেব অস্বস্তিতে পড়ে যান। এখানে মনস্বিতার বাবা হক সাহেব, না রহমত আলী এটা খটকা লাগা স্বাভাবিক।
বইটির নান্দনিক প্রচ্ছদ করেছেন আইয়ুব আল আমিন। মুদ্রণ মূল্য ৬০০ টাকা।
অভিনন্দন লেখককে। আশা করি ১ম খণ্ডের মতো এটাও পাঠকপ্রিয়তা পাবে।