×

সাময়িকী

বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী

ইতিহাস হয়ে যাওয়া মানুষ

Icon

জামাল উদ্দিন

প্রকাশ: ১০ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ইতিহাস হয়ে যাওয়া মানুষ
   

মানুষ যেমন ইতিহাস রচনা করে, ইতিহাসের ঘটনাবলি গ্রন্থনা করে, তেমনি ইতিহাসও কোনো কোনো মানুষকে তার অন্তর্গত করে নেয়। তাই মানুষের জন্য যেমন ইতিহাস, তেমনি ইতিহাসের জন্যও প্রয়োজনীয় উপকরণ হয়ে যান কোনো কোনো মানুষ। উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না যে, ইতিহাসের মানুষ যে কেউ হতে পারেন না, তাকে ইতিহাসের উপকরণ হতে হয়। হতে হয় আপন কর্মের শক্তিতে। বাংলাদেশের চৌদ্দ কোটি মানুষের মধ্যে একটি মানুষ, বহু নামের মাঝে একটি বিশেষ নাম, উজ্জ্বল একটি নাম বিপ্লবী বিনোদ বিহারী চৌধুরী। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন ও জালালাবাদ যুদ্ধের সৈনিক বিনোদ বিহারী চৌধুরী আজ জীবন্ত কিংবদন্তি। প্রচারবিমুখ এই মানুষটি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আজীবন সংগ্রাম করেছেন। অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ ও মানবতাভিত্তিক ধর্ম নিরপেক্ষতার ঐতিহ্যে তার সমগ্র জীবন আলোকোজ্জ্বল।

বাঙালি সংস্কৃতি যে কোনো একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের সংস্কৃতি নয়, হিন্দু-মুসলমানসহ সব সম্প্রদায়ের মিলিত সংস্কৃতি মানবতাবাদী সংস্কৃতি এই বিশ্বাস তার অন্তর্গত। আর এই বিশ্বাস তিনি কোনো সময় কোনো দিন গোপন করে রাখেননি। অকপটে ও নির্ভয়ে প্রকাশ করেছেন। অনেক সরকারি নির্যাতন সইতে হয়েছে তাকে, তবু বিশ্বাস হারাননি। আর এই বিশ্বাসে যারা বিশ্বাসী তাদেরও তিনি দূরে সরিয়ে রাখেননি। তাদের সবার কাছে থেকেছেন, তাদের কাছে টেনেছেন ও তাদের সবাইকে নিয়ে নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন যুগের পর যুগ ধরে। ১৯৩০ সালের জালালাবাদ যুদ্ধের পর এমন কোনো প্রগতিশীল সংগ্রাম নেই যেখানে বিনোদ বিহারী চৌধুরীর বলিষ্ঠ অবদান নেই। ‘আমি’ ও ‘আমরা’ কথা দুটোর মধ্যে অনেক পার্থক্য। একা ও একত্র হওয়ার মধ্যেও অনেক পার্থক্য। নিজেদের অন্তরে লালন করা আদর্শের জন্য আমরা মাঝে মাঝে একত্রিত হই আবার বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি। রেভ্যুলিউশন আর কনভালসন (খিঁচুনি) এক নয়। একা যারা তারা তো নিঃসঙ্গ আর একত্রিত যারা, সক্রিয় যারা, সংগঠিত যারা, সংঘবদ্ধ যারা, গ্রহণযোগ্য সমাজ নির্মাণের সংগ্রামে তারাই শক্তিশালী। বিনোদ বিহারী চৌধুরী এই আদর্শের জন্য শুধু একত্রিত নয়, একতাবদ্ধ হওয়াতে বিশ্বাসী। এটাই তার প্রধান শক্তি ও বিশ্বাস। কর্মই জীবন কিন্তু সংগ্রামহীন আদর্শহীন কর্ম তো মূল্যহীন। তা হচ্ছে শুধু শুধু সময়কে পার হতে দেয়া। বিনোদ বিহারী চৌধুরী তার সুদীর্ঘ কর্মময় জীবনে তার প্রতিটি কর্মকে শুধু শুধু সময়ের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিত থাকতে চাননি। তিনি জীবনে মূল্যহীন অর্থহীন কোনো কর্মে নিজেকে নিয়োজিত রাখেননি, অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি কোথাও কোনোদিন। বন্দরনগরী চট্টগ্রামের ইতিহাস ও ঐতিহ্য গৌরবময় প্রধানত এজন্য ও যে তিরিশের দশকে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের এখানেই সূচনা করেছিলেন মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বাধীন ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি। তারা আয়ারল্যান্ডের বিপ্লবীদের সশস্ত্র সংগঠন আইআরএর নামই শুধু ধারণ করেননি, চট্টগ্রামের বহু লক্ষ্যস্থলে যুগপৎ আক্রমণ করার তারিখ হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন ডাবলিন শহরে ব্রিটিশবিরোধী ‘ইস্টন বিবেলিয়ন’-এর বিশেষ দিনটিকে। সূর্যসেনের নেতৃত্বে সেই যুদ্ধে ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির সৈনিক ছিলেন বিনোদ বিহারী চৌধুরী।

জালালাবাদ যুদ্ধ নামে খ্যাত এই যুদ্ধ থেকেই মূলত ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হলো, তারই ধারাবাহিকতায় মহান মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্ত স্বাধীন দেশেরও জন্ম হলো কিন্তু সেই কাক্সিক্ষত শোষণহীন সমাজ কোথায়? এ কথা ক’জনের জানা যে, এই ভূখণ্ডে সেই ব্রিটিশ পাকিস্তানি আমলের শক্তিদের সঙ্গে সত্যিকার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়ে একজন দক্ষ সেনানির ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। নিষ্পেষিত হয়েও ছিলেন নিজ সিদ্ধান্তে অটল সুদৃঢ় পাহাড়ের মতো। জালালাবাদ যুদ্ধের এই বীর সৈনিক ব্রিটিশ আমল থেকে ‘ভারত ছাড়ো’ ‘বাংলা ছাড়ো’ আন্দোলনের প্রথম কাতারের এক নির্ভীক সৈনিকের ভূমিকা পালন করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন, তিনি আজ শতবর্ষী, আগামী ১০ জানুয়ারি ২০১০ তার শততম জন্মদিবস। সেই সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষটিকে আমরা কি সত্যিই মূল্যায়ন করতে পেরেছি?

আমাদের রাজপথে যেখানে দু’চারটে ভাঙাচোরা জীর্ণ ঘোড়ার গাড়ি শীর্ণ কয়েকটি ঘোড়াকে কোনোরকমে টেনে নিচ্ছে, সেখানে এই ১০০ বছর বয়সেও তিনি আমাদের সমাজের নির্জন আস্তাবল থেকে বুট ছোলার উপঢৌকন এড়িয়ে লাগাম উঁচিয়ে তেজী ঘোড়সওয়ারের মতো হ্রেষা ধ্বনি করে বের হয়ে এসেছেন ও সবাইকে ডেকে বলছেন- এখনো যুদ্ধে যাওয়ার সময় আছে, হাত-পা গুটিয়ে নিষ্ক্রিয় নিরপেক্ষ হয়ে তথাকথিত সুখময় গৃহকোণে বসার দিন নয়। বেরিয়ে আসার দিন। উজ্জ্বল সূর্যের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিন।

আজীবন ত্যাগী কর্মবীর শ্রী চৌধুরী তার কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ দেশ-বিদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সম্মানিত হয়েছেন। মহান স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকার জন্য বাংলাদেশ সরকার তাকে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘স্বাধীনতা পদক’ প্রদান করেন। জাতীয় দৈনিক ভোরের কাগজ ও দৈনিক জনকণ্ঠ জাতির অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান হিসেবে তাকে সম্মাননা ও সংবর্ধনা জানায়। সম্মাননা ও সংবর্ধনা থেকে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থ তিনি তার রাজনৈতিক গুরু মাস্টারদা সূর্যসেনের স্মরণে স্মারক বক্তৃতা আয়োজনের জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের হাতে তুলে দেন। তিনি ১৯৯৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টারদা স্মারক বক্তৃতা এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করেন। এ ছাড়া তিনি বিভিন্ন সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে বিপুলসংখ্যক সম্মাননা পদক লাভ করেছেন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় শতবর্ষী জীবন্ত এক ইতিহাস।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App