মো. আব্দুর রহমান
কালু বুড়োর কম্বল

প্রকাশ: ১৩ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

প্রচণ্ড শীতে আর একটুও শুয়ে থাকতে পারলেন না বেচারা কালু মিয়া। তাইতো ‘আম্বিয়া তুই কই!’ কথাটা বলেই ঠক ঠক লাঠির শব্দে কাঁপতে কাঁপতে ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন বেচারা কালু। বয়স যার নব্বই। পরনে একটা ছেঁড়া দাদুগেঞ্জী। হাফহাতা গেঞ্জিটার এক হাতা আছে আর এক হাতা নেই। আর পাবেই বা কোথায়? কিনে দেয়ার মতো কোনো মানুষও যে নেই...। একটা ছেলে যাও ছিল, চার বছর আগে করোনায় নিয়ে গেল।
যাহোক এবার হুকুর হুকুর কাশতে কাশতে কোনো রকমে লাঠি ভর দিয়ে বেরিয়ে এলেন তার সহধর্মিণী আম্বিয়া বেগম। বুড়ির চুল পেকেছে, বয়স হয়েছে, চোখে ছানিও পড়েছে; তবুও স্বামীর জন্য একটুও ভালোবাসা শুকিয়ে যায়নি। তাইতো হাতের আন্দাজেই কোমরের গোজ থেকে দিয়াশলাই বের করে কতগুলো শুকনো পাতা জ¦ালালেন। অন্তত শীত থেকে বুড়োটাকে বাঁচাবার জন্য।
এ সমাজের মানুষেরা কালু মিয়ার একটা সুন্দর নাম থাকা সত্ত্বেও কালু বুড়ো আর তার সহধর্মিণীকে কালু বুড়োর বউ বলে সম্বোধন করে থাকেন। কত স্কুল-কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ইতো এদেশের মানুষকে শিক্ষিত হওয়ার সুযোগ করে দিলো। তবুও এই স্বভাবটা মানুষের পরিবর্তন হলো না। অবশ্য এসব নিয়ে কালু মিয়ার অভিযোগ কোনোকালেই ছিল না, আর অস্ত বেলায়তো অসহায়ত্বের কাছে পরাজয় বরণ করেই নিয়েছেন। তাই এসবের প্রতি মোটেই কোনো তোয়াক্কা নেই। তবে একটা বাসনা আছে মনের ভেতরে, সেটা শুধুমাত্র একটি কালো কম্বলের।
এদিকে টপটপ করে চালের ছাউনির উপর থেকে কুয়াশা চুইয়ে পড়ছে কালু মিয়ার মাথায়। কিন্তু সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই। যখন এক ফোটা আম্বিয়া বেগমের মাথায় পড়ল, তখনই তাড়াহুড়ো করে ছেঁড়া গামছাটা এনে স্বামীর মাথায় পেঁচিয়ে দিলেন। এটাকেই বলে বুঝি ভালোবাসার মুদ্রা নিক্ষেপণে জয়লাভ। ঘরে ছাওনি নেই, পেটে ভাত নেই, শীতের পোশাক নেই, তবুও মায়া-মমতার দারিদ্র্তা নেই। ওদিকে কত কত সাহেবদের বড় অট্টালিকা আছে, গাড়ি আছে- তবুও সংসারের শান্তি পালিয়েই চলেছে বিবাদ আর ডিভোর্সে। এটাই হয়তো শান্তির জোয়ার-ভাটার বাস্তব পরিসংখ্যান।
অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর আম্বিয়া বেগম এবার আস্তে করে বললেন, ‘রাগ না করলে আমনেরে একখান কথা কইতাম।’
‘কী কথা বলো।’
সায় দিতেই স্বামীকে বললেন, ‘কালকা হুনলাম মীর বাড়িতে কম্বল দিবো।’
‘কী কইলি তুই! আমারে মানুষের কাছে আবারো অপমান করবার চাস।’
‘আহা! রাগ করেন কিয়ের লাইগা। মনে নাই, গত বছর কম্বল না পায়া ফেরত আওনের সময়, মীর সাহেব না কইছিল পরেরবার বেকতের আগে আমনেরে কম্বল দিবো। হেইর লাইগা কইছিলাম যান। এইবার বলে মেলা কম্বল আনছে। আর আমনেরেতো একটা কালো কম্বলের লাইগা অনেক দিনের শখ।’
এবার সন্ধ্যা তারার মতো ঝিমিয়ে পড়লেন কালু মিয়া। ঐ একটা জায়গাতেই তার অনেক দিনের দুর্বলতা। কিন্তু শখের কাছে পরাজয় বরণ করে অপমানের স্বাদ পেতে তার একটুও ভালো লাগে না। কারণ এ সমাজ তেলওয়ালার মাথায় তেল দেয়, আবার অপ্রয়োজনীয় পাত্রে বিলিয়ে দিতেও অনেকটাই পছন্দ করে। গতবছর মীর বাড়ি থেকে খালি হাতে ফেরার সময় কেঁদেছিলেন যতটা না কম্বলের জন্য, তার চেয়ে বেশি লজ্জার বিষফোঁড়া বুকে বিধাঁর জন্য।
অনেকক্ষণ পর আবার আম্বিয়া বেগম করুন সুরে বললেন, ‘যান আর ইতস্তত কইরেন না। এইবার আমনেরে ঠিকই দিবো।’ অবশেষে মনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও যাওয়ার জন্য রাজি হলেন কালু মিয়া।
আজ একবারের জন্যও সূর্য্যরে মুখ দেখা যায়নি। তবে দেখা যাচ্ছে মীর বাড়ির সামনে হাজার দুয়েক লোকের আনাগোনা। মাইকে চিৎকার করে লাইন ধরানো চলছে। আর এক এক করে কম্বল নিয়ে মীর সাহেবের সাথে সেলফি তোলার ধুম পড়েছে। বেশ কিছু কালো কম্বল হাতে করে মানুষ বাড়ির পথ ধরেছে। কিন্তু কালু মিয়া দেখলেন যারা কম্বল পেয়েছেন তারা সকলেই মোটামুটি স্বাবলম্বী। কিন্তু যারা অসহায় তারা এখনো পাননি। তারপরও লাইনে দাঁড়িয়েই রইলেন কালু মিয়া।
হঠাৎ কানে শব্দ ভেসে এলো, ‘আজ আর কম্বল বিতরণ হবে না।’ কিন্তু কালু মিয়া দেখলেন কম্বলতো এখনো বেশ কিছু আছে! তাই লাঠি ভর করে সামনে গিয়ে কালু মিয়া বললেন, ‘কম্বলতো আছে, আমারে একটা দেইন না সাহেব।’ মীর সাহেব বললেন, ‘এগুলা আমার লোকের লাইগা। আগামীবার আইসো তোমারে একখান দিমুনে।’
‘কী কন মীর সাহেব! গতবারওতো একই কথা কইছিলেন।’
কোনো পাত্তা না দিয়ে মীর সাহেব তার লোকদের দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে বললেন, ‘এই শোন, তোরা কালু বুড়ার লাইগা সামনের বার একটা কালো কম্বল রাখিস।’ এরপর কালু মিয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘যাও কথা বাড়াইয়ো না দেহি, বহুত কাম আছে আমার।’
একথা শুনে নিশ্চুপ হয়ে রইলেন কালু মিয়া। তারপর লজ্জায় সেই চোখের পানি ফেলতে ফেলতে খালি হাতে বাড়ির পথ ধরলেন। এখন তার কানে ভাসছে আম্বিয়ার কথা, আর চোখে কালো কম্বলের ছবি।
য় বালিয়াডাঙ্গা, কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ