বায়ুদূষণ রোধ করেই বছরে লক্ষাধিক মৃত্যু ঠেকান সম্ভব
মৃতদের ৪৮ শতাংশই ঢাকা-চট্টগ্রাম নগরের

প্রকাশ: ১৯ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ
কাগজ প্রতিবেদক : দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে বায়ুদূষণ। এই দূষণ শুধু মানবদেহকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে না, বরং মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বায়ুদূষণ রোধ করা গেলে বাংলাদেশে প্রতি বছর ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের অকালমৃত্যু ঠেকান সম্ভব। বায়ুদূষণের কারণে যাদের মৃত্যু হয়, তাদের ৪৮ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের মানুষ।
গতকাল শনিবার বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে বায়ুদূষণবিষয়ক এক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে এসব তথ্য জানানো হয়। বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস) এবং সেন্টার ফর রিসার্চ অন এনার্জি অ্যান্ড ক্লিন এয়ার (সিআরইএ) যৌথভাবে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। ক্যাপসের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জমান মজুমদারের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ ইন্সটিউট অব প্ল্যানারসের সভাপতি অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মাদ খান। গেস্ট অব অনার ছিলেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব তপন কুমার বিশ্বাস। বিশেষ অতিথি ছিলেন সুইডেন দূতাবাস বাংলাদেশের ফার্স্ট সেক্রেটারি নাইওকা মার্টিনেজ ব্যাকস্ট্রোম। অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের রেসিপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের সাবেক সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল ইসলাম, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট টিবি হাসপাতালের উপপরিচালক ডা. আয়েশা আক্তার এবং সেন্টার ফর ল’ অ্যান্ড পলিসি এফেয়ার্সের (সিএলপিএ) সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট সৈয়দ মাহবুবুল আলম তাহিন। মূল প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিআরইএর বায়ুমান বিশ্লেষক ড. জেমি কেলি। সিআরইএ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিশ্লেষক এবং প্রধান লেখক ড্যানিয়েল নেসান জুম প্ল্যাটফর্মে অনুষ্ঠানে অংশ নেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ুদূষণ (অতি ক্ষুদ্র বস্তুকণা বা পিএম ২ দশমিক ৫ এর উপস্থিতি) রোধ করা গেলে বাংলাদেশে বছরে ১ লাখ ২ হাজার ৪৫৬ জনের মৃত্যু ঠেকান সম্ভব। পাঁচ বছরের নিচের শিশুরা বায়ুদূষণের কারণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই দূষণরোধ করা গেলে বছরে ৫ হাজার ২৫৪টি শিশুর মৃত্যু ঠেকান সম্ভব। এছাড়া হৃদ?রোগে ২৯ হাজার ৯২০ জন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণে ২৩ হাজার ৭৫ জন, সিওপিডিতে (দীর্ঘস্থায়ী অবরোধক ফুসফুসীয় ব্যাধি) ২০ হাজার ৯৭৬ জন, নিউমোনিয়ায় (নিম্ন শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ) ৯ হাজার ৭২০ জন এবং ফুসফুসের ক্যানসারে ৩ হাজার ৬৩ জনের মৃত্যুরোধ করা সম্ভব।
গবেষণার তথ্য বলছে, বায়ুদূষণজনিত অসুস্থতা হাঁপানির কারণে বছরে প্রায় ৬ লাখ ৬৯ হাজার মানুষকে হাসপাতালের জরুরি বিভাগে যেতে হয়। এই দূষণের কারণে বছরে ২৬ কোটি ৩০ লাখ কর্মদিবস নষ্ট হয়। বায়ুদূষণের কারণে বছরে ৯ লাখ ৪৮৫টি শিশুর অকাল জন্ম হয়। ৬ লাখ ৯৬ হাজার ৩৮৯টি শিশু ওজন স্বল্পতায় ভোগে। বায়ুদূষণ না থাকলে বছরে মানুষের মৃত্যুহার ১৯ শতাংশ কমবে বলেও গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে। শহরাঞ্চলে বায়ুদূষণ সবচেয়ে বেশি। বায়ুদূষণের কারণে যাদের মৃত্যু হয়, তার মধ্যে ৪৮ শতাংশ ঢাকা ও চট্টগ্রাম নগরের। গ্রাম ও উপকূলীয় অঞ্চলে বায়ুদূষণ কম বলেও গবেষণায় উঠে এসেছে। বায়ুদূষণের কারণও তুলে ধরা হয়েছে এই গবেষণায়। এতে প্রথম কারণ হিসেবে শিল্পকলকারখানার বায়ুদূষণকে তুলে ধরা হয়েছে। এরপর রয়েছে বিদ্যুৎকেন্দ্র, যানবাহনের দূষণ, নির্মাণকাজ ও বর্জ্যসহ বিভিন্ন জিনিস পোড়ানোর ফলে বায়ুদূষণ। এছাড়া মৌসুমি ধুলাঝড় ও অন্যদেশ থেকে আসা দূষিত বায়ুও বাংলাদেশের বায়ুদূষণের কারণ হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে গবেষণায়।
ড্যানিয়েল নেসান বলেন, বায়ুমানের সামান্য উন্নতিও জাতীয় পর্যায়ে বড় ধরনের স্বাস্থ্যসুবিধা দিতে পারে।
দেশের পরিবেশ বিগত সরকারের উন্নয়নের বলি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারের উন্নয়ন দর্শনে বড় ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন। নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের অগ্রাধিকার দেয়া উচিত। এজন্য আইন সংস্কারসহ এর কঠোর প্রয়োগ অত্যন্ত জরুরি।
ঢাকার বায়ুদূষণকে ‘রেড কনসার্ন’ উল্লেখ করেন তপন কুমার বিশ্বাস। তিনি বলেন, দূষণরোধে মন্ত্রণালয় শেষ সামর্থ্যটুকু দিয়ে চেষ্টা করছে। পরিবেশ অধিদপ্তর প্রতিনিয়ত নজরদারি করছে। নির্মাণ উপাদান রাস্তার উপর রাখলে জরিমানা করা হচ্ছে।
অধ্যাপক আহমেদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকার বায়ুদূষণের মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে এটি শুধু মানবদেহেরই ক্ষতি করছে না, মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। তাই এ মুহূর্ত থেকেই দূষণ পর্যবেক্ষণ ও প্রতিরোধের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ এবং নীতিমালা না নিলে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বায়ুদূষণের কারণে গুরুতর স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখোমুখি হতে হবে।