শীতের সঙ্গী আরেক ‘আপদ’
কমছে ডেঙ্গু; ভয় জাগাচ্ছে নিপাহ

সেবিকা দেবনাথ
প্রকাশ: ১৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গু জ্বরের প্রকোপ এখন অনেকটাই কমে এসেছে। কিন্তু শীতের সঙ্গে আসছে নতুন এক আপদ। যার নাম ‘নিপাহ’। খেজুরের রস পান এবং বাদুড়ে খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলে এ রোগ ছড়াতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, বিশ্বমারি ঘটাতে সক্ষম নিপাহ ভাইরাস প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়। পরে সেটি মানুষে মানুষে সংক্রমিত হয়ে থাকে। এই ভাইরাসে মৃত্যুর হার দেশভেদে ৪০ থেকে ৭৫ শতাংশ। এটা নির্ভর করে একটি দেশের স্বাস্থ্য পরিষেবার ওপর।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সাধারণত ডিসেম্বর থেকে এপ্রিলের মধ্যে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। এই সময়টাতেই খেঁজুরের রস সংগ্রহ করা হয়। আর বাদুড় গাছে বাঁধা হাড়ি থেকে রস খাওয়ার চেষ্টা করে বলে ওই রসের সঙ্গে তাদের লালা, অনেক সময় প্র¯্রাবও মিশে যায়। সেই বাদুড় নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে থাকলে এবং সেই রস খেলে, মানুষের মধ্যেও এই রোগ ছড়িয়ে পারে। এছাড়া বাদুড়ে খাওয়া ফলমূলের অংশ খেলেও এ রোগ ছড়াতে পারে।
রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) পরিচালক অধ্যাপক ডা. তাহমিনা শিরীন ভোরের কাগজকে জানান, এই মৌসুমে এখনো পর্যন্ত নতুন করে কেউ নিপাহ ভাইরাসে সংক্রমিত হননি। নিপাহ ভাইরাসের বিস্তার এবং ঝুঁকি বিষয়ে ১৯ ডিসেম্বর গণমাধ্যম কর্মীদের সঙ্গে মত বিনিময় সভার আয়োজন করেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আইইডিসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ সালে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত ১৪ জনের মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৯৮ সালে মালয়েশিয়ার ‘সুঙ্গাই নিপাহ’ গ্রামে প্রথম এই ভাইরাসের প্রকোপ দেখা দেয়। গবেষণায় দেখা যায়, শুকর থেকেই নিপাহ ভাইরাস ছাড়িয়েছে। এর আগে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের কারণ হিসেবে বাদুড়ের অর্ধেক খাওয়া ফলকে চিহ্নিত করা হয়েছিল। এই ভাইরাস বাংলাদেশে শনাক্ত হয় ২০০১ সালে, মেহেরপুরে। বাংলাদেশে এ যাবত যতগুলো কেস পাওয়া গেছে, সব কটি খেজুরের রস খেয়েই হয়েছে। এযাবৎ কালের সবচেয়ে বড় আকারের নিপাহ ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয় ফরিদপুর জেলায়, ২০০৪ সালে। সে বছর নিপাহ ভাইরাসে ৬৭ জন আক্রান্ত হয়, এর মধ্যে ৫০ জনেরই মৃত্যু হয়। প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৩৩ জেলায় নিপাহ ভাইরাস ছড়িয়েছে।
আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার
সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. বে-নজির আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, নিপাহ ভাইরাসে যদিও কম সংখ্যক মানুষ সংক্রমিত হয় কিন্তু যারা এই ভাইরাসে সংক্রমিত হয় তাদের মধ্যে অন্তত ৭০ ভাগের মৃত্যু ঘটে। কখনো কখনো শতভাগেরই মৃত্যু হয়। এছাড়া এই রোগে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে থাকলেও প্রতিবন্ধিতা দেখা দিতে পারে। তিনি আরো বলেন, আক্রান্ত ব্যক্তির বা পশুর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার ২ সপ্তাহের মধ্যে লক্ষণ দেখা দেয়। লক্ষণের মধ্যে রয়েছে, মৃদু থেকে তীব্র শ্বাসকষ্ট, জ্বরসহ মাথাব্যথা, মাংসপেশিতে ব্যথা, খিঁচুনি, জ্ঞান হারানো।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. মুশতাক হোসেন ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশে শীতকালে নিপাহর সংক্রমণ হয়। কিন্তু শীতকালে সংক্রমণ হয় বলে তা গরমকালে হবে না- এমনটা ভেবে নিয়ে বসে থাকলে হবে না। ভাইরাস তার ধরন বদলে ফেলতে পারে। নিপাহ নিয়ে আমাদের দেশে সারাবছরই সার্ভিলেন্স হয়। এদিক দিয়ে আমরা এগিয়ে আছি। শীতকাল আসছে। খেজুরের রস ও পাখি বা বাদুড়ে খাওয়া ফল খাওয়া থেকে আমাদের অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। কাঁচা রস পান করা মোটেও নিরাপদ নয়। এক্ষেত্রে রসটি ফুটিয়ে খেলে ঝুঁকিমুক্ত থাকা সম্ভব। খাবার আগে ফল ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে।
এদিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ কিছুটা কমতির দিকে। হাসপাতালে দৈনিক ভর্তি রোগীর সংখ্যা ৫০০ নিচে নেমেছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে ডেঙ্গুর সংক্রমণ যে কমে আসবে সেই ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ ও গবেষক ড. কবিরুল বাশার। তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, এডিস মশার ঘনত্ব বিবেচনায় আমরা যে পূর্বাভাস দিয়ে থাকি তাতে দেখা গিয়েছে, ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ডেঙ্গুর ব্যাপকতা কমবে। সর্বশেষ বৃষ্টিপাতের পরও ডেঙ্গু অন্তত দেড় থেকে দুই মাস থাকে। দেশে সর্বশেষ বৃষ্টি হয়েছিল ২৭ অক্টোবর। সেই বৃষ্টির পানিতে যে মশার জন্ম হয়েছে সেগুলো ডিসেম্বরের ৭ তারিখের মধ্যেই মারা যাবার কথা। এরপর থেকেই মশার ঘনত্ব কমতে থাকে। ফলে ডেঙ্গুর গ্রাফ নিচের দিকে নামছে। জানুয়ারি মাসে এই গ্রাফ আরো কমবে।