পুলিশের অভিযান জোরদার
নিরাপদ ভেবে ঢাকায় এসে ধরা পড়েন তৃণমূল নেতারা

কামরুজ্জামান খান
প্রকাশ: ২০ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মিরপুরে ইকরামুল হত্যা মামলায় গতকাল সাবেক শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদারকে তিন দিনের রিমান্ডে পাঠানোর আদেশ দেয় আদালত।
বিভিন্ন মামলার আসামি ও আদালত থেকে দণ্ডপ্রাপ্ত হয়ে পলাতক অনেকে রাজধানী ঢাকাকে অভয়ারণ্য মনে করে আত্মগোপন করছেন। ইট-পাথরের ব্যস্ত শহরে লাখো মানুষের ভিড়ে নিজেকে আড়াল করে রাখার কৌশল হিসেবে তারা ঢাকাকে বেছে নিচ্ছেন। রাজনৈতিক দলের নেতা এবং মামলার আসামিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িতরাও নিচ্ছেন এই পন্থা। বিশেষত রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের অনেক নেতা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিতে শুধু ঢাকা নয়; আশপাশের সাভার, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জকে বেছে নিচ্ছেন তারা।
তবে বিগত সরকারের মন্ত্রী ও এমপিদের মধ্যে অনেকে ঢাকায় আত্মগোপন করেও রেহাই পাচ্ছেন না। একের পর এক ধরা পড়ছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা ধরতে ঢাকায় চলছে বাড়তি নজরদারি ও অভিযান। তৎপর রয়েছে গোয়েন্দারা। এর মধ্যে বিভিন্ন মামলার আসামিরা ঢাকায় ঢুকে গার্মেন্টসকর্মী, অটোরিকশাচালক সেজে মিশে গেছে সাধারণ মানুষের সঙ্গে।
গোয়েন্দা তথ্য সূত্রে এমন অনেক অপরাধী গ্রেপ্তার হওয়ার পর মামলার আসামিদের এমন কৌশল নেয়ার বিষয়টি পুলিশের নজরে এসেছে। ঢাকার সবকটি থানার অফিসার ইনচার্জকে এ ব্যাপারে খোঁজখবর রেখে অভিযান চালাতে বিশেষ নির্দেশনা দিয়েছে ডিএমপি। ঘনবসতির এই শহরকে অনেক অপরাধী নিরাপদ ভাবলেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান এবং গোয়েন্দা তথ্যে ধরা পড়ছে অনেকেই। দিন দিন জোরদার করা হচ্ছে পুলিশি অভিযান।
পুলিশের রেকর্ড থেকে জানা গেছে, পিরোজপুর মঠবাড়িয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও পৌর মেয়র রফিক উদ্দিন আহমেদ ফেরদৌসকে ১৬ অক্টোবর বুধবার সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ২০১৪ সালে যুবদল নেতা আহমেদ সোহেলের বাড়ি ভাঙচুরের মামলা ও ১৭ জুলাই ২০২৪ তারিখে বিএনপি অফিস ভাঙচুরের মামলা রয়েছে। ওই দুটি মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করে তুরাগ থানায় নেয়া হয়। নেত্রকোনা সদর উপজেলা পরিষদের সদ্য সাবেক চেয়ারম্যান মারুফ হাসান খান অভ্রকে (৫২) গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জেলা গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একটি দল ১০ অক্টোবর বৃহস্পতিবার সকালে তাকে গ্রেপ্তার করে।
অভ্র জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক। মারুফ হাসান অভ্রের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট মামলা রয়েছে। তিনি গত ১ সেপ্টেম্বর নেত্রকোনা মডেল থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা একটি মামলার ১০ নম্বর আসামি। ঢাকায় মিরপুর থেকে গ্রেপ্তার কুষ্টিয়া-৪ আসনের (কুমারখালী-খোকসা) সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রউফকে কুষ্টিয়া কারাগারে পাঠানো হয়েছে। ১ অক্টোবর রাতে র্যাব-১২ ও র্যাব-৪ এর যৌথ অভিযানে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রউফকে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে কুষ্টিয়া মডেল থানায় একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে।
২০২৪ সালের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কুষ্টিয়া-৪ আসন থেকে জয় পান আওয়ামী লীগের নেতা আবদুর রউফ। ১ অক্টোবর ভোলা-৪ (চরফ্যাশন-মনপুরা) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবদুল্লাহ আল জ্যাকবকে রাজধানীর গুলশান থেকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, সাভার থানার একটি মামলায় আওয়ামী লীগের এই সাবেক এমপিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
২০১২ সালে বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর গুলির অভিযোগে ঢাকার সিনিয়র বিচারিক হাকিম আদালতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে একটি মামলা করা হয়, যেখানে জ্যাকবও আসামি। ভোলা-৪ আসনের সাবেক এমপি নাজিম উদ্দিন আলম আদালতে ওই মামলার আবেদন করলে বিচারক এস এম সাইফুল ইসলাম তার জবানবন্দি শুনে অভিযোগটি সাভার মডেল থানাকে এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন। একইদিনে গাইবান্ধার সাবেক সংসদ সদস্য মাহবুব আরা বেগম গিনি ঢাকায় গ্রেপ্তার হন। ৩ অক্টোবর নওগাঁর পত্নীতলার সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুল গাফফারকে ঢাকার ধানমন্ডি থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
র্যাব-২ এর সহকারী পরিচালক শিহাব করিম বলেন, গত ৩ অগাস্ট নওগাঁ জেলা বিএনপি অফিসে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় ১৪ অগাস্ট সদর মডেল থানায় একটি মামলা হয়, যাতে গাফফারসহ আওয়ামী লীগের দুই-তিনশ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়। ১২ অক্টোবর ফেনীর সাবেক স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য ও জেদ্দা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মো. হাজি রহিম উল্লাহকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-২। তাকে গত আগস্টের একটি হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। গ্রেপ্তার রহিম উল্লাহ ২০১৪ সালে ফেনী-৩ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। তিনি জেদ্দা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ২৯ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক নওশেল আহমেদকে গ্রেপ্তার করে র্যাব। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কর্মসূচি চলাকালে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানোর অভিযোগে ময়মনসিংহ মহানগর ছাত্রলীগের এই নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ২ অক্টোবর ফেনীতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলিবর্ষণ ও হত্যার অভিযোগে দায়ের করার মামলার পলাতক আসামি ছাত্রলীগ নেতা ওসমান গনিকে রাজধানী ঢাকার বাড্ডা এলাকা থেকে থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
ওসমান ফেনী পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। তিনি ৪ আগস্ট মহিপালে ওয়াকিল আহমদ ওরফে শিহাব হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। ২ অক্টোবর রাজশাহী-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আবুল কালাম আজাদকে রাজধানীর মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। গত ১৯ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ছাত্র-জনতার ওপর হামলা ও আক্রমণের ঘটনায় রাজশাহী-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য (এমপি) আসাদুজ্জামান আসাদকে ৬ অক্টোবর রাজধানীর বারিধারা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন ছাত্র-জনতার ওপর হামলার নির্দেশ, হামলা ও অর্থ জোগানের অভিযোগে কিশোরগঞ্জ-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট সোহরাব উদ্দিনকে ৯ অক্টোবর ঢাকার দিয়াবাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তিনি নওগাঁর সাবেক সংসদ সদস্য। চাঁদাবাজি ও প্রাণনাশের হুমকির অভিযোগে ঠাকুরগাঁও-২ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য মাজহারুল ইসলাম ওরফে সুজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। ১১ সেপ্টেম্বর দুপুরে রাজধানীর নিকুঞ্জ এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে র্যাব-১ এর একটি দল। এছাড়া ঢাকার বাইরের আরো কয়েকজন নেতা ঢাকায় এসে পুলিশ-র্যাবের জালে ধরা পড়েছে বলে জানা গেছে।
অন্য অপরাধীরাও ঢাকায় : পরিচয় গোপন করে রাজধানীতে অবস্থান নিয়ে অনেক অপরাধীও নানাভাবে তৎপর রয়েছে। তারা ঢাকায় চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপকর্ম করছে। এদের মধ্যে আছে জঙ্গি ঝুঁকিও। পুলিশের একটি সংস্থার কর্মকর্তারা বলেছেন, অনেক মামলার গ্রেপ্তারি পরোয়ানাভুক্তদের খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। দিন দিন এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। অপরাধীরা অপরাধ করে একস্থান থেকে অন্যস্থানে সটকে পড়ছে। অনেকে আবার জামিনে মুক্ত হয়ে আত্মগোপন করছে। আদালত তাদের ব্যাপারে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলেও পুলিশ তাদের খুঁজে পাচ্ছে না।
তথ্য বলছে, ঢাকা ও আশপাশের অনেক পোশাক করখানায় বিভিন্ন মামলার আসামিরা কাজ করছে। তারা বিভিন্ন জেলা থেকে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় এসে পরিচয় গোপন করে আছে। আবার ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় নগদ আয় থাকায় অনেক মামলার আসামি সেগুলো ভাড়া নিয়ে বা কিনে চালাচ্ছে। অনেকে সপরিবারে এলাকা ছেড়ে ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ভাড়া বাসায় উঠেছে। ভাড়াটিয়ারা নিবন্ধন ফরম সঠিকভাবে পূরণ না করায় তাদের ব্যাপারে সঠিক তথ্য পাচ্ছে না সংশ্লিষ্ট থানাপুলিশ।