সবজির বাজার: হাতবদলে দাম বাড়ে ২০ টাকা

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ১৩ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে দামের তারতম্য থাকবে- সেটা স্বাভাবিক। তাই বলে প্রায় দ্বিগুণ ফারাক? দোকানদাররা বলছেন, যাতায়াত ও অন্যান্য খরচ মিলিয়ে তাদের ব্যয় অনেক। তাই পাইকারি থেকে ১০-২০ টাকা বেশি দামে বিক্রি না করে তাদের উপায় নেই। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার রোগে পেয়েছে। পরিত্রাণ পেতে হলে মুক্তবাজার অর্থনীতি থেকে বের হয়ে সামাজিক ব্যবসা স্থাপন করতে হবে। তবেই সাধারণ ভোক্তা সুফল পাবে।
এ বিষয়ে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, সবাই বেশি লাভ করতে চাচ্ছে। অর্থাৎ ব্যবসায়ীদের মধ্যে অতি মুনাফার প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। আমরা ভোক্তারাও সবকিছু মেনে নিচ্ছি। আর তাই কৃষক যেই দামে পণ্য বিক্রি করছে, তার দ্বিগুণ দামে আমাদের পণ্য কিনতে হচ্ছে। আগামীতে হয়তো আরো বেশি দামেও কিনতে হতে পারে।
তিনি বলেন, সব মানুষের মধ্যেই এখন অতি মুনাফার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। সেটা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করবে- তা ভাবার সময় এসেছে। দেশে সামাজিক ব্যবসাকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করতে হবে। আমাদের প্রধান উপদেষ্টা যদি এই বিষয়ে পদক্ষেপ নেন তাহলে ভোক্তাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি আসতে পারে।
গোলাম রহমান বলেন, পরিবর্তনের বিষয়টি অত সহজ নয়, তবে প্রধান উপদেষ্টা বেশ কিছু জায়গায় এপ্লাইও করেছেন।তিনি আরো বলেন, আমরা এখন পুঁজিবাদি বাজার ব্যবস্থা বা মুক্তবাজার মডেলে চলছি। সেখান থেকে ইউনূস সরকার যদি সামাজিক ব্যবসার মডেলে যেতে পারে- তাহলে হয়তো এখনই সুফল পাওয়া যাবে না, তবে দীর্ঘমেয়াদে সুফল পাওয়া যাবে।
গতকাল শনিবার কারওয়ান বাজারসহ রাজধানীর কয়েকটি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, টানা বৃষ্টির প্রভাবে বেড়েছে সব ধরনের সবজির দাম। এজন্য সরবরাহ কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা।
তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, যে সবজি কৃষকের কাছ থেকে ৪০ থেকে ৪২ টাকায় কিনে নিয়ে আসছে, সেটা পাইকারিতে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। অথচ হাতবদল হতেই তা ৮০ থেকে ১০০ টাকা হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ ক্রেতারা বলছেন, দেশের সরকার পরিবর্তন এলেও বাজারে জেঁকে আছে সেই পুরনো সিন্ডিকেটের ভূত। কোনোভাবেই এই সিন্ডিকেট ভাঙা যাচ্ছে না। যদিও আড়তদার এবং খুচরা বিক্রেতাদের দাবি- বর্তমানে চাহিদার তুলনায় সবজির সরবরাহ কম। বৃষ্টির কারণে অনেক সবজি নষ্ট হয়ে গেছে, জমিতে কাদা পানি জমে যাওয়ায় সবজি সংগ্রহ করতেও কষ্ট হচ্ছে।
তাছাড়া টানা বৃষ্টিতে পরিবহন ব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ায় সবজি বাজারে আসতে সময় লাগছে। এর পাশাপাশি চাঁদাবাজি তো রয়েছেই। কারওয়ান বাজারের পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী ফয়সাল বলেন, সাধারণত যেসব সবজি ২০ মণ আনি, সেগুলো এখন আনছি ৭-৮ মণ। টানা বৃষ্টির কারণে জমিতে কাদা পানি, সেজন্য সবজি সংগ্রহ করা যাচ্ছে না।
একই বাজারের গাউছিয়া সবজিভাণ্ডারের মালিক মোস্তফা কামাল ভোরের কাগজকে বলেন, যেখান থেকে পণ্য আসে অর্থাৎ দিনাজপুর থেকে পণ্য আনতে প্রতি কেজিতে দশ টাকা খরচ পড়ে। শ্রমিক, গাড়ি ভাড়া, বস্তা, সুতলি নিয়েই এই ১০ টাকা খরচ। তাই যে সবজি ৪০ টাকা কেজি দরে কৃষকের কাছ থেকে আনা হচ্ছে, সেই সবজি আমরা ৫০ টাকায় বিক্রি করছি। তবে খুচরায় সেই সবজি ৮০ থেকে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, একজন খুচরা বিক্রেতা এখান থেকে সবজি কিনে কুলিকে দিতে হচ্ছে প্রতি মণে ৩০ টাকা। রাস্তায় যেখানে রাখছে সেখানে দিতে হচ্ছে ২০ টাকা। সেখান থেকে উঠাতে লেবারকে দিতে হয় ৫ টাকা। এরপর গাড়ি ভাড়া, দোকান ভাড়া, কর্মচারী ভাড়া হিসাব করে পণ্যের দাম নির্ধারণ করে।
তিনি আরো বলেন, এর পাশাপাশি বাজারে কিছু সিন্ডিকেটও কাজ করে। এই সিন্ডিকেট ভাঙা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ সবার চরিত্র খারাপ। তাই যে সরকারই আসুক এই সিন্ডিকেট ভাঙতে পারবে না। গত ১৫ বছরে আওয়ামী সরকারের সাঙ্গপাঙ্গরা সিন্ডিকেট, চাঁদাবাজি করে বাড়ি-গাড়ির মালিক হয়েছে। আর এখন নতুন করে অন্য দল সেই পথে হাঁটছে। চাঁদাবাজি বন্ধ হয়েছে বলা হলেও তার কিছুই হয়নি। যারা দিনের বেলা ব্যানারের নিচে মিছিল করে তারাই রাতে চাঁদাবাজি করে। এসব বলতে গেলেও ভয় আছে, কখন আবার এসে হামলা করে।
অন্যান্য বার বন্যার অজুহাতে দাম বেশি হলেও এবারে বিগত দিনের সব দাম ছাড়িয়ে গেছে। এর কারণ জানতে চাইলে মোস্তফা কামাল বলেন, প্রতি বছর বন্যা হলেও এবারের মতো একটানা বন্যা হয়নি। এবারের বন্যায় সারাদেশে সবজি ক্ষেত ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। চুয়াডাঙ্গায় কিছু সবজি আছে। আর দিনাজপুরে কিছু সবজি রয়েছে। যাও আছে তা নিয়ে আসতে আসতে অনেক সবজি পচে যাচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, অন্যবার বন্যা হলে কিছু দিনের মধ্যেই তা স্বাভাবিক হয়ে গেছে। মানুষ আবার ফসল লাগিয়েছে। কিন্তু এবার কৃষক ঘরের মধ্যে চারা তৈরি করে রেখে দিয়েছে। কিন্তু বন্যার ধারাবাহিকতা এত বেশি যে তা জমিতে লাগাতে পারছে না। ফলে বাজারে সবজির ঘাটতি দেখা দিচ্ছে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে বেশির ভাগ সবজির কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-১৪০ টাকা দরে। এর মধ্যে আছে- গোলবেগুন, বরবটি, করলা, ঝিঙা, চিচিঙ্গা, ধুন্দলের মতো সবজি। কয়েক সপ্তাহ ধরে কাঁচামরিচের দাম নিয়ে বেড়েছে ক্রেতাদের অস্বস্তি। পাইকারি বাজারে টমেটো বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২২০ টাকা দরে। খুচরা বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৪০-২৫০ টাকায়। একইভাবে পাইকারিতে ৬০ টাকায় বরবটি, চিচিঙ্গা, ঝিঙা, করলা, পটল, উস্তা, ঢ্যাঁড়স পাওয়া গেলেও খুচরা বাজারে তা ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এছাড়া পাইকারিতে ৫০ টাকা কেজি শসা খুচরায় বিক্রি হচ্ছে ৮০ টাকা দরে। মানভেদে ২২০ থেকে ২৮০ টাকা কেজি কাঁচামরিচ খুচরায় ৪০০ টাকা কেজি বিক্রি হতে দেখা গেছে।
কারওয়ান বাজারের সবজি বিক্রেতা আমিনুল বলেন, পাইকারি বাজারে সবজির কোনো সংকট নেই। এখন রাস্তায় চাঁদা দেয়া লাগছে না। কিন্তু দাম কমার পরিবর্তে উল্টো বাড়িয়ে আড়তদাররা বলছেন, বন্যার কারণে দাম বাড়তি। তিনি জানান, বন্যার কারণে এমনটা হলে আড়তে সবজির সংকট থাকত। সেরকম তো দেখছি না। সব তাদের কারসাজি।