×

ইষ্টিকুটুম

কমলেশ রায়

বুদ্ধির মার নেই কমলেশ রায়

Icon

প্রকাশ: ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বুদ্ধির মার নেই কমলেশ রায়
   

ছাদ ভরতি রোদ্দুর। তরুদা পূর্ব দিকের রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। তার দুচোখ বন্ধ। ঘড়িতে বেলা মাত্র তিনটে। এরই মধ্যে পশ্চিমে হেলে পড়েছে সূর্য। তেজও কমে এসেছে। শীতকালে সূর্যকে বড় কাহিল মনে হয়।

পায়ের শব্দে চোখ খুলল তরুদা। আমাকে দেখে হাসল। তার পরনে কালো ট্রাউজার আর হালকা আকাশি রঙের টি-শার্ট।

গায়ের জ্যাকেট হটাও। তরুদা বলল। মুখে হাসি।

কেন? আমি জিগ্যেস করলাম।

শরীরে রোদ না লাগালে ভিটামিন ডি তৈরি হবে কী করে। বিনে পয়সায় পাওয়া যায় তো, তাই কদর নেই।

অনেকে বিষয়টা জানে না। কদর হবে কী করে?

সচেতনতা বাড়াতে হবে।

ভিটামিন ডি ক্যাপসুল তো আছে। আমি বললাম। বড়কাকাকে খেতে দেখেছি। তাই এ ওষুধের কথা জানি।

হ্যাঁ, শরীরে বেশি ঘাটতি হলে পরে টাকা দিয়ে ওষুধ কিনে খেতে হয়।

এরপর কথা বাড়ানোর কোনো অর্থ হয় না। জ্যাকেট খুলে হাতে নিয়ে আমি তরুদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম।

পুলু, একটা ধাঁধার উত্তর দিতে পারবে?

চেষ্টা করে দেখতে পারি। আমি হেসে বললাম। তরুদা কঠিন সব ধাঁধা ধরে। বেশিরভাগ সময়ই উত্তর দিতে পারি না।

ফ্রিজে রাখার পরও কোন জিনিস গরম থাকে? প্রশ্নটা করেই তরুদা আবার চোখ বন্ধ করে ফেলেছে। মুচকি হাসি লেপ্টে আছে মুখে।

এই ধাঁধার উত্তর আমার জানা নেই। চেষ্টা করলেও পারব বলে মনে হয় না। এই ফাঁকে তরুদা সম্পর্কে একটু বলে নেয়া যাক। সে আমার মামাতো ভাই। একমাত্র মামার একমাত্র ছেলে। মজার এই মানুষটির বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। উচ্চতা পাঁচ ফুট সাড়ে দশ ইঞ্চি। গায়ের রঙ ফরসা। এক মাথা কোঁকড়ানো চুল। অত্যন্ত বিচক্ষণ। মস্তিষ্ক ক্ষুরধার। তার মতে, বুদ্ধির চেয়ে বড় অস্ত্র আর নেই।

মনে হচ্ছে পারবে না। ঠিক তো? তরুদা চোখ না খুলেও যেন আমার মুখের অবস্থা দেখতে পাচ্ছে।

হ্যাঁ, পারব না।

উত্তর হলো গরম মসলা। ফ্রিজে রাখলেও সেটা গরম মসলাই থাকে। ঠাণ্ডা মসলা হয় না।

আমি কিছু বলার আগে ছুটে এলো বিশু। আমার সহপাঠী। স্মার্টফোন বাড়িয়ে দিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে সে বলল, তরুদা দ্যাখো কী কাণ্ড।

চোখ খুলে স্মার্টফোনটা হাতে নিয়ে তরুদা বলল, আচ্ছা দেখছি। তার আগে তুমি একটু শান্ত হও।

আমিও ঝুঁকে পড়লাম কাণ্ড দেখতে।

দুই.

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে একটি ভিডিও। সেটাই দেখাতে এসেছে বিশু।

ফুলকপির বিশাল ক্ষেত। কাস্তে হাতে এগিয়ে গেলেন মধ্যবয়সি এক কৃষক। দক্ষ হাতে সুন্দর একটা ফুলকপিতে তেড়ছা করে বসিয়ে দিলেন কোপ। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল ফুলের অংশটুকু। একে একে কুপিয়ে নষ্ট করলেন পাঁচটি ফুলকপি। একই সঙ্গে শোনা গেল তার ক্ষোভের কথাও, ‘একটা ফুলকপি বেচে এক টাকাও পাওয়া যায় না। বাজারে নিয়ে গেলে ভ্যান ভাড়া ওঠে না। কী হবে এগুলো ক্ষেতে রেখে? আজ পাঁচটা কাটলাম। কাল পুরো ক্ষেত পরিষ্কার করে ফেলব।’

লোকটাকে চেনা-চেনা লাগছে। বলল তরুদা। সঙ্গে যোগ করল, এই ভিডিও তো দেখছি পোস্ট করেছে দোলন নামের এক ব্যক্তি।

চেনা তো লাগবেই। এই লোকটা হচ্ছে উত্তরপাড়ার দোলন কাকা। বিশু বলল।

আমাদের গ্রামে এই কাণ্ড! তরুদার গলায় বিস্ময়।

লেখাপড়ার কারণে তরুদা দীর্ঘসময় বাড়ির বাইরে কাটিয়েছে। এ জন্য গ্রামের অনেককে সে চট করে চিনতে পারে না। আর আমাদের গ্রামটাও বেশ বড়।

বিরাট ক্ষতি হয়ে যাবে তো দোলন কাকার। আমি যোগ করলাম।

না, না। সেটা কিছুতেই হতে দেয়া যাবে না। তরুদা বলল।

একটা কিছু করো তরুদা। বিশুর অনুরোধ।

দেখি কী করা যায়। একটা উপায় তো বের করতেই হবে।

তরুদা যখন এ কথা বলেছে তখন অবশ্যই ভালো কিছু হবে। তার প্রতি সেই বিশ্বাস আমাদের আছে। বিশুও আশ্বস্ত হলো।

ফুলকপির দাম না পেয়ে দোলন কাকা হতাশ হয়ে পড়েছেন। হতাশা থেকে কাল সকালেই ক্ষেতের অনিষ্ট করে ফেলতে পারেন। আগে ওনাকে থামাতে হবে। একটু ভেবে কথাগুলো বলল তরুদা। তার মানে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে শুরু করে দিয়েছে সে।

আমরা দুজন মাথা নেড়ে তার কথায় সায় দিলাম।

৫টার দিকে আমরা দোলন কাকার বাড়িতে যাব। তোমরা দুজন তৈরি থাকবে। তরুদা সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল।

আচ্ছা, থাকব। আমি আর বিশু প্রায় একই সঙ্গে বললাম।

তিন.

আমরা যখন রওনা দিলাম তখন সন্ধ্যা প্রায় ঘনিয়ে এসেছে। তরুদার হাতে ছোট্ট একটা ব্যাগ। বিশু হাঁটছে সবার আগে। মাঝে আমি। পেছনে তরুদা।

উত্তরপাড়া যাওয়ার রাস্তায় অনেকগুলো বাঁক। দ্বিতীয় বাঁক পার হতেই দেখা গেল, বিল থেকে জমির আইল দিয়ে হেঁটে আসছে ফজল। তার দুহাতে চারটে অতিথি পাখি।

তরুদা আমাদের থামতে বলল। একটু পরেই রাস্তায় উঠে এলো ফজল।

এই পাখি কেন ধরেছ? তরুদা জিগ্যেস করল।

বিক্রি করার জন্য। ফজল বলল।

কত হলে বিক্রি করবে?

এহন সন্ধ্যের সময়। এলোমেলো কথা কইয়া লাভ নাই। এক দাম এক হাজার টাহা।

তরুদা আর দরদাম করল না। পকেট থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে ফজলকে দিল। তরুদা অতিথি পাখি কিনছে? অবিশ্বাস্য!

ফজল পাখিগুলো নিতে আমার দিকে ইশারা করল।

পুলু পাখি নেবে না। তুমি এবার ওগুলোকে ছেড়ে দাও। তরুদা দৃঢ় গলায় বলল।

যাক, এতক্ষণে হিসাব মিলল। তরুদার কাণ্ড দেখে আমি তো অবাক হয়ে গিয়েছিলাম।

কী বলতিছেন, ছাইড়া দিবো? ফজল যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না।

হ্যাঁ, ছেড়ে দেবে। আর কাল থেকে তুমি আর অতিথি পাখি ধরবে না। তুমি জানো না অতিথি পাখি ধরা আইনত অপরাধ?

হাতে এহন কোনো কাজ নাই। তাই পাখি ধইরা দুইডা পয়সা কমানোর চেষ্টা করতেছি। মাকে নিয়ে তো বাঁচতি হবি। ফজল চোখ নামিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল। বছর বিশেকের তরুণকে বড্ড অসহায় মনে হলো।

তার বাবা মারা গেছে বছর ছয়েক আগে। জমিজমাও তেমন নেই। কামলা খেটে সংসার চালায়। তার মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে।

তুমি কাল সকালে আমাদের বাড়িতে এসো। কাজের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তরুদা আন্তরিকভাবে বলল।

পর পর চারটে পাখিকে অবমুক্ত করা হলো। ডানা মেলে ওরা উড়ে গেল মুক্ত আকাশে। এই দৃশ্য আসলেই অনেক সুন্দর। বিশু তো হাততালি দিয়ে ফেলল।

ফজলের হঠাৎ করেই বোধোদয় হলো। সে টাকা ফেরত দিতে চায়, কিছুতেই আর নেবে না। তরুদা শেষপর্যন্ত তাকে বুঝিয়ে বলল, টাকাটা রাখো। মনে করো এটা তোমাকে কাজের অগ্রিম হিসেবে দেয়া হলো।

দোলন কাকাকে বাড়িতেই পাওয়া গেল। তরুদা তার কাছ থেকে একদিন সময় চেয়ে নিল। বলল, চিন্তা করবেন না কাকা। আশাকরি একটা কিছু করা সম্ভব হবে।

তরুদার বন্ধুরা বড় বড় পদে চাকরি করেন। এছাড়া অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তার জানাশোনা রয়েছে। নামকরা এক সুপার শপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা তরুদার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। তার ডাক নাম হিটু। সারা দেশে তাদের প্রতিষ্ঠানের সাড়ে তিনশর মতো আউটলেট রয়েছে।

বিকালেই সেই বন্ধুকে দোলন কাকার ভিডিওটা পাঠিয়েছিল তরুদা। রাত সাড়ে ১০টার দিকে বেজে উঠল মোবাইল ফোন। তরুদার বন্ধু জানালেন, কৃষকের কাছ থেকে প্রতি পিচ পাঁচ টাকা দরে ফুলকপি কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। আউটলেটগুলোতে বিক্রি করবেন আট টাকা করে। একই সঙ্গে তিনি তরুদাকে ধন্যবাদ দিলেন এরকম একটা খবর তাকে জানানোর জন্য।

লাউড স্পিকারে দিয়ে কথা বলছিল তরুদা। তাদের সব কথাই শুনতে পেলাম আমি।

ফোন রেখে তরুদা বলল, যাক শুধু দোলন কাকা নয়, সারা দেশের হাজারো ফুলকপি চাষি লোকসানের হাত থেকে বেঁচে গেল।

হ্যাঁ, এই এলাকার অন্য কৃষকরাও তো তাহলে লাভবান হবে। আনন্দে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল বাক্যটা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App