×

প্রথম পাতা

ব্যাংক উজাড় খেলাপি ঋণে

Icon

মরিয়ম সেঁজুতি

প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

ব্যাংক উজাড় খেলাপি ঋণে

ছবি: ভোরের কাগজ

   

খাতা-কলমে ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচকের উন্নতি হয়েছে। খেলাপি ঋণ কমছে। মুনাফা বাড়ছে। সুদ হার কমিয়ে নাগালের মধ্যে আনা হচ্ছে- এসব করা হয়েছে কয়েকটি কাগুজে পদ্ধতি ব্যবহার করে। ব্যাংকের প্রকৃত তথ্য গোপন করে প্রকাশিত আর্থিক স্বাস্থ্যের প্রবৃদ্ধি দেখানো ব্যাংক খাতে এখন নাজুক অবস্থা। সরকার বদলের পর ব্যাংক ঋণের প্রকৃত চিত্র বেরিয়ে আসছে। জানা যাচ্ছে, প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমাণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মালিকানা বদল হওয়া ইসলামী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে দ্বিগুণের বেশি। আওয়ামী লীগ ঘনিষ্ঠ শিল্পগোষ্ঠী বেক্সিমকো, এস আলম, বসুন্ধরা গ্রুপসহ আরো অনেকের ঋণও খেলাপি হয়ে পড়েছে। ফলে গত জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে সব মিলিয়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা। এতে সেপ্টেম্বর শেষে খেলাপি ঋণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ ৮৪ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ১৬ দশমিক ৯৩ শতাংশ।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত দেড় দশকে দেশের ব্যাংক খাতে নজিরবিহীন অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি ও লুণ্ঠন হয়েছে। ঋণের নামে অনেক ব্যাংক থেকে আমানতকারীদের অর্থ লুটেছেন ঋণখেলাপিরা। সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট ব্যবসায়ীরা ব্যাংক থেকে বাছ-বিচার ছাড়াই ঋণের নামে অর্থ হাতিয়েছেন। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পর ব্যাংক খাত লুটের ক্ষতগুলো ফুটে উঠতে শুরু করেছে। এ কারণেই খেলাপি ঋণ এতটা নাজুক পরিস্থিতিতে ঠেকেছে। তথ্য বলছে, চলতি বছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোতে খেলাপি ঋণের যে হার দাঁড়িয়েছে, তা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের মোট ঋণের প্রায় ১৭ শতাংশই এখন খেলাপি। ভারত, পাকিস্তান ও এমনকি শ্রীলঙ্কার খেলাপি ঋণের হার এত বেশি নয়।

অর্থনীতিবিদদের মতে, খেলাপিদের পকেট থেকে টাকা আদায় না করে খাতা-কলমে কম দেখানোর উদ্যোগ ব্যাংকগুলোকে প্রকৃতপক্ষে ক্ষতির মধ্যে ফেলেছে। নিয়ম মেনে ঋণ না দেয়ার কারণেই ঋণগুলো খেলাপি হয়েছে। ঋণের টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ব্যাপকহারে পুনঃতফসিলের কারণে ব্যাংকের লাভ বেড়েছে। খেলাপি হলে আয় দেখাতে পারতো না উল্টো অন্য আয়ের টাকা আটকে যেত। বিশেষ ছাড় দেয়ার কারণে নিয়মিত হওয়ায় খেলাপি ঋণের বিপরীতে ব্যাংকগুলো আয় দেখাতে পেরেছে। অর্থাৎ নিজের টাকা পরের পকেটে রেখেই কাগুজে লাভ দেখিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ব্যাংক খাতে সংস্কার ও নানা উদ্যোগের মধ্যেও খেলাপি ঋণ আরো বেড়েছে। অর্থবছরের প্রথম প্রান্তিকে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে তিন মাসে এই অঙ্ক বেড়েছে প্রায় ৭৪ হাজার কোটি টাকা, যা আগের তিন মাসের তুলনায় আড়াই গুণেরও বেশি।

আরো পড়ুন: ডলারের দরে বড় লাফ

খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র হুসনে আরা শিখা বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি ঋণ হিসাবে জন্য নতুন একটি পদ্ধতি ব্যবহার করছে,

যেটি বিশ্বব্যাপী সর্বোত্তম পদ্ধতি বলে গৃহীত হয়েছে। নতুন পদ্ধতিতে মেয়াদি ঋণের গ্রেস পিরিয়ড আগের ছয় মাস থেকে কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা ধরে নিচ্ছি, জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপি ঋণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে এটি একটি কারণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিক বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর বড় রকমের নীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। তিনি বলেন, ২০১৯ সালে ঋণের হিসাব গণনায় বিশেষ এক ধরনের সুবিধা দেয়া হয়। অনেকগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ঋণ কিস্তি পরিশোধের শেষ তারিখ থেকে ছয় মাস পর্যন্ত গণনা করা হত না। আইএমএফের সঙ্গে আলোচনার সাপেক্ষে সেটি কমিয়ে তিন মাস করা হয়েছে। আগামী বছরের মার্চে এটি কিস্তি পরিশোধের সময় শেষ হওয়ার পরের দিন থেকেই করা হবে। এই পরিবর্তনের কারণেই বকেয়া কিস্তিগুলো খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছে। যদি আগের নীতি বলবৎ থাকত, তাহলে খেলাপি ঋণ এত বাড়ত না। এ ছাড়া, কিছু প্রতিষ্ঠান তাদের খেলাপি ঋণ নিয়ে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছিল। এসব ঋণের একটি অংশ খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এটাও খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন শাহরিয়ার সিদ্দিক।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বিগত সরকারের আমলে ছাড় দিয়ে পুনঃতফসিল, সুদ মওকুফ ও অবলোপনের মাধ্যমে খেলাপি ঋণ কমানো হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঋণগ্রহীতার পকেট থেকে টাকা ব্যাংকের ভল্টে ফেরত আসেনি; কিন্তু ব্যাংকের আয় বাড়ছে বলে দেখানো হয়েছে। ফলে অন্তর্নিহিত দুর্বলতাগুলো থেকেই গেছে। প্রকৃত তথ্য আড়াল করার ফলে দুর্বলতা এতদিন চোখে পড়েনি। এখন ধীরে ধীরে তা দৃশ্যমান হচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য থেকে জানা গেছে, গত তিন মাসেই ৭৩ হাজার ৫৮৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩৪ দশমিক ৮ শতাংশ বেড়েছে। গত বছরের সঙ্গে তুলনা করলে আরো ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। গত বছরের একই সময়ের চেয়ে এ বছর খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ৮৩ দশমিক ৪ শতাংশ। মূলত, এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ ও বসুন্ধরা গ্রুপসহ কিছু বড় ঋণগ্রহীতা আওয়ামী লীগের পতনের পর ব্যাপক ঋণখেলাপি করেছে, যা মোট খেলাপি ঋণের পরিমাণ রেকর্ড পরিমাণে বাড়িয়ে দিয়েছে। জনতা ব্যাংকের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ব্যাংকটি থেকে নেয়া বেক্সিমকো গ্রুপের ২৩ হাজার কোটি টাকার ঋণের মধ্যে ১৯ হাজার কোটি টাকা জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান ছিলেন শেখ হাসিনার শিল্প ও বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা। জুলাই-সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে জনতা ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের নেয়া ঋণের মধ্যে প্রায় আট হাজার কোটি টাকা খেলাপিতে পরিণত হয়েছে। ফলে সেপ্টেম্বর শেষে জনতা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা ব্যাংকিংখাতে সর্বোচ্চ। বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান আইএফআইসি ও রূপালী ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণের মধ্যে ৪১৬ কোটি টাকা খেলাপি হয়েছে।

আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার পর শরিয়াহভিত্তিক কিছু ব্যাংকসহ যেসব ব্যাংকের বোর্ড পুনর্গঠন করা হয়েছে, সেগুলোর বেশির ভাগেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে।

আরো পড়ুন: ব্যাংকিং ডিপ্লোমা পাস বাধ্যতামূলক রেখেই জিএম পদে পরীক্ষা

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, বিগত সরকারের ১৫ বছরে ঋণখেলাপি ও প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একের পর এক ছাড় দেয়া হয়েছে। একদিকে বিশেষ বিশেষ গ্রাহককে বেশি ঋণ দিতে আইন শিথিল করা হয়েছে, অন্যদিকে আইনে পরিবর্তন আনা হয়েছে খেলাপিদের ঋণ দিতে। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে তৎকালীন সরকার খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা শিথিল করে। সালমান এফ রহমানের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৫ সালে ঋণ পুনর্গঠন সুবিধা দেয়া হয়। ঋণ অবলোপনের ক্ষেত্রেও দেয়া হয় বিশেষ ছাড়। ২০১৯ সালে ২ শতাংশ অর্থ দিয়ে ঋণ নিয়মিত করার বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়।

এরপর করোনা মহামারী শুরু হলে সব ধরনের গ্রাহককে ঋণ পরিশোধ না করার সুবিধা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে কিছু ভালো ঋণগ্রহীতাও ঋণ পরিশোধে অনাগ্রহী হয়ে ওঠে। সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যোগ দিয়ে ঋণখেলাপিদের ঢালাও ছাড় দিয়ে নতুন নীতিমালা জারি করেন। আড়াই থেকে সাড়ে ৬ শতাংশ অর্থ জমা দিয়ে খেলাপি ঋণ নিয়মিত করার সুযোগ দেয়া হয়। খেলাপি ঋণ নিয়মিত করতে আগে জমা দিতে হতো ১০ থেকে ৩০ শতাংশ পর্যন্ত অর্থ। এর পাশাপাশি খেলাপি ঋণ পাঁচ থেকে আট বছরে পরিশোধের সুযোগ রাখা হয়। আগে এসব ঋণ শোধ করতে সর্বোচ্চ দুই বছর সময় দেয়া হতো। এর ফলে খেলাপি হয়ে পড়া ঋণ আড়াল করার সুযোগ আরো বেড়ে যায়। পাশাপাশি প্রভাবশালীদের মালিকানায় থাকা ব্যাংক ও তাদের ঋণ আদায় না হলেও দীর্ঘদিন খেলাপি দেখানো হতো না, যা এখন খেলাপির খাতায় যুক্ত হচ্ছে।

অর্থনীতি সংক্রান্ত শ্বেতপত্র প্রণয়ন জাতীয় কমিটির প্রধান ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, যার নজরদারি করার কথা ছিল, তিনি এর বারোটা বাজিয়ে চলে গেছেন। শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান বলেন, অলিগার্করা ব্যাংকিং কিংবা জ্বালানি খাত থেকে শুরু করে পুঁজিবাজার এবং সম্ভবত অফশোর ব্যাংকিং ও অবৈধভাবে অর্থ পাচারের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করেছে। তারা বাংলাদেশের দুই ফুসফুস- আর্থিক খাত ও জ্বালানি খাত খেয়ে ফেলেছে। তারাই ব্যাংক লুট করেছে, পুঁজিবাজার লুট করেছে, অবৈধপথে বিদেশে অর্থ পাঠিয়েছে। তারাই মেগা প্রকল্পের ঠিকাদার। আর্থিক খাতের লুটপাটে কীভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে ব্যবহার করা হয়েছে, তা নিয়ে কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। সাবেক গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদারের নাম উল্লেখ না করে তিনি বলেন, যার নজরদারি করার কথা ছিল, তিনি এর বারোটা বাজিয়ে চলে গেছেন। যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নজরদারি করার কথা, তারাই সবচেয়ে বড় সমস্যার সৃষ্টি করেছে।

সাবেক গভর্নরের বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, দিনের বেলা বলেছেন- আইএমএফের (আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল) কথা মতো কাজ করছি, রাতের বেলা টাকা ছাপিয়েছেন। একদিকে বলেছেন আইন করছি; অন্যদিকে অব্যাহতি দিয়েছেন বিভিন্ন কোম্পানিকে। একদিকে বলছেন- রিজার্ভ ঠিক আছে, অন্যদিকে রিজার্ভে আসলে ওই টাকা নেই। হিসাবে গন্ডগোল। তিনি আরো বলেন, মাসোহারা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতর লোক রেখেছিল অলিগার্করা। এটা তো এখন প্রকাশ্য হচ্ছে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App