সুতোয় ঝুলছে রাষ্ট্রপতির ভাগ্য

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন
রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ নিয়ে ধোঁয়াশা এখনো কাটেনি। সাংবিধানিক শূন্যতার ‘আশঙ্কায়’ শেখ হাসিনা সরকারের মনোনীত রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে রাজি হয়নি বিএনপি। এদিকে বিএনপির কালক্ষেপণের কৌশলেও রাষ্ট্রপতিকে সরাতে অনড় অবস্থানেই রয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। আর রাষ্ট্রপতি অপসারণে ‘রাজনৈতিক ঐকমত্যের’ অপেক্ষায় রয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। অন্তর্বর্তী সরকার এবং ছাত্র নেতৃত্বের সূত্রমতে, অভ্যুত্থানের সব শক্তির ঐক্যের স্বার্থে বিএনপিকে রাজি করাতে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চলবে। তা সফল না হলেও সাহাবুদ্দিনকে বঙ্গভবনছাড়া করার প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে। অন্যদিকে রাষ্ট্রপতির অপসারণে রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য ছাত্রনেতারা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন।
রাষ্ট্রপতি অপসারণে ইতোমধ্যেই উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ওপর ভিত্তি করে এই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে একমত পোষণ করেছে উপদেষ্টা পরিষদ। আর এজন্য বিএনপি নেতাদের নিজেদের মধ্যেসহ রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। উপদেষ্টারা জানিয়েছেন, বিএনপি সংকট মনে করলেও কিছু কিছু দল মনে করছে রাষ্ট্রপতি অপসারণে সাংবিধানিক সংকট তৈরি হবে না।
এই ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে জামায়াত ও ইসলামী আন্দোলন। রাষ্ট্রপতির অপসারণে রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রেখেছে ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার সন্ধ্যায় গুলশানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে বৈঠক করেন মুহাম্মদ নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, আখতার হোসেন, হাসনাত আবদুল্লাহ, আরিফ সোহেলসহ জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শীর্ষ নেতারা।
গতকাল রবিবার এসব বিষয় নিয়ে ১২ দলীয় জোট ও গণঅধিকার পরিষদের সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতি অপসারণে নীতিগতভাবে সবাই একমত পোষণ করেছেন বলে জানিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ।
রাজনৈতিক ঐকমত্যেই সিদ্ধান্ত : রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন থাকবেন কী থাকবেন না, এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। তিনি বলেন, ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এ নিয়ে যখন সিদ্ধান্ত হবে, তখন প্রক্রিয়াও গঠন করা হবে।
গতকাল রবিবার সকালে সচিবালয়ে বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে পাটজাত পণ্যে মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০ এর বাস্তবায়ন-সংক্রান্ত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির অপসারণ’ অনেক বড় একটা সিদ্ধান্ত। তাই এটা নিয়ে তাড়াহুড়োর যেমন সুযোগ নেই, আবার বেশি দেরি করারও সুযোগ নেই। রাষ্ট্রপতির অপসারণ বা পদত্যাগ যেটাই হোক না- তা নিয়ে যখন ঐকমত্য তৈরি হবে, তখন সিদ্ধান্তটাও ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই হবে। সংসদ নেই বা স্পিকার নেই- সেই প্রশ্ন তখন থাকবে না। সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা হলে সংকট সৃষ্টি হবে বলে মনে করছে বিএনপি। কেউ কেউ মনে করছে এতে কোনো সংকট সৃষ্টি হবে না। তবে, রাষ্ট্রপতির অপসারণ বিষয়ে সরকারের অবস্থান হচ্ছে, এ বিষয়ে রাজনৈতিক ঐক্যমত্য সৃষ্টি করা হবে।
উপদেষ্টা বলেন, রাজনৈতিক ঐক্যমত্যের ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত নেয়া হবে রাষ্ট্রপতি থাকবেন নাকি থাকবেন না। ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এ বিষয়ে যখন সিদ্ধান্ত হবে, তখন প্রক্রিয়াও গঠন করা হবে। তিনি বলেন, বিপ্লব-পরবর্তী এই সরকারের আদলের সঙ্গে বর্তমান রাষ্ট্রপতি যান না। কেননা তিনি ফ্যাসিস্ট সরকারের অংশ। তাই রাষ্ট্রপতি পদে থাকতে পারেন না। এ ইস্যুতে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানান এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, রাজনৈতিক ঐকমত্য যেহেতু গড়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, ওই পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
আর রাষ্ট্রপতির বিষয়টা এমন- এখানে গোপনে সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ নেই। যখন একটা সিদ্ধান্ত হবে, সেটা হবে প্রকাশ্যে। আওয়ামী লীগের আমলে রাষ্ট্রপতি হওয়া মো. সাহাবুদ্দিনের কাছে শপথ নেয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নবিদ্ধ হয় কিনা, এমন প্রশ্নের উত্তরে রিজওয়ানা হাসান বলেন, প্রশ্নবিদ্ধ হয় না। ডকট্রিন অব নেসেসিটি বলে একটা কথা শুনেছেন- এটা পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠিত একটা মতবাদ; সাংবিধানিক ধারাবাহিকতাই ছিল আমাদের একমাত্র অপশন। তখন তাই প্রয়োজন ছিল। আর কেউ আলোচনারও সুযোগ পায়নি যে কার কাছে শপথ নেয়া হবে।
হঠকারী সিদ্ধান্ত চায় না বিএনপি : ছাত্রনেতাদের সঙ্গে বৈঠকের পর আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানায়নি বিএনপি। দলীয় সূত্র জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের চেয়ে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন নিশ্চিতেই আগ্রহ তাদের। এদিকে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না বলে গতকাল মন্তব্য করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। যুবদলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের কবরে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে গণমাধ্যমকে এ কথা বলেন তিনি।
কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সব কাজ করা উচিত বলে মন্তব্য করে মির্জা ফখরুল বলেন, গণঅভ্যুত্থানের ফসল ঘরে তোলার জন্য বাংলাদেশের বিপ্লবকে যদি সংহত করতে হয়, তাহলে হঠকারী সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে না। সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় সব কাজ করা প্রয়োজন। রাষ্ট্রপতির অপসরণের দাবিতে বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা এভাবে কিছু বলব না। আমাদের ফোরাম আছে, সেখানে আলোচনা হবে। আমাদের স্থায়ী কমিটির মিটিং হবে, সেখানে আলোচনার পর আমরা আমাদের অবস্থান পরিষ্কার করব।
রাষ্ট্রপতি অপসারণে নীতিগতভাবে সবাই একমত : রাজনৈতিকভাবে সবাই চাইছেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ করতে, তবে কোন প্রক্রিয়ায় হবে, তা নিয়েই আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ। গতকাল রবিবার খিলগাঁও চৌধুরী পাড়ায় জাতীয় পার্টির কাজী জাফর অংশের চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দারসহ ১২ দলীয় জোটের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক শেষে এমন তথ্য জানান তিনি। হাসনাত বলেন, রাষ্ট্রপতিকে চলে যেতে হবে, এ বিষয়ে সবাই নীতিগতভাবে একমত।
তবে চলে যাওয়া বা অপসারণের প্রক্রিয়া কী হবে সে বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিকভাবে ঐকমত্যের দরকার আছে। তিনি বলেন, বিএনপি, ১২ দলীয় জোট, জামায়াতসহ বিভিন্ন দল ও সংগঠনের সঙ্গে আমাদের আলোচনা চলছে। আমরা চাই সবাই একমত হয়ে একটি সিদ্ধান্ত যেন আসে। আমরা এ বিষয়ে জনমত তৈরিতে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি। সাংবিধানিক সংকট তৈরির পাঁয়তারা চলছে বিএনপি নেতাদের এমন বক্তব্যের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ ইস্যুতে বিএনপির সাংগঠনিক বক্তব্যের জন্য অপেক্ষা করব।
এর আগে বিকাল ৪টায় ১২ দলীয় জোটের চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা বৈঠকে বসেন। ১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র মোস্তফা জামাল হায়দার বলেন, অনেকগুলো বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রপতির অপসারণ। নীতিগতভাবে তার অপসারণে ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে ১২ দল। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়া এই প্রশ্নে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমান সরকার অনেক ক্ষেত্রে সফল হলেও বাজার পরিস্থিতিসহ বেশ কিছু জায়গায় তারা ব্যর্থ হচ্ছে। তারা ব্যর্থ হলে দেশ ও জাতি ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হবে। জোট মুখপাত্র বলেন, ১২ দল চায় বিএনপিসহ সব রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে একমত হোক।
বৈঠকে ১২ দলীয় জোটের নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন- ১২ দলীয় জোটের প্রধান ও জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর) চেয়ারম্যান মোস্তফা জামাল হায়দার, এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাৎ হোসেন সেলিম, জাতীয় দলের চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট সৈয়দ আহসানুল হুদা, বাংলাদেশ লেবার পার্টির চেয়ারম্যান লায়ন মোহাম্মদ ফারুক রহমান, ইসলামিক ঐক্যজোটের মহাসচিব প্রফেসর আব্দুল করিম। অপরদিকে, ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ, সমন্বয়ক সারজিস আলম, জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাছির উদ্দিন পাটোয়ারী, মুখপাত্র সামান্তা শারমিন, নাগরিক কমিটির পলিটিক্যাল অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি আদিব মমিন আরিফ, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখ্য সংগঠক আব্দুল হান্নান মাসুউদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ব্রিফিংয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরউদ্দিন পাটওয়ারী বলেন, বিএনপিকে আহ্বান জানাব জনগণের পাল্স বুঝুন। প্রেসিডেন্ট হাউসে যে গোখরা সাপ বসে আছে, তাকে বিদায় করতে সহযোগিতা করুন। গত তিনটি নির্বাচন অবৈধ ঘোষণার বিষয়ে ১২ দলীয় জোট একমত হয়েছে বলেও জানান তিনি।
অপসারণে অনড় ছাত্রনেতারা : রাষ্ট্রপতিকে অপসারণে সরকারের অনড় অবস্থান প্রকাশ পেয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদের বক্তব্যেও। রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্য না হলেও মো. সাহাবুদ্দিনকে সরানো হবে বলে আভাস দিয়ে তিনি নিজের ফেসবুক ভেরিফায়েড অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘৮ দিবস বাতিল কিংবা ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের মতো রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও উপদেষ্টা পরিষদ অকপটে নিয়েছে, যাদেরকে অনেকেই অভ্যুত্থানের চেতনা ধারণ করে না বলে অপবাদ দিচ্ছেন।
অন্যদিকে প্রমিনেন্ট রাজনৈতিক দলকেও আওয়ামী লীগের অ্যাডভোকেসি করতে দেখা গেছে, ফ্যাসিবাদের সর্বশেষ আইকনকে সরানোর ক্ষেত্রেও অনীহা দেখা গেছে।’ আর শনিবার বিএনপির সঙ্গে বৈঠক শেষে ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহ বলেন, ফ্যাসিবাদ বিলুপ্ত করার পথে আমাদের সামনে এখন একটি বাধা- রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু।
গত ২৩ অক্টোবর আমরা জাতীয় ঐক্যের ডাক দিয়েছিলাম। এছাড়া আমাদের নতুন যে রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তা নিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছি। আজকে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছি। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে কীভাবে দ্রুততম সময়ে অপসারণ করা যায় এবং কীভাবে রাজনৈতিক সংকট দূর করা যায়- তা নিয়ে কথা বলেছি। হাসনাত জানান, রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে জামায়াতের সঙ্গেও তাদের বৈঠক হয়েছে, জামায়াত একমত পোষণ করেছে। একই ইস্যুতে আমরা ইসলামী আন্দোলনের সঙ্গেও বৈঠক করেছি। তারাও নৈতিকতার জায়গা থেকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ চায়।