পুঁজিবাজার পরিস্থিতি
বিনিয়োগকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলায় সূচকে ধারাবাহিক ধস

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

পুঁজিবাজারের সূচক নিম্নমুখী অবস্থানে দুই মাস ধরেই। যদিও আগস্টের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর সূচকের সাময়িক উত্থান হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তীতে তা দ্রুত নেমে যায়। গতকাল রবিবার সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসেও ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের বেঞ্চমার্ক সূচক (ডিএসইএক্স) ১৪৯ পয়েন্ট (দুই দশমিক ৯১ শতাংশ) কমে ৪ হাজার ৯৬৫ এ বন্ধ হয়েছে, যা প্রায় চার বছরে দেখা যায়নি।
২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর শেষবার সূচকের এমন পতন হয়েছিল। সে সময় এটি ৪ হাজার ৯৩৪ পয়েন্টে নেমেছিল। গতকাল লেনদেনও কিছুটা কমে গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৩০১ কোটি টাকায়। শেয়ারবাজারের এমন ধারাবাহিক পতনের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকরা। এর মধ্যে ব্যাংকিং খাতে উচ্চ সুদের হার, মার্জিন ঋণের বিপরীতে কেনা শেয়ার বিক্রি, একের পর এক শ্রমিক অসন্তোষ ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যাওয়াকে দায়ী করেছেন বিশ্লেষকরা।
জানতে চাইলে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ ভোরের কাগজকে বলেন, ট্রেজারি বন্ডের সুদ বেড়েছে অনেক। অনেক বড় বিনিয়োগকারী মার্কেট থেকে শেয়ার বিক্রি করে ট্রেজারি বন্ড কিনেছেন। গত এক বছর ধরেই এ কাজ চলছে। পুঁজিবাজার অস্থির হওয়ার এটা অন্যতম প্রধান কারণ। তিনি বলেন, ফোর্সসেল করার কারণে মার্কেট নিচের দিকে গেছে।
ব্রোকার হাউসগুলো শেয়ার বিক্রি করে দিয়েছে। ফলে সাপ্লাই বেশি হয়েছে, ডিমান্ড সে তুলনায় কম হয়েছে। আবু আহমেদ বলেন, ডিমান্ড করার জন্য অর্থের প্রয়োজন। সুদের হার বাড়ার কারণে বড় ইনভেস্টররা ট্রেজারি বন্ডে চলে গেছে। বিএসইসির এই মুহূর্তে মার্জিন একাউন্টগুলোতে সুদ হার বাড়ানো বন্ধ রাখা দরকার। কিছু সুদ মওকুফ করেও দিতে পারে। যেহেতু বিনিয়োগকারীরা লাভ করতে পারেননি, উল্টো তারা বিপদে আছেন। তাই সুদ মওকুফ করলে তারা কিছুটা হলেও লাভবান হবেন বলে জানান তিনি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরী ভোরের কাগজকে বলেন, আমাদের পুঁজিবাজারে দরপতন বিভিন্ন সময়েই ঘটেছে, এখনো ঘটছে। তবে এবারে যেন বেশিই হচ্ছে। তিনি বলেন, বরাবরই কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যারা পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রণ করে, তারা নিজেদের স্বার্থে সূচক কখনো বাড়ায়, কখনো কমায়। এটা চলমান থাকলে পুঁজিবাজার কখনো উন্নতি হবে না। তাই বর্তমান সরকারের উচিত বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে দেখা এবং এর প্রতিকার করা।
বাজারে কথিত আছে, দরবেশখ্যাত সালমান এফ রহমান আতঙ্কে দীর্ঘ ১৬ বছর পতনে নিমজ্জিত ছিল দেশের শেয়ারবাজার। সরকার পরিবর্তনের পর শেয়ারবাজারকে সামনের দিকে এগিয়ে নিতে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয় খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে। বাজারকে পতন থেকে স্বাভাবিক গতিতে ফেরাতে বাজার-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করলেও সব সাপোর্ট ভেঙে শেয়ারবাজারের সূচক ৫ হাজার পয়েন্টের নিচে নেমেছে।
এর ফলে শেয়ারবাজার দীর্ঘ চার বছর পেছনের অবস্থানে চলে গেছে। খন্দকার রাশেদ মাকসুদ বিএসইসির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেয়ার পর গত ১৮ আগস্ট ডিএসইর সূচক ১২৫ পয়েন্ট কমে। গত ২৪ অক্টোবর পর্যন্ত এটিই ছিল মাকসুদ কমিশনের দায়িত্ব নেয়ার সময়ে সর্বোচ্চ পতন। মাকসুদ কমিশন বিএসইসির দায়িত্ব নেয়ার পর শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল
অবস্থায় ফেরাতে দফায় দফায় স্টেকহোল্ডার থেকে শুরু করে বাজার সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে যাচ্ছেন। এতেও কাজ হচ্ছে না। পুঁজিবাজার পতনে হাহাকার দেখা যাচ্ছে বিনিয়োগকারীদের মাঝে। শেয়ারবাজারে অব্যাহত বড় পতনের কারণে বিনিয়োগকারীরা নিঃস্ব হয়ে গেছেন। শেয়ারবাজারকে স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে বিনিয়োগকারীরা বিভিন্ন সময় আন্দোলনও করেছেন।
বাজার পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স মাত্র চার দিনের ব্যবধানে ৭৮৬ পয়েন্ট বা ১৫ শতাংশ বেড়েছিল। কিন্তু এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে কমছে সূচক। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (সিএসই) সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবস রবিবার সূচকের বড় পতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। এদিন ডিএসইতে আগের কার্যদিবসের চেয়ে টাকার পরিমাণে লেনদেন কমলেও সিএসইতে সামান্য বেড়েছে।
একইসঙ্গে ডিএসই ও সিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার এবং মিউচুয়াল ফান্ডের ইউনিটের দাম কমেছে। এদিকে পুঁজিবাজারের ধারাবাহিক পতনের প্রতিবাদে গতকাল দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের আহ্বানে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন বিনিয়োগকারীরা। এ সময় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার পতন রোধে তাৎক্ষণিক করণীয় হিসেবে ১০টি দাবি পেশ করেন।
বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই মুহূর্তে শেয়ারবাজারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে পড়েছে বিনিয়োগকারীরা। শুধু শেয়ারবাজার নয়; নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ মার্কেট মেকার, ডিএসই, সিএসই, সিডিবিএলসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের প্রতিও বিনিয়োগকারীরা তাদের আস্থা হারিয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার নানামুখী চেষ্টার পরও প্রতিনিয়তই নিঃস্ব হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া শেয়ারবাজার উন্নয়নে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফোর্সসেল। বাজারে অব্যাহত পতনে বেশ কিছু শীর্ষ সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংক তাদের নিজেদের টাকা তুলে নিতে মার্জিন অ্যাকাউন্টের শেয়ার বিক্রি করে দিচ্ছেন। এই ফোর্সসেলের কারণে শেয়ারবাজারে অতিরিক্ত বিক্রির চাপ পড়ছে। এতে পতন থেকে বের হতে পারছে না শেয়ারবাজার। অন্যদিকে সিকিউরিটিজ হাউস ও মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েই ফোর্সসেলের রাস্তা বেছে নিয়েছে। তবে এর থেকে বের হতে প্রয়োজন নতুন বিনিয়োগ এবং যুগপোযোগী সিদ্ধান্ত।
জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম বলেন, পুঁজিবাজার মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধানতম চালিকাশক্তি। কিন্তু বিভিন্ন অনিয়ম এবং নীতি অসঙ্গতির কারণে বাংলাদেশের পুঁজিবাজার এযাবতকালে অর্থনীতিতে কাক্সিক্ষত ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়েছে। তিনি বলেন, বর্তমানে পুঁজিবাজারের কাঠামোগত সংস্কারে বাংলাদেশ সরকার, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন, ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জসহ সব বাজার মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো একযোগে কাজ করছে। আশা করা যায় সব সংস্কার কার্যক্রমের সফল সম্পাদন এবং পরিপূরক নীতিসহায়তার মাধ্যমে দেশের পুঁজিবাজার শিগগিরই একটি দৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে সক্ষম হবে এবং দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখা শুরু করবে।
আস্থাহীনতার কারণ সম্পর্কে নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক ব্রোকারেজ হাউসের শীর্ষ নির্বাহী বলেন, পুনর্গঠিত বিএসইসির পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত যত ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, সবই সংস্কারকে কেন্দ্র করে। এসব পদক্ষেপের সুফল হয়তো পাওয়া যাবে দীর্ঘ মেয়াদে। কিন্তু বিদ্যমান বাজার পরিস্থিতিতে স্বল্পমেয়াদি কোনো পদক্ষেপই দৃশ্যমান নয়। ফলে বিনিয়োগকারীদের আস্থায় চিড় ধরেছে।
এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসএসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র রেজাউল করিম বলেন, বিএসইসি আন্তরিকভাবে পুঁজিবাজারের উন্নয়নে কাজ করছে। এটা ঠিক দরপতন অনেকটা দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অনেক শেয়ারের দাম অযৌক্তিক অবস্থানেরও নিচে নেমেছে। সমস্যা তৈরি হয়েছে, উচ্চ সুদহার, মূল্যস্ফীতি এবং মুদ্রার বিনিময় হার। বড় বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের চেয়ে ব্যাংকে আমানত রাখায় বা ট্রেজারি বন্ডে বিনিয়োগে বেশি নিরাপদ মনে করছেন। তবে এখন শেয়ারের দর কমে আশায় কৌশলীরা বিনিয়োগে ফিরবেন বলে আশা করা যায়। তিনি আরো বলেন, আগের কমিশনের সঙ্গে বর্তমান কমিশনের কর্মপন্থায় সুস্পষ্ট পার্থক্য আছে। এ কমিশন বাজারে হস্তক্ষেপ করতে চায় না, করবেও না। বাজারকে নিজে থেকে সামাল দিতে শিখতে হবে। আইসিবির মাধ্যমে তারল্য সহায়তা দিতে সরকারকে অনুরোধ করা হয়েছে।