×

প্রথম পাতা

বাজারের উত্তাপ: গরিবের পাতে পুষ্টির ঘাটতি

Icon

সেবিকা দেবনাথ

প্রকাশ: ২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

বাজারের উত্তাপ: গরিবের পাতে পুষ্টির ঘাটতি
   

গোপীবাগ-মানিকনগর এলাকায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন ইয়াসমিন বেগম। রিকশাচালাক স্বামী ও ৩ সন্তান নিয়ে ইয়াসমিন থাকেন মানিকনগর এলাকার এক রুমের একটি বাসায়। ৪ বাসায় কাজ করে ইয়াসমিনের মাসিক আয় ৮ হাজার টাকা। স্বামীর দৈনিক রোজগার গড়ে হাজার থেকে ১২০০ টাকা। এক্ষেত্রে সমস্যা হলো- একদিন পরপর রিকশা চালানোর সুযোগ পান তার স্বামী। ইয়াসমিন জানান, প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া ও সন্তানের পড়াশোনার জন্য খরচ করার পর এই ৫ জনের খাবার নিশ্চিত করতে রীতিমতো যুদ্ধ করতে হচ্ছে।

ইয়াসমিন বলেন, ‘আমরা দুইজন মিলে প্রতি মাসে ২৭ থেকে ২৮ হাজার টাকা রোজগার করি। কারেন্ট ও গ্যাস বিল মিলায়ে বাসা ভাড়া ৯ হাজার টাকা। ৩ সন্তানের পড়াশোনায় ৭ হাজার টাকা। ৫ জন মানুষের খাওয়া খরচের জন্য হাতে থাকে ১০/১২ হাজার টাকা। এই বাজারে এই টাকা দিয়া সংসার চলে? চালের দামও বাড়া। মাছের মধ্যে পাঙাশ আর তেলাপিয়া; এখন ওই মাছও কিনতে পারি না। ডিমের কথা আর কি কমু? দোকানে ভাঙা ডিম কম দামে পাওয়া যায়। ওইটাই এক হালি করে কিনে পোলাপাইনরে খাওয়াই। আর তরকারি-শাকতো এখন বড়লোকের খাওয়া। আমাগো মতো গরিবের ৩ বেলা খাওয়া জুটানোই এখন কষ্টের।’

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সুশান্ত সাহা। দুই সন্তান, বৃদ্ধ মা আর স্ত্রীকে নিযে থাকেন কমলাপুর। সুশান্ত বলেন, বেতন পাওয়ার পরই বাসা ভাড়া, সন্তানদের স্কুল-টিউশন ও যাতায়াতের খরচের টাকাটা আলাদা করে রাখি। মায়ের ওষুধ, চাল-ডাল-তেল এইপণ্যগুলো কিনে ফেলি। এরপর হাতে যে টাকা থাকে তা দিয়ে একজনের রোজগারে সংসার চালানো আসলেই অসম্ভব। মাছ-মাংস খাওয়া কমাতে হয়েছে। মাছের টুকরাও ছোট করতে হচ্ছে। দুধ-ডিম খাওয়াও অনিয়মিত হয়েছে। অসহায় লাগে।

ইসলামপুর এলাকার ব্যবসায়ী মো. নাজমুল হক বলেন, ব্যবসার অবস্থাও খুব ভালো নয়। বিগত কয়েক বছরে যেভাবে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে তাতে এখন চাল, ডাল, তেল, নুন কিনতেই পকেট ফাঁকা হয়ে যায়। সেখানে পরিবারকে একটু মাছ-মাংস কিংবা ডিম-দুধ-ফল খাওয়ানো কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। এখন তো ডাল-ভাত, সবজি, কম দামের মাছ খেয়ে দিন কাটানোও ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। পণ্যের দামে ঊর্ধ্বমুখী গতির সঙ্গে ছুটতে গিয়ে ইয়াসমিন, সুশান্ত ও নাজমুলের মতো স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের টিকে থাকাই দিন দিন কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে পড়ছে। পাত থেকে বাদ পড়ছে প্রয়োজনীয় অনেক খাবার।

পুষ্টিকর খাবার বলতে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় ছয় ধরনের খাদ্য উপাদানের সমন্বয়কে বোঝায়। এর মধ্যে রয়েছে- শর্করা, আমিষ, ভিটামিন, খনিজ, পানি ও চর্বি। পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একজন মানুষের প্রতিদিনের খাবারে ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ শর্করা, ১৫ শতাংশ প্রোটিন ও ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ স্নেহজাতীয় খাবার প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় হলে স্বাভাবিকভাবেই তা স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলবে। সুষম খাবারের ঘাটতি হলে তা সরাসরি শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদে কর্মদক্ষতা ও উৎপাদনশীলতার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

ইউএসএআইডি বলছে, বাংলাদেশে ৫০ শতাংশ গর্ভবতী মা ও শিশু আগে থেকেই পুষ্টিহীনতায় ভুগছেন। লাগামহীন দাম বাড়ার কারণে নি¤œ আয়ের মানুষ খাবারের পরিমাণ কমালে সামনে পুষ্টিহীনতার অবস্থা আরো বাড়তে পারে। আমাদের দেশে গরিবের প্রোটিন বলা হয় ডিম ও দুধকে। কিন্তু এসব পণ্য ধরাছোঁয়ার বাইরে চলে যাওয়ায় এর প্রভাব পড়ছে নি¤œ আয়ের পরিবারের শিশু-কিশোরদের ওপর।

জুন মাসে ‘শৈশবকালীন খাদ্য সংকট: প্রারম্ভিক শৈশবে পুষ্টি বঞ্চনা’ শীর্ষক ইউনিসেফের নতুন এক প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ৩ মজন শিশুর মধ্যে ২ জনই সুষম খাদ্য সংকটের মধ্যে বাস করে। ইউনিসেফ বলছে, শৈশবকালীন পর্যাপ্ত সুষম খাবারের ঘাটতি সব শিশুর ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে, তবে এর বিশেষ প্রভাব দেখা যায় শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশে।

দেশে শৈশবকালীন সুষম খাদ্যের সংকট বাড়ার পেছনের কারণগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- পুষ্টিকর খাদ্য কেনায় পরিবারের ক্ষমতার অভাব, শিশুকে পুষ্টিকর খাবার খাওয়ানো সম্পর্কে বাবা-মায়ের সচেতনতার অভাব। ইউনিসেফ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বিশ্বব্যাংকের যৌথভাবে করা ‘শিশু অপুষ্টির মাত্রা ও প্রবণতা’ শীর্ষক বৈশ্বিক একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে ৫ বছরের কম বয়সি ২৬ শতাংশ শিশু খর্বকায়। অপুষ্টির আরেকটি সূচক কৃশতা। প্রতিবেদন বলছে, দেশের ৫ বছর কম বয়সী ৯ দশমিক ৮ শতাংশ শিশু কৃশকায়।

চলতি বছরের মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময়ে বিশ্বব্যাংকের রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) জানিয়েছিল, পণ্যের দাম বেশি হওয়ার কারণে দেশের ১২ কোটি ৫২ লাখ মানুষ প্রয়োজনীয় পুষ্টিকর খাবার খেতে পারছে না। এটি ছিল ২০২১ সালের হিসাব। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমানে এই সংখ্যা আরো বেড়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (এসডিজি) ২ নম্বর লক্ষ্যমাত্রায় পুষ্টির বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা, খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া- এই বিষয়গুলো ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ঝুঁকি তৈরি করছে।

বাংলাদেশ নিউট্রিশন অ্যান্ড ডায়েটেটিকস ফোরামের (বিএনডিএফ) সভাপতি এবং বারডেম হাসপাতালের পুষ্টি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. শামসুন নাহার নাহিদ ভোরের কাগজকে বলেন, আয়ের তুলনায় ব্যয় বাড়ায় স্বাভাবিকভাবেই স্বল্পআয়ের পরিবারগুলোর ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। খাদ্য তালিকা কাটছাঁট করতে তারা বাধ্য হচ্ছেন। এর ফলে অনেকের খাদ্য তালিকা থেকে স্নেহ ও প্রোটিনের উৎসগুলো বাদ পড়ছে। এতে পুষ্টির ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এই পুষ্টিবিদ আরো বলেন, কায়িক শ্রমজীবীরা পরিশ্রমের ঘাটতি পূরণ করতে ভাতের ওপর জোর বাড়াবে। এতে অসংক্রামক রোগের ঝুঁকি বাড়বে। শিশুরা কম খেলে বা অতিপ্রয়োজনীয় পুষ্টিগুলো না পেলে পুষ্টিহীনতায় ভুগবে, খর্বাকার হয়ে পড়বে। রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাবে। এই অপুষ্টি দীর্ঘমেয়াদে দেশের উৎপাদনশীলতার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) নির্বাহী পরিচালক ড. তাহমিদ আহমেদ জানান, গবেষণার তথ্য অনুযায়ী, মহামারি, যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি শিশুদের অপুষ্টির দিকে ঠেলে দেয়। তীব্র অপুষ্টিতে ভোগা শিশুদের মৃত্যুঝুঁকি সাধারণ শিশুদের চেয়ে ১১ থেকে ১২ গুণ বেশি। তিনি বলেন, শিশু যদি দীর্ঘদিন অপুষ্টির মধ্যে থাকে, তাহলে এর প্রভাব আমরা দেখি তার উচ্চতায়। এতে তাদের উচ্চতা বাধাগ্রস্ত হয়। যাকে আমরা বলি খর্বকায় শিশু। তাদের মৃত্যুঝুঁকি তিন-চার গুণ বেশি। যারা বেঁচে যায়, তাদের মস্তিষ্কের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ কম হয়।

পুষ্টিবিদ তামান্না শারমীন ভোরের কাগজকে বলেন, পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য নিশ্চিত করা এখন আমাদের নতুন চ্যালেঞ্জ। খাদ্যের চাহিদা মিটলেও পুষ্টির চাহিদা পূরণে আমরা এখনো অনেক পিছিয়ে। নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় সুস্থ থাকার জন্য যে পরিমাণ খাবার এবং পুষ্টিকর খাবার দরকার তা মিটানো সম্ভব হচ্ছে না।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App