×

প্রথম পাতা

পুঁজিবাজার পরিস্থিতি: আস্থা ফেরানোই মূল চ্যালেঞ্জ

Icon

মরিয়ম সেঁজুতি

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম

প্রিন্ট সংস্করণ

পুঁজিবাজার পরিস্থিতি: আস্থা ফেরানোই মূল চ্যালেঞ্জ

ছবি: সংগৃহীত

   

ক্রমেই নাজুক হচ্ছে পুঁজিবাজার পরিস্থিতি। দিন যতই যাচ্ছে পুঁজিবাজারের পতনের আকারও তত বড় হচ্ছে। ফলে ভয়াবহ দরপতনের মধ্যে পড়েছে দেশের পুঁজিবাজার। চলছে ব্যাপক রক্তক্ষরণ। অস্থির বাজারে প্রায় প্রতিদিনই মূল্যসূচক কমছে। এরচেয়েও বেশি কমছে শেয়ারের দাম। আতঙ্কিত বিনিয়োগকারীদের অনেকেই যে কোনো মূল্যে শেয়ার বিক্রি করে বাজার থেকে বের হয়ে যেতে মরিয়া। তাতে বাজারে বিক্রির চাপ বেড়ে গেছে।

দেশের পুঁজিবাজারে ‘আস্থাহীনতা’র এমন পরিস্থিতিতে আস্থা ফেরাতে সরকারের নেয়া নানা উদ্যোগের কথা জানিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। তারা বলছে, পুঁজিবাজারে বিগত সময়ের অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। এসব উদ্যোগের ফলে শেয়ারবাজারের বড়, মাঝারি ও ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা দ্রুত সুফল পাবে। অতীতের দূরবস্থা ও শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন- সরকার তাদের বিষয়টি বিবেচনা করে সুবিধা দেবে।

বাজার বিশ্লেষকরা বলেন, পুঁজিবাজারে উত্থান ও পতন থাকবে। কিন্তু আমাদের বাজারে নিয়মিত দরপতন চলছে। এটি স্বাভাবিক বাজারের বৈশিষ্ট্য নয়। এছাড়া টানা দরপতন পরিকল্পিত কোনো কারসাজি কিনা- তা খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ বিগত সরকারের লোকজন পরিকল্পিতভাবে দরপতন ঘটিয়ে বর্তমান অর্ন্তবর্তী সরকারকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চাইছে কিনা; তাও দেখার বিষয় বলে মনে করছেন তারা।

বিভিন্ন তথ্য উপাত্তে দেখা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন পরবর্তী সময়ে তিন কার্যদিবস পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন দেখা দিলেও অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর পতনের পাল্লা ভারি হতে শুরু করে, যা এখনো চলমান। গতকাল রবিবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই ও সিএসই) সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে সূচকের বড় পতনের মধ্যে দিয়ে লেনদেন শেষ হয়েছে। পুঁজিবাজারে ধারাবাহিক দর পতনের প্রতিবাদ এবং বিনিয়োগকারীদের পুঁজি রক্ষায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হস্তক্ষেপ কামনা করে গতকাল স্মারকলিপি দিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের ৪ নম্বর গেটে ‘পুঁজিবাজারের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের রক্ষার আবেদন’ শিরোনামে স্মারকলিপিটি দেন বাংলাদেশ জনস্বার্থ সুরক্ষা পরিষদের আহ্বায়ক মো. বুলবুল আহমেদ।

দেখা গেছে, পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ থাকা লাখ লাখ বিনিয়োগকারী এখন পথে পথে ঘুরছে। গত প্রায় দেড় দশক ধরেই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চেয়ারম্যান-কমিশনাররা বাজার কারসাজিচক্রের সঙ্গে মিলে বিনিয়োগকারীদের এমন সর্বনাশ ঘটিয়েছেন। দুর্বল ও নামসর্বস্ব কোম্পানি তালিকাভুক্তি ও এসব কোম্পানির শেয়ার কারসাজির মাধ্যমে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অর্থ লুটে নেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিপূরণের দাবি জানিয়েছেন।

পাশাপাশি বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যানের শাস্তির দাবিও জানিয়েছেন তারা। বিনিয়োগকারীদের এ আস্থাহীনতা দূর করার জন্য ২০১০ সালের ধসের পর এসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ড. খায়রুল হোসেন ও শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামও নানা পদক্ষেপ নিয়েছেন, দেখিয়েছেন। কিন্তু ড. খায়রুল হোসেনের দুর্বল আইপিও (প্রাথমিক গণপ্রস্তাব) অনুমোদন ও অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াতের কারসাজি চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতায় পুঁজিবাজারের ‘আস্থা’ যেন সোনার হরিণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

এমন বাস্তবতায় নতুন সরকার গঠন ও শিবলী রুবাইয়াতের পদত্যাগের পর নতুন সম্ভাবনায় মৌলভিত্তির কোনো পরিবর্তন না হলেও পুঁজিবাজারে উল্লম্ফন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছিল। আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগের পর মাত্র চার কার্যদিবসে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্যসূচক ১৫ শতাংশ বেড়ে ছয় হাজার পার হয়ে যায়। কিন্তু নতুন কমিশন গঠনের পর ধারাবাহিক দরপতনে বাজার আবার সরকার পতনের আগের দিনের অবস্থানে ফিরে আসে।

দুই মাস ধরেই বিরতি দিয়ে দরপতন হচ্ছে। খন্দকার রাশেদ মাকসুদের নেতৃত্বে নতুন কমিশন গঠনের পর আবার সেই আস্থাহীনতা ফিরে এসেছে। শুরুতে বিতর্কিত ব্যবসায়ী সালমান এফ রহমানের মালিকানাধীন বেক্সিমকো লিমিটেডের শেয়ার কারসাজির দায়ে ৪২৯ কোটি টাকা জরিমানা করে আলোড়ন সৃষ্টি করলেও বাজারে উল্টো আতঙ্ক তৈরি হয়েছে।

গত কয়েক বছরের অনিয়ম, কারসাজির তদন্তে একযোগে ১২টি কোম্পানির শেয়ার লেনদেন তদন্তের ঘোষণা দেয়ায় প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আতঙ্ক আরো বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি ব্যক্তিশ্রেণির বড় বিনিয়োগকারীরা পুঁজিবাজার ছেড়ে দিচ্ছেন অথবা সাইড লাইনে ফিরে গেছেন। এতে করে বিনিয়োগ কমে গিয়ে পুঁজিবাজার ধারাবাহিক দরপতনে পড়েছে।

পুঁজিবাজারে অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে সম্প্রতি একাধিক দিন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। বিক্ষোভ ও মানববন্ধনের পাশাপাশি বিএসইসি কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়েও দেন একদল বিনিয়োগকারী। সেই সঙ্গে বিএসইসির চেয়ারম্যানের পদত্যাগ দাবি করেন তারা। বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করলে পুঁজিবাজার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং লেনদেন কমে ফের তলানিতে নামল পুঁজিবাজার।

এদিকে, অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অফিসার গাজী তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল রবিবার বলা হয়, পুঁজিবাজার উন্নয়ন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে ও আন্তর্জাতিক মানের সুশাসন নিশ্চিত করতে পুঁজিবাজার সংস্কারের সুপারিশের জন্য পাঁচ সদস্যের টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। বিএসইসি গঠিত পুঁজিবাজার সংস্কার টাস্কফোর্সের কার্যপরিধি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭টি।

রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক এর সংস্কার, রেগুলেটরি কমপ্লায়েন্স ও প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন নিশ্চিতকরণ, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন, পুঁজিবাজারে পণ্য ও বাজার উন্নয়নে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ, বিনিয়োগ শিক্ষার প্রসার ও ব্যাপ্তি বাড়ানো, বিনিয়োগকারীদের সচেতনতা বাড়ানো, পুঁজিবাজারে কর্মরত পেশাজীবীদের সক্ষমতা বাড়াতে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রম জোরদার, বাজারে বৈচিত্র্য আনতে নতুন পণ্য আনা, সর্বোপরি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে এবং পুঁজিবাজারের গঠনমূলক ও টেকসই সংস্কারমূলক কার্যক্রমে বিএসইসি কাজ করছে।

টাস্কফোর্স কার্যক্রমের বাইরেও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পুঁজিবাজারের সার্বিক উন্নয়ন ও সংস্কারে পথনকশা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে বাজারের বিভিন্ন সমস্যা ও করণীয় বিষয়ে নানা সুপারিশ উঠে এসেছে। বাজারের স্বার্থে যেসব সুপারিশ গ্রহণযোগ্য, যাচাই-বাছাইয়ের পর সেগুলো বাস্তবায়ন করা হলে তাতে দীর্ঘমেয়াদে বাজারে তার সুফল মিলবে বলে আশাবাদী সরকার। পুঁজিবাজার তদারকি ও কারসাজি নিয়ন্ত্রণে সার্ভিলেন্স সিস্টেমের উন্নয়নে বিশ্বব্যাংকের কাছে সহযোগিতা চেয়েছে বিএসইসি।

সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, পুঁজিবাজারে ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। এর অংশ হিসেবে বড় বড় শিল্পগোষ্ঠীর সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করছে বিএসইসি। পুঁজিবাজারের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়ন, তালিকাভুক্তির ক্ষেত্রে কোম্পানির ভ্যালুয়েশন, আইপিও অনুমোদন ও তালিকাভুক্তির প্রক্রিয়া সহজীকরণ ও দ্রুত সম্পাদনসহ বিভিন্ন বিষয়ে কাজ করছে কমিশন।

বিভিন্ন খাতের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিশালী মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানিগুলোর দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তি একদিকে যেমন দেশের পুঁজিবাজারকে আরো শক্তিশালী করবে, অন্যদিকে পুঁজিবাজারের মাধ্যমে অর্থায়নের ফলে এসব বিভিন্ন খাতের অধিকতর বিকাশের মাধ্যমে দেশের শিল্পায়ন ও উন্নয়নের গতিকে ত্বরান্বিত করার সুযোগ তৈরি হবে। এ লক্ষ্যে ভালো মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির লক্ষ্যে পাবলিক ইস্যু রুলস ২০১৫-এর সংস্কারের মাধ্যমে কোম্পানিগুলো যাতে যৌক্তিক মূল্য পায় সে বিষয়ে উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে যা বহুজাতিক কোম্পানিসহ ভালো মৌলভিত্তিক কোম্পানির তালিকাভুক্তিতে সহায়ক হবে।

বিগত সময়ে পুঁজিবাজারে অনিয়ম, কারসাজি ও দুর্নীতির বিষয়ে অনুসন্ধান ও তদন্তের জন্য একটি ‘অনুসন্ধান ও তদন্ত কমিটি’ গঠন করেছে অর্থমন্ত্রণালয়। এটা বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়াতে কাজে আসবে বলে মনে করেন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মমিনুল ইসলাম।

ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের গঠনমূলক ও টেকসই সংস্কার প্রয়োজন। কারণ অনেকদিন ধরেই পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারীদের সহায়ক হয়নি। তাই পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থেই এই কাজ হবে এবং এটা চলমান প্রক্রিয়া। তিনি বলেন, যেহেতু সমস্যা দীর্ঘদিনের এবং বিগত দিনে এর সমাধানের চেষ্টা হয়নি, এজন্য অর্থমন্ত্রণালয় থেকে দায়িত্ব নিয়ে এটা করা হচ্ছে যেন কাজটা ভালোভাবে হয়।

মমিনুল ইসলাম বলেন, যদিও কিছু লোক এ বিষয়ে নেতিবাচক প্রচারণা করছে। তাই বিনিয়োগকারীদের উদ্দেশে বলতে চাই- সাধারণ বিনিয়োগকারীদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এই সংস্কার পুঁজিবাজারের স্বার্থেই এবং বিনিয়োগকারীদের স্বার্থকে সুরক্ষিত করার জন্যই দরকার। যদি সঠিকভাবে সংস্কার করা যায়, তাহলে পুঁজিবাজার সামনের দিনে অনেক ভালো অবস্থানে যাবে। আমাদের ইনভেস্টররাও সেখান থেকে লাভবান হবে।

টাইমলাইন: অন্তর্বর্তীকালীন সরকার

আরো পড়ুন

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App