ভোগ্যপণ্যের বাজার
নজরদারিতেও মিলছে না সুফল

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ১২ অক্টোবর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

উচ্চ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার নানা ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এরপরও কিছুতেই মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না। লাগামহীনভাবে বাড়ছেই বিভিন্ন নিত্যপণ্যের দাম। চাল, তেল, চিনি, ডিম, সবজি, মাছ- বাজারের কোথাও স্বস্তি নেই ক্রেতার। আয়-ব্যয়ের ভারসাম্য হারিয়ে ক্রেতাদের বাজারের ব্যাগ ছোট হচ্ছে নিয়মিত। বিক্রেতারা বলছেন, সাম্প্রতিক টানা বৃষ্টি ও চলমান বন্যায় পণ্য সরবরাহ কমেছে। মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সমন্বিত পদক্ষেপের জন্য প্রাইস কমিশন গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। তবে ক্রেতা ও বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বাজারে পুরনো সিন্ডিকেটের সঙ্গে নতুন সিন্ডিকেট যুক্ত হয়েছে। একইসঙ্গে করপোরেট কোম্পানিগুলোর হাত থেকে বাজার নিয়ন্ত্রণমুক্ত করলেও অনেকটাই সফলতা মিলবে।
এদিকে রাতারাতি বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমানো সম্ভব নয়; তবে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অভিযানের ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে জানিয়েছে বাজার মনিটরিং টিম। গত বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর বনানী কাঁচাবাজারে অভিযান শেষে অভিযানের নেতৃত্বদানকারী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সুলতানা আক্তার জানান, নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ ও স্থিতিশীল রাখতে বাজারে অভিযানের সংখ্যা বাড়ানো হবে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দেউলিয়া হওয়া শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সফল হয়েছে। পণ্যের দর কমেছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও। কিন্তু গত দুই বছর ধরে চড়া মূল্যস্ফীতিতে নাকাল এ দেশের সাধারণ মানুষ। গত আগস্টের শুরুতে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পরিবহন ও কাঁচাবাজারগুলোতে চাঁদাবাজি অনেকটা কমে যাওয়ায় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমে গিয়েছিল।
তবে মাস যেতে না যেতেই আবার ঘুরতে শুরু করে পরিস্থিতি। দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে নানা পদক্ষেপ নিয়ে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে বর্তমান সরকার। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও নিত্যপণ্যের বাজারে স্বস্তি ফেরাতে ঋণের সুদহার বাড়িয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলমান ডলার সংকটের মধ্যেও নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানিতে জোর দেয়া হয়েছে। পেঁয়াজ, আলু ও চিনি আমদানিতে শুল্ক কমানো, ডিম আমদানি শুরু করা, ডিম ও মুরগির দাম বেঁধে দেয়া, চাঁদাবাজি রোধের উদ্যোগ, টিসিবির মাধ্যমে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রি বাড়ানো, পণ্য উৎপাদন ও সরবরাহ নিশ্চিত করতে সহযোগিতা করাসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরও স্বস্তি ফিরছে না নিত্যপণ্যের বাজারে।
সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশ ব্যাংক, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। একটি প্রাইস কমিশন গঠন করতে হবে। বাজার পরিদর্শন করে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার ক্ষমতা যেন এ কমিশনের থাকে। সরকার দাম বাড়ার লাগাম টানতে সক্ষম হবে বলে যে জনআকাক্সক্ষা তৈরি হয়েছিল- সেটার প্রতিফলন দেখা যায়নি গত দুই মাসে। এতে জনসাধারণের মধ্যে কিছুটা হতাশাও তৈরি হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে বাজারের লাগাম টানতে নড়েচড়ে বসেছে সরকার। যে কোনো মূল্যে পণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে নিচ্ছে নানা উদ্যোগ। বাজার পরিস্থিতি সামাল দিতে জেলায় জেলায় টাস্কফোর্স করেছে সরকার। যদিও এই টাস্কফোর্স বাজার নিয়ন্ত্রণে কতটা ভূমিকা রাখতে পারবে, তা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
সরকার টাস্কফোর্সের যে কার্যপরিধি নির্ধারণ করেছে তাতে বলা হয়েছে- টাস্কফোর্স নিয়মিত বিভিন্ন বাজার, বৃহৎ আড়ত/গোডাউন/কোল্ড স্টোরেজ ও সাপ্লাই চেইনের অন্য স্থানগুলো সরজমিন পরিদর্শন করবে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যৌক্তিক পর্যায়ে রাখার বিষয়টি তদারক করবে। উৎপাদন, পাইকারি ও ভোক্তা পর্যায়ের মধ্যে যাতে দামের পার্থক্য ন্যূনতম থাকে তা নিশ্চিত করবে ও সংশ্লিষ্ট সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে মতবিনিময় সভা করবে তারা।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আমদানি ও অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য অনুবিভাগের দায়িত্বে থাকা যুগ্ম সচিব মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, সরকার এখন দাম নিয়ন্ত্রণে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এটাই এখন বড় সমস্যা। এর সমাধানে আরো পরিকল্পিতভাবে কাজ করতেই আমরা টাস্কফোর্সের প্রজ্ঞাপন জারি করেছি এবং তখন থেকেই এটা কার্যকর। এখন তারা (টাস্কফোর্স) নিজেরা বসে বাজার তদারকি করবেন।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজের হোসাইন ভোরের কাগজকে বলেন, দাম বাড়াচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বর্ষা-বন্যার কারণে দাম হয়তো কিছুটা বাড়ত। কিন্তু যেভাবে বাড়ানো হয়েছে সেটা কারসাজি। তিনি বলেন, টাস্কফোর্সের মনিটরিংয়ের কারণে হয়তো কিছুটা সুফল পাওয়া যাবে। তবে আসল জায়গায় সমস্যার সমাধান হবে বলে মনে হয় না। তিনি বলেন, পণ্যের আমদানি ও বিতরণের জায়গায়ই সমস্যা। বড় করপোরেট গ্রুপের হাতে এখন বাজার একপ্রকার জিম্মি হয়ে আছে। সেখানে মাঠপর্যায়ে বাজার তদারকি করে সুফল পাবেন না। এছাড়া সরকার পরিবর্তন হলেও পুরনো সিন্ডিকেট বাজারে এখনো বহাল তবিয়তে আছে। সেখানে আঘাত হানতে হবে।
প্রায় একই মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বাজারের সংকট অনেক গভীর এবং ছোটখাটো যেসব উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তাতে আপাতত কিছুটা লাভ হলেও দীর্ঘমেয়াদে লাভ হবে না। টাস্কফোর্স যদি জেলা পর্যায়ে কার কাছে কোন পণ্য কতটা মজুত আছে সেই তথ্য নিতে পারে। এটা করলে মজুত রেখে মুনাফার চেষ্টা কিছুটা কমতে পারে।
তথ্য অনুযায়ী, গত জুলাইয়ের তুলনায় অক্টোবরে খুচরা পর্যায়ে মোটা চাল ব্রি-২৮ ও পাইজাম প্রতি কেজিতে ১০ থেকে ১১ শতাংশ দাম বেড়ে মানভেদে ৬০ থেকে ৬৪ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতি ডজন ফার্মের মুরগির ডিম ১৩ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত দাম বেড়ে ১৮০-১৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ব্রয়লার মুরগির দামও কেজিতে ৯ থেকে ১৬ টাকা পর্যন্ত বেড়ে ১৮৫ থেকে ১৯০ টাকায় উঠেছে। বাজারে মাছের সংকট না থাকলেও ১২ থেকে ১৪ শতাংশ বেড়ে মাঝারি রুই মাছ প্রতি কেজি ৪০০ থেকে ৪৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এখন সব ধরনের সবজির দাম চড়া।
গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন কাঁচাবাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, রাজধানীর বাজারগুলোতে দফায় দফায় বাড়ছে সবজির দাম। এক কেজি পাকা টম্যাটোর দাম ২৮০ টাকায় উঠেছে। অন্যান্য সবজির মধ্যে বেশির ভাগের কেজি এখন ১০০ টাকা ছুঁয়েছে। বাজারে এখন সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে পাকা টম্যাটো। মান ও বাজারভেদে এক কেজি পাকা টম্যাটো বিক্রি হচ্ছে ২৬০ থেকে ২৮০ টাকা। শুধু পাকা টম্যাটো নয়, বাজারে এখন সব ধরনের সবজি অস্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে। শীতের আগাম সবজি শিম বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি। কেজি ২০০ টাকা ছুঁই ছুঁই অবস্থায় বরবটি ও গাজর। খুচরা বিক্রেতারা এক কেজি বরবটি বিক্রি করছেন ১৫০ থেকে ১৭০ টাকা। গাজরের কেজি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। উস্তার কেজি ১২০ থেকে ১৩০ টাকা। তবে করলা কিছুটা কম দামে বিক্রি হচ্ছে। এক কেজি করলা কিনতে ক্রেতাদের ৮০ থেকে ১০০ টাকা গুনতে হচ্ছে।
কেজি ১০০ টাকা ছুঁয়েছে পটোল, ঝিঙা, কচুরলতি, কাঁকরোল ও বেগুনের। বিক্রেতারা এক কেজি পটোল ৮০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করছেন। একই দামে বিক্রি হচ্ছে ঝিঙা। কচুরলতির কেজি ১০০ থেকে ১২০ টাকা। কাঁকরোল বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকায়। বেগুন বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকায়। বাজারে ফুলকপি, বাঁধাকপি, মিষ্টিকুমড়া, কচু- কোনো কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না। ছোট একটা ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। একই দামে বিক্রি হচ্ছে বাঁধাকপি। কচুরমুখী বিক্রি হচ্ছে ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজি। মিষ্টিকুমড়ার কেজি বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। চিচিঙ্গা বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। বাজারে এখন সবচেয়ে কম দামে পাওয়া যাচ্ছে কাঁচা পেঁপে ও কাঁচকলা। এক কেজি পেঁপে বিক্রি হচ্ছে ৪০ থেকে ৫০ টাকা। কাঁচকলার হালি ৪০ থেকে ৫০ টাকা। একপোয়া কাঁচামরিচ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা। নি¤œমানের শসা ৫০ টাকা কেজি বিক্রি হলেও, ভালো মানের শসা কিনতে ক্রেতাদের ৮০ থেকে ১০০ টাকা গুনতে হচ্ছে।
মালিবাগ রেলগেইট কাঁচাবাজারে সবজি কিনতে এসেছিলেন পোশাককর্মী সালেহা আক্তার। সবজির দাম শুনে কোনোরকমে আধা কেজি পটোল নিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। এ সময় তিনি বলেন, ৮০ টাকা, ১০০ টাকার নিচে কোনো সবজি নেই। আমরা যে বেতন পাই তা দিয়ে তো এত দামে সবজি কিনে খাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই কিছু পটোল নিয়ে যাচ্ছি। সবজির এমন দাম নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেন শান্তিনগর বাজারে সবজি কিনতে আসা সুলায়মানও। তিনি বলেন, বাজারে এখন কোনো সবজিতে তো হাত দেয়ার মতো অবস্থা নেই। সব ধরনের সবজির দামে আগুন। পকেটে ৫০০ টাকা নিয়ে এলে তেমন কোনো বাজার করাই হয় না। সবজির এত দাম কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারে না। বাজারে জিনিসপত্রের দাম কমাতে সংশ্লিষ্টদের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া উচিত বলে মনে করেন এ ক্রেতা।
এদিকে কারওয়ান বাজারে সবজি বিক্রেতা মো. ইব্রাহীম বলেন, বৃষ্টির কারণে কয়েক দিন ধরে বাজারে সবজির সরবরাহ কিছুটা কম। এ কারণে সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। সহসা সবজির দাম কমবে বলে মনে হচ্ছে না। কারণ বৃষ্টিতে সবজি ক্ষেতের বেশি ক্ষতি হয়েছে। মনির নামের আরেক ব্যবসায়ী বলেন, বৃষ্টির কারণে প্রতি বছরই এ সময় সবজির দাম বাড়ে। তবে অন্যবারের তুলনায় এবার দাম অনেক বেশি। আমরা নিজেরাও বুঝি এত বেশি দামে সবজি কেনা ক্রেতাদের জন্য খুবই কষ্টের। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। আমরা তো কম দামে সবজি কিনতে পরছি না।