চার বছরে কতটা কথা রাখলেন মেয়র আতিক

রুমানা জামান
প্রকাশ: ১৩ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মো. আতিকুল ইসলাম
নগরপিতা হিসেবে দায়িত্ব পালনের চার বছর পূর্ণ করলেন মো. আতিকুল ইসলাম। ২০২০ সালে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর ‘সুস্থ ঢাকা, সচল ঢাকা ও আধুনিক ঢাকা’ এই তিন রূপরেখার মাধ্যমে মোটাদাগে তিনি দিয়েছিলেন ৩৮টি প্রতিশ্রুতি। এরপরই রাজধানী ঢাকাকে স্মার্ট সিটি করার ঘোষণা দিয়ে তিনি নেমে পড়েছিলেন নগরবাসীর সেবায়। মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার আগে তিনি নগরবাসীর কাছে যেসব ওয়াদা করেছিলেন, তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন হয়েছে। কিছু চলমান আছে; অল্প কিছু এখনো বাস্তবায়ন হয়নি। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়র ও কাউন্সিলর পদে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা উত্তর সিটিতে মো. আতিকুল ইসলাম মেয়র হিসেবে শপথ নেন। আগের মেয়রের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার নিয়ম আছে। এ জন্য তিন মাস পর ওই বছরের ১৩ মে দ্বিতীয় মেয়াদে মেয়রের দায়িত্ব নেন আতিকুল ইসলাম।
এর আগে ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে অংশ নিয়ে নয় মাস মেয়রের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। আজ সোমবার (১৩ মে) ডিএনসিসির মেয়র হিসেবে এই মেয়াদে চার বছর পূর্ণ হলো মেয়র আতিকের। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী চার বছরে নগরে অনেক অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন মেয়র আতিক। তবে এখনো অনেক প্রকল্পের কাজ চলমান। আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে নাগরিক সেবা সহজ করার বিষয়টিকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন তিনি। ডিএনসিসির মেয়রের দায়িত্ব নেয়ার পরপরই জলাবদ্ধতা নিরসন, অবৈধ দখলে থাকা খাল উদ্ধার, ফুটপাত দখলমুক্ত করা, যানজট নিরসন, মশা নিধন, পরিবেশবান্ধব সড়ক বাতি স্থাপন, পার্ক-খেলার মাঠ আধুনিকায়ন, ডিএনসিসি করোনা হাসপাতাল চালু, পাবলিক টয়লেট স্থাপন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নগরের উন্নয়নে সমঝোতা চুক্তিসহ জলাশয় রক্ষায় কাজ শুরু করেন আতিক। সুস্থ ঢাকা প্রতিশ্রুতিতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়ে ড্রেন পরিষ্কার করা, বর্জ্য অপসারণসহ ড্রেনের বর্জ্য নিয়মিত পরিষ্কার করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বাসাবাড়ির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন (বর্জ্য রাখার বড় ঘর) তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্পও চলমান। কারওয়ান বাজার আড়ত মার্কেটের দোকান স্থানান্তরের প্রক্রিয়াও চলমান। অগামী এক বছরে প্রতিশ্রুতির বাকি কাজগুলো বাস্তবায়ন করতে পারবেন বলে আশাবাদী মেয়র আতিকুল ইসলাম। জানতে চাইলে তিনি ভোরের কাগজে বলেন, সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকা গড়তে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, তা বাস্তবায়নে আমি বদ্ধপরিকর। প্রতিশ্রুতি ধরে ধরে বেশকিছু কাজ করেছি, আবার কিছু কাজ করা সম্ভব হয়নি। তবে ধাপে ধাপে নগরে অবকাঠামো উন্নয়নে কাজ করছি। তিনি বলেন, কাজের মাধ্যমে মানুষের আস্থা-ভালোবাসা অর্জন করতে পেরেছি। আমি সাধ্যমতো সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাচ্ছি নগরবাসীকে স্বস্তিতে রাখার। আমার প্রতি নগরের মানুষের অস্থা-বিশ্বাসই আমার কাজের শক্তি। ঢাকাকে বাসযোগ্য নগরী হিসেবে গড়ে তুলতে সব প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে শেষ পর্যন্ত কাজ করে যাব।
চার বছরে প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন কতটা : সুস্থ ঢাকা ইশতেহারে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন ডিএনসিসি মেয়র। উত্তর সিটি এলাকায় এক হাজার ২৫০ কিলোমিটার ড্রেন নিয়মিত পরিষ্কার করছে ডিএনসিসি। এছাড়া বাসাবাড়ির বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নগরের বিভিন্ন এলাকায় ৫৫টি সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশন তৈরি করা হয়েছে। আমিনবাজারে ল্যান্ডফিলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ডিএনসিসির প্রকৌশল দপ্তর সূত্র জানায়, গত চার বছরে ২৪টি পার্ক ও খেলার মাঠ উদ্বোধন করা হয়েছে। চলতি বছর উদ্বোধন করা হয়েছে গুলশানের ডা. ফজলে রাব্বি পার্ক।
এছাড়া মিরপুরে প্যারিস রোড মাঠ পরিত্যক্ত ছিল। মাঠটি শিশু-কিশোরদের খেলার জন্য সংস্কার করা হয়েছে। সিটি করপোরেশন নাগরিকদের যেসব সেবা দিয়ে থাকে এর মধ্যে মশা নিধন বা নিয়ন্ত্রণ অন্যতম। এ জন্য ডিএনসিসি ৫৪টি ওয়ার্ডে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে। এছাড়া বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশা নিধনে ল্যাব স্থাপন এবং পাঠ্যপুস্তকে এডিস মশা সম্পর্কে সচেতনতার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করতে ব্যবস্থা নিয়েছে ডিএনসিসি। সকাল-বিকাল লার্ভিসাইডিং ও অ্যাডাল্টিসাইডিং করছে। এডিসের লার্ভা পেলে ম্যাজিস্ট্রেটরা জরিমানা করছেন।
যেসব পরিত্যক্ত দ্রব্যে পানি জমে এডিসের লার্ভা জন্মাতে পারে, সেসব দ্রব্য সিটি করপোরেশন কিনে নিচ্ছে। ডাবের খোসা, পরিত্যক্ত পলিথিন, চিপসের প্যাকেট, আইসক্রিমের কাপ, দইয়ের কাপ, পুরনো টায়ার, কমোড, রঙের কৌটা- এগুলো ডিএনসিসির কাউন্সিলরদের কাছে নিয়ে গেলে তারা কিনে নিচ্ছেন। বায়ুদূষণ রোধে জার্মান প্রযুক্তির অত্যাধুনিক স্প্রে-ক্যানন ব্যবহার করছে ডিএনসিসি। এছাড়া ১০টি ওয়াটার ব্রাউজার দিয়ে দৈনিক চার লাখ লিটার পানি ছিটানো হয়। চলমান তাপদাহের মধ্যে চিফ হিট অফিসার বুশরা আফরিনের পরামর্শে স্প্রে-ক্যাননের মাধ্যমে নগরীর বিভিন্ন স্থানে পানি ছিটানো হচ্ছে। গত বছর ৮০ হাজার গাছ লাগিয়েছে উত্তর সিটি। চলতি বছর আরো এক লাখ ২০ হাজার গাছ লাগানো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। মেয়র আতিক দায়িত্ব নেয়ার পর গত চার বছরে ডিএনসিসির বিভিন্ন এলাকায় ৪৯টি নতুন পাবলিক টয়লেট স্থাপনসহ ১৫টি সংস্কার করা হয়েছে।
এসব পাবলিক টয়লেটে নারী ও পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। এছাড়া গোসল, অজু, লকার, ব্রেস্ট ফিডিংয়ের ব্যবস্থাও রয়েছে। ডিএনসিসি মেয়র নগরীর অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন। রাস্তা নির্মাণে সিটি করপোরেশনের বরাদ্দ পেতে হলে অবশ্যই তা ২০ ফুট প্রশস্ত হতে হবে। এমন নির্দেশনার পর মিরপুরের মোল্লা রোড, আদর্শ রোড, পীরের বাগ, কাওলাসহ বিভিন্ন এলাকায় ২০ ফুট চওড়া করে রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। ২০২১ সালে ওয়াসা থেকে ২৯টি খালের দায়িত্ব বুঝে পায় ডিএনসিসি। এরপর খাল উদ্ধার, খনন, পরিষ্কার, খালের পার সবুজায়ন, সাইকেল লেন ও ওয়াকওয়ে নির্মাণ শুরু করে ডিএনসিসি। ইসিবি স্কয়ার থেকে কালশী পর্যন্ত ৩.৭০ কিলোমিটার রাস্তা প্রশস্ত করেছে সংস্থাটি।
এছাড়া কুড়িল ফ্লাইওভার সংলগ্ন জলাধার ভরাট করে পাঁচতারা হোটেল নির্মাণের কাজ শুরু করলে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে নির্মাণকাজ স্থগিত করেন ডিএনসিসি মেয়র। পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনে কুইক রেসপন্স টিম গঠন করে দিয়েছে ডিএনসিসি। জনদুর্ভোগ দূর করতে কাজীপাড়া-শেওড়াপাড়া এলাকায় ওয়াসা থেকে পাওয়া ড্রেনেজ অংশ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসন করা হয়েছে। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আনুমানিক ৫০টি ইলেকট্রিক বাস চালুর উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি। অবশ্য চলতি অর্থ বছরের মধ্যে নগর পরিবহনে ১০০টি ইলেকট্রিক বাস চালু করার উদ্যোগ থাকলেও সেটি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
২০২১ সালে প্রথমবারের মতো ডিএনসিসি ডিজিটাল পশুর হাট চালু করেন মেয়র। গত বছরও ডিজিটাল পশুর হাট আয়োজন করে সংস্থাটি। এবারো ডিজিটাল পশুর হাটের আয়োজন করা হবে বলে জানা গেছে। বর্তমানে ঘরে বসেই একজন গ্রাহক অনলাইনের মাধ্যমে ট্রেড লাইসেন্স পাচ্ছেন। কিউআর কোডভিত্তিক রিকশার লাইসেন্স, ক্যাশলেস মার্কেট ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে। ডিএনসিসি-১, খিলগাঁও তালতলা মার্কেটকে কিউআর কোডভিত্তিক ক্যাশলেস মার্কেট হিসেবে ঘোষণা করেছে ডিএনসিসি। টিকাদানের সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য ই-ট্র্যাকার জিআইএসের মাধ্যমে শিশুদের তথ্য সংগ্রহ করে টিকা দেয়া হচ্ছে।
যেসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি : গত চার বছরে অনেক ভালো কাজ করলেও মেয়র আতিকের দেয়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিশ্রুতি এখনো আলোর মুখ দেখেনি। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য পরিবহন ব্যবস্থা চালু, সুনিয়ন্ত্রিত ও নারীবান্ধব গণপরিবহন নিশ্চিত এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করতে ‘জনতার মুখোমুখি মেয়র’ শীর্ষক নিয়মিত মতবিনিময় করে ওয়ার্ডভিত্তিক সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি। তবে এখন পর্যন্ত এসবের বাস্তবায়ন দেখা যায়নি। উত্তর সিটির মেয়র বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি ফুটপাত দখলমুক্ত করে এলাকাভিত্তিক পথচারীবান্ধব ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের জন্য ফুটপাত নেটওয়ার্ক তৈরি করবেন। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন নাগরিকদের জন্য গণস্থাপনা এবং গণপরিবহন নিশ্চিত করবেন।
নগরীর ব্যস্ততম এলাকাগুলোয় নির্মাণ করবেন বহুতল ও আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং কমপ্লেক্স। নাগরিকদের যাতায়াতের সুবিধার জন্য পরিকল্পিত স্মার্ট বাসস্টপ ও বাস-ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ করবেন। আধুনিক ঢাকা গড়ার লক্ষ্যে একটি সার্বক্ষণিক ডিজিটাল কমান্ড সেন্টার তৈরি করে শহরের নিরাপত্তা, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও স্মার্ট নেইবারহুড পরিচালনা করার অঙ্গীকার করেছিলেন আতিকুল ইসলাম। তিনি আরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, উত্তর সিটির কয়েকটি এলাকাকে প্রাথমিকভাবে স্মার্ট নেইবারহুড হিসেবে গড়ে তোলা হবে। পাশাপাশি প্রতিটি পাড়া ও মহল্লাকে এই উদ্যোগের আওতায় আনা হবে। বায়ুদূষণ রোধে ইলেকট্রিক বাস সার্ভিস চালু করারও কথা বলেছিলেন তিনি।
এছাড়া মিরপুরে উত্তর সিটির নিজস্ব জায়গায় বৃক্ষপ্রেমীদের জন্য বৃক্ষ ক্লিনিক ও পোষ্য প্রাণী ক্লিনিক নির্মাণ করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এসব প্রতিশ্রুতির একটিও বাস্তবায়নে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। দুই মেয়র যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার কতটা বাস্তবায়িত হলো? এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এখতিয়ারের বাইরে গিয়েও অনেক প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে। চাইলেও এর মধ্যে অনেক প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। সিটি করপোরেশনকে তদারকির দায়িত্ব বেশি করে পালন করতে হবে। কারণ, আইনে করপোরেশনকে অনেক বেশি ক্ষমতা দেয়া হলেও সরকারের অন্য সংস্থাও নাগরিক সেবা নিয়ে কাজ করছে।
তিনি বলেন, বিচ্ছিন্নভাবে নেয়া উদ্যোগ ভালো কিছু নিয়ে আসে না। তাই বড় প্রকল্পের জন্য অপেক্ষা না করে ছোট ছোট পরিসরে কাজ করে যেতে হবে। এই পরিকল্পনাবিদ খাল উদ্ধারে দুই সিটির নেয়া উদ্যোগের প্রশংসা করে বলেন, খাল রক্ষা করতে হলে এ কাজে স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করতে হবে। জনগণের কাছে করা অঙ্গীকারের পুরোটা বাস্তবায়ন সম্ভব না হলেও সিংহভাগ বাস্তবায়নে সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।