সুদহার নিয়ে আতঙ্কে ব্যবসায়ীরা

মরিয়ম সেঁজুতি
প্রকাশ: ১২ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের ‘আউট অব বক্স থিওরি’ কাজে আসেনি। বরং, দীর্ঘদিন ঋণের সুদহার ৯ শতাংশের ঘরে বেঁধে রাখার ফলে অর্থ-বাণিজ্যের নানা সূচক ফুলে-ফেঁপে ওঠে। সেই সঙ্গে অস্বস্তি ছিল স্মার্ট পদ্ধতির সুদহারেও। অবশেষে চালুর ১০ মাসের মাথায় ‘এসএমএআরটি’ বা ‘স্মার্ট সুদহার পদ্ধতি’ বাতিল করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে ঋণের সুদহার করা হয় বাজারভিত্তিক। পাশাপাশি নীতি সুদহার বা রেপো বাড়ানো হয় দশমিক ৫০ বেসিস পয়েন্ট।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সুদহারের সীমা তুলে দিলে ফের সেটি ২০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে। এতে মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়বেন ব্যবসায়ীরা। নতুন বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হওয়ায় কর্মসংর্স্থান কমে যেতে পারে। এমনিতেই প্রবৃদ্ধি এক শতাংশ কমে গেছে। এমন পরিস্থিতি চলতে থাকলে চলতি অর্থবছর শেষে প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে যাওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে। এতে সার্বিক অর্থনীতি গতিশীলতা হারাতে পারে বলে মত সংশ্লিষ্টদের। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও রপ্তানিমুখী মাঝারি ব্যবসায়ীরা ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কায় রয়েছেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার দায়িত্ব নেয়ার পর মুদ্রাবাজার নিয়ন্ত্রণে সিক্স মান্থস মুভিং এভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিলস বা ‘স্মার্ট’ পদ্ধতি চালু করেন। এর ফলে দীর্ঘদিনের ৯ শতাংশ সুদসীমা উঠে যায়। এরপর লাফিয়ে বাড়তে থাকে সুদের হার। কিন্তু বাজার পরিস্থিতির দৃশ্যমান উন্নতি হয়নি। তাই এ পদ্ধতি থেকে সরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন গভর্নর। গত বুধবার ডাকা মুদ্রানীতি কমিটির বৈঠকে এ পদ্ধতি বাতিল করে সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করার ঘোষণা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক মুস্তফা কে মুজেরী ভোরের কাগজকে বলেন, পলিসি ভালো, তবে মনিটরিং ব্যবস্থা ভালো নয়। তাই ভালোর চেয়ে খারাপ হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তিনি বলেন, সঠিক মনিটরিংয়ের মাধ্যমে চাহিদা এবং সরবরাহের ওপর নির্ভর করে বাজারের মূল্য নির্ধারিত হলে বাজার ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোকে দূর হবে। তেমনি আর্থিক বাজারেও একই নিয়ম। ঋণের সুদহারের ক্ষেত্রে আর্থিক বাজার যদি ভালো থাকে, সঠিকভাবে পরিচালিত হয়- তাহলে বাজার ব্যবস্থার মাধ্যমেই সঠিক সুদহার নির্ধারণ হবে। বাজারভিত্তিক অর্থনীতিতে এটিই হওয়া উচিত। তা না হলে, এর আগে যেমন সুদহার নয়-ছয় করা হয়েছিল, কিন্তু কোনো সুফল পাওয়া যায়নি, তেমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। তাই বাজারভিত্তিক সুদহার নির্ধাারণ সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে বাজারে যারা প্লেয়ার বা খেলোয়ার আছে- যেমন ব্যাংক বা অন্যান্য অংশগ্রহণকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, গুড গভর্নেন্স থাকে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও এফবিসিসিআইয়ের পরিচালক সিদ্দিকুর রহমান ভোরের কাগজকে বলেন, আশি-নব্বইয়ের দশকে ব্যাংক রেট অনেক বেশি ছিল, এরপরও মানুষ বিনিয়োগ করেছে। নতুন নতুন ইন্ডাস্ট্রি গড়ে উঠেছে। কারণ, তখন দেশে ব্যবসায়িক পরিস্থিতি ভালো ছিল। কিন্তু বাজার অর্থনীতিতে বিশ্ববাজার এমন এক পরিস্থিতিতে আছে যেখানে খুব একটা লভ্যাংশ থাকে না। এরপরও ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এজন্য নতুন বিনিয়োগকারী সৃষ্টি কম হচ্ছে। এমনিতেও অর্থের প্রবাহে টান পরলে ব্যাংক ঋণের সুদহার বাড়ানো হয়। এর ফলে নতুন বিনিয়োগকারী কমে আসে। অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্তে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, পাশাপাশি যারা ৯ শতাংশ সুদে ঋণ নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছেন, তারা এখন বিপদে পড়বেন। এর ফলে মন্দমানের ঋণ আরো বাড়বে। এতে ঋণ খেলাপি আরো বাড়বে। তিনি বলেন, ৯ শতাংশ সুদে নেয়া ঋণের কিস্তি যদি এখন ১৫ শতাংশ হারে পরিশোধ করতে হয়, তাহলে খেলাপি হওয়া ছাড়া বিকল্প উপায় থাকে না। অর্থাৎ এর ফলে মন্দমানের ঋণ আরো বাড়বে। ঋণখেলাপি বাড়বে।
জানতে চাইলে সুরমা গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফয়সাল সামাদ ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক একসঙ্গে অনেকগুলো সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফলে চাপটা বেশি হবে। তিনি আরো বলেন, এখন অনেকেই ব্যাংকের ঋণ শোধ করতে পারবেন না। সুদহার বেড়ে যাওয়ায় অনেকের পক্ষে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে পড়বে। সামগ্রিকভাবে আমি মনে করি, এর প্রভাব খুবই বেশি। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবসায়ীদের পক্ষে টিকে থাকা কঠিন হবে। প্রায় একইভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিশ্বের প্রথম পরিবেশবান্ধব প্লাটিনাম গ্রিন টেক্সটাইল- মিথিলা গ্রুপের চেয়ারম্যান আজাহার খান।
ভোরের কাগজকে তিনি বলেন, সুদহার নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নতুন সিদ্ধান্তের ফলে নতুন বিনিয়োগকারী বাজারে আসবে না। পুরনো ব্যবসায়ীরা বাঁচার জন্য চেষ্টা করবে। তিনি বলেন, গার্মেন্টস এবং টেক্সটাইল আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সম্পৃক্ত। বায়ার যেখানে কম মূল্যে পণ্য পাবে সেখানেই যাবে। আমাদের উৎপাদন খরচ এমনিতেই অনেক বেড়ে গেছে। কর্মচারিদের বেতন বেড়েছে। এর মধ্যে যদি লাভ না হয়, পাশাপাশি ব্যাংকের সুদের হার বেশি দিতে হয়- তাহলে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠান দুর্বল হয়ে যাবে এবং একটা সময়ে বন্ধ করে দিতে হবে। ডলারের দাম হঠাৎ করে বাড়িয়ে ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
এ বিষয়টি উল্লেখ করে আজাহার খান বলেন, এটা রপ্তানিকারকদের জন্য ভালো হয়েছে। তবে এ দর একবারে না বাড়িয়ে আগে থেকেই অল্প অল্প করে বাড়ালে ফলপ্রসূ হতো। তিনি বলেন, অনেকে হয়তো গত বছর একশ কোটি টাকার মেশিন কিনেছে। তিনি ডলার রেট ১০৯ টাকা করে হিসাব করেছেন ১০৯ কোটি টাকার পণ্য। ঋণপত্রে এক বছরের চুক্তি থাকে। এক বছর পর ব্যাংকে এলসি বা ঋণপত্র সেটেলড করতে গিয়ে টাকায় কনভার্ট করা হবে; তখন ১১৭ কোটি টাকা গুনতে হবে। এখানেই তিনি আটকে যাবেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলেছে, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা। এ ছাড়া ঋণের সুদহার বাজারভিত্তিক করার দাবিটি দীর্ঘদিনের। সুদ ও ডলারের দাম বাড়লে তা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সহায়তা করবে। এদিকে ব্যাংকাররা মনে করেন, সুদহার পুরোপুরি বাজারভিত্তিক করা হলে স্বল্প সময়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়লেও দীর্ঘমেয়াদে ভালো হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, সুদহার বাজারভিত্তিক করা এক অর্থে প্রয়োজন ছিল। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু সুদহার বাড়ালেই যে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসবে, তা ঠিক নয়। মূল্যস্ফীতি কমাতে এখন পর্যন্ত সঠিক কোনো দিকনির্দেশনা দেখতে পাচ্ছি না। অর্থনীতিবিদরা দীর্ঘদিন থেকে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়ার কথা জানালেও তাতে সাড়া দেয়নি বাংলাদেশ ব্যাংক। তবে আইএমএফের ঋণের শর্ত মেনে এবার কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব পদক্ষেপ নিয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলেছে, সুদহার বাজারভিত্তিক করা হলেও তা বর্তমানের চেয়ে ১ শতাংশের বেশি যেন না বাড়ে, সে বিষয়ে তফসিলি ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ টাকার আশপাশে রাখতে বলা হলেও তা যেন ১১৮ টাকার মধ্যে লেনদেন হয়। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্দেশনা কেউ মানবে না। ফলে ডলার সংকট কাটবে বলে মনে হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক বুধবার দুটি পৃথক প্রজ্ঞাপনে সুদহারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। একটির মাধ্যমে চলমান স্মার্ট পদ্ধতি প্রত্যাহার করা হয়েছে। আরেকটির মাধ্যমে ব্যাংকঋণের সুদহার সম্পূর্ণ বাজারভিত্তিক করার সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছে। সবশেষ ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার ছিল ১৩ দশমিক ৫৫ শতাংশ।
জানতে চাইলে নিটওয়্যার উৎপাদক ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে তাতে ব্যবসাবাণিজ্য সব বন্ধ হয়ে যাবে। বিশেষ করে যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ব্যবসা করছেন তাদের আর বেঁচে থাকার কোনো অবলম্বন থাকবে না। তিনি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংক আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করে না। আমরা অর্থ ও বাণিজ্যপ্রতিমন্ত্রী এবং সংশ্লিষ্ট সচিবদের কাছে আমাদের উদ্বেগের কথা বলেছি।