ঢাকার মশা নিধনে আসছে জৈব কীটনাশক ‘বিটিআই’

রুমানা জামান
প্রকাশ: ১১ মে ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

মশক নিধন অভিযানে ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত
ভরা মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই মশা নিধনে কার্যকারী জৈব কীটনাশক বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) আনছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সংস্থাটি জানিয়েছে, এ বছর সিঙ্গাপুর থেকে তরল, ট্যাবলেট ও পাউডার- এ তিনটি ফর্মে ২০ কোটি টাকার বিটিআই আসছে। বিটিআইয়ের বদলে নতুন ফরম্যাটে ‘বিটিএস’ নামে আসছে এ কীটনাশকটি। পাশাপাশি ওষুধ ছিটানোর জন্য অত্যাধুনিক ‘হুইলবারো’ মেশিনও আনার প্রক্রিয়া চলছে।
১৯৭৫ সালে ইসরায়েলের একটি পরিত্যক্ত পুকুরে প্রথম এই ব্যাকটেরিয়া পাওয়া যায়। নব্বইয়ের দশকের শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এই কীটনাশক ব্যবহার করছে। বিটিআইয়ের ব্যবহার আছে সিঙ্গাপুরেও। ভারতের কলকাতা মিউনিসিপ্যালিটি ১৯৯৬ সাল থেকে বিটিআই ব্যবহার করছে। মশা মারতে বিটিআই অনেকটা লার্ভিসাইডের মতো স্প্রে করতে হয়। ২৫ গ্রামের এক প্যাকেট বিটিআই ১০ লিটার পানিতে ২৫ থেকে ৫০ বর্গমিটার এলাকায় ছিটাতে হয়। এ ব্যাকটেরিয়া প্রচুর পরিমাণে টক্সিন তৈরি করতে পারে, যার প্রভাবে কীটপতঙ্গের খাদ্য গ্রহণ বন্ধ হয়ে যায়। এর ব্যবহারে মানুষ, পোষা প্রাণী, গবাদি পশু এবং উপকারী পোকামাকড়ের ক্ষতি হয় না। তবে চোখে লাগলে দৃষ্টিশক্তি এবং ত্বকের ক্ষতি হতে পারে। নদীনালা, পুকুর ও খালের মতো জলাশয়ে বিটিআই স্প্রে করা যায়। বদ্ধ পানিতে বিটিআই প্রয়োগ করলে এটি মশার লার্ভা মেরে ফেলে। তা ছাড়া ফুলের টব, খালি পাত্র ও টায়ারে জমে থাকা পানিতেও ব্যবহার করা যায়। ওষুধের কার্যকারিতা থাকে ৩০ দিন।
ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ জানায়, গেল বছরের সনদ ও পণ্য জালিয়াতির পর এবার ডিএনসিসি নিজেরাই সরাসরি সিঙ্গাপুর থেকে এ জৈব কীটনাশক আনছে। এ জন্যে উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে ৪ প্রকারের বিটিআই আমদানির সনদও নেয়া হয়েছে। বিটিআই আমদানির বিষয়ে সিঙ্গাপুরের ‘বেস্ট কেমিক্যাল’ কোম্পানির সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে ডিএনসিসি। উদ্ভিদ সংরক্ষণ উইং থেকে জৈব কীটনাশক বিটিআই আমদানি করতে এরই মধ্যে রেজিস্ট্রেশনও সম্পূর্ণ হয়েছে।
ডিএনসিসি জানায়, দেশে এখন পর্যন্ত ৮টি কোম্পানি বিভিন্ন প্রকারের বিটিআই আনার অনুমতি পেয়েছে। তার মধ্যে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন তরল, ট্যাবলেট, পাউডার ও দানাদার- এ চার প্রকারের বিটিআই আনার অনুমতি পেয়েছে। উন্মূক্ত দরপত্র ছাড়াই মশার ওষুধ ক্রয় ও আমদানি করতে মন্ত্রণালয়ে আবেদনও করে ডিএনসিসি।
অবশেষে গত বৃহস্পতিবার উন্মুক্ত দরপত্র ছাড়াই মশার ওষুধ ক্রয় ও আমদানি করার অনুমোদন পেয়েছে সংস্থাটি। মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কীটনাশক ক্রয়/আমদানির নীতিগত অনুমোদন দিয়েছে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটি। সচিবালয়ে বুধবার (৮ মে) মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের সভাপতিত্বে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে এ প্রস্তাবের অনুমোদন দেয়া হয়।
বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সমন্বয় ও সংস্কার সচিব মো. মাহমুদুল হোসাইন খান জানান, স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে অর্থনৈতিক বিষয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠকে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম নিরবচ্ছিন্ন রাখতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কর্তৃক সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে কীটনাশক ক্রয়/আমদানির প্রস্তাব নিয়ে আসা হয়। সভায় আলোচনার মাধ্যমে প্রস্তাবটির নীতিগত অনুমোদন দেয়া হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসির) মেয়র আতিকুল ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, বিটিআই হচ্ছে বায়োলজিক্যাল ট্রিটমেন্টের মধ্যে উত্তম প্রস্তাব। এটি নিয়ে আমরা অলরেডি কাজ করেছি। সিঙ্গাপুর থেকে নতুন করে বিটিআই আনার জোর প্রক্রিয়া চলছে। মন্ত্রিসভার অনুমোদনের অপেক্ষা ছিল। মন্ত্রিসভা কমিটি অনুমোদন দিয়েছে; এখন খুব শিগগিরই এয়ারে করে বিটিআই নিয়ে আসব। মেয়র বলেন, আগেরবার বিটিআই কিনতে গিয়ে আমাদের শিক্ষা হয়েছে। এবার বিটিআই কোনো ঠিকাদারের মাধ্যমে আনা হবে না। বিটিআই যারা উৎপাদন করে, তাদের কাছ থেকেই সরাসরি আনা হবে।
ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, বিটিআই হাতে এলে তা তাৎক্ষণিক প্রয়োগ না করে অল্প কিছুদিন সময় হাতে নিয়ে এটি প্রয়োগের কলাকৌশল ও কার্যকারিতা আগে পরীক্ষা করা হবে। কীটনাশকটি সিঙ্গাপুর থেকে ডিএনসিসিরি হাতে আসার পর স্বাস্থ্য বিভাগ সিঙ্গাপুরের একটি বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে বৈঠক করবেন। কর্মকর্তারা বিশেষজ্ঞ টিমের কাছ থেকে জানবেন, বিটিআই কীটনাশকটি কীভাবে মিক্সিং হবে, কীভাবে ও কোথায় ব্যবহার হবে। এরপর ডিএনসিসির এলাকায় বিটিআই প্রয়োগ করা হবে।
জানতে চাইলে ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মীর খায়রুল আলম বলেন, বিটিআই আনার প্রক্রিয়া চলছে। তবে কবে নাগাদ আসছে তা নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। তিনি বলেন, মন্ত্রিসভার অনুমোদন কপি হাতে পাওয়ার পর আমরা ঠিক করব কবে, কোন প্রক্রিয়ায় বিটিআই আনা হবে। আশা করছি দ্রুত সময়ের মধ্যেই আমরা এই কীটনাশক আনতে পারব। একই ধরনের নতুন ওষুধটির নাম ‘বিটিএস’ হবে বলেও জানান তিনি।
ডিএনসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ইমরুল কায়েস চৌধুরী বলেন, ডিএনসিসিতে মশা মারতে জৈব কীটনাশক বিটিআই আনার প্রক্রিয়া প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে এটি হাতে এলে সঙ্গে সঙ্গেই প্রয়োগ করা হবে, এমনটা নয়। প্রথমত, যে ওষুধ এলো সেটি কার্যকর কি না এবং ভেতরে যে উপকরণগুলো থাকার কথা তা আছে কি না, সেটি পরীক্ষা করা হবে। এছাড়া মশককর্মীদের এই ওষুধ প্রয়োগের আগে মেশানোর বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ফিল্ড টেস্ট অর্থাৎ কার্যকারিতার বিষয়েও নিশ্চিত হওয়া যাবে।
ইমরুল কায়েস আরো বলেন, চলমান মশানিধন অভিযানকে আরো জোরদার ও কার্যকর করার জন্য তিনজন কীটপতঙ্গবিদকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এনাটমি ল্যাব স্থাপনের জন্য। মশা নিয়ন্ত্রণে উচ্চক্ষমতার টারবাইন মেশিন কেনার প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে জানিয়ে তিনি বলেন, এই মেশিনের সাহায্যে অতি অল্প সময়ে বিস্তীর্ণ এলাকায় কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। কীটনাশকের কার্যকারিতা নতুন করে পরীক্ষা করা হচ্ছে। এডিস মশাসহ অন্যান্য মশা মারতে পুরনো ওষুধ ছেটানোর পরিবর্তে গত বছর প্রথমবারের মতো জৈব কীটনাশক বিটিআই (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসিস) প্রয়োগের উদ্যোগ নেয় ডিএনসিসি।
তবে বিটিআই কীটনাশক সরবরাহ প্রতিষ্ঠান মার্শাল অ্যাগ্রোভেট কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের জালিয়াতির কারণে তা আর ব্যবহার করা হয়নি। এ বছর নিজেরাই বিটিআই আমদানি করার সিদ্ধান্ত নেয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। আগামী দুই মাসের মধ্যে এই জৈব কীটনাশক আনা হবে বলে গত ২০ মার্চ জানিয়েছিলেন ডিএনসিসির মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। এরপর প্রায় দুই মাস পর বিটিআই আনার প্রক্রিয়া গুছিয়ে এনেছে সংস্থাটি। বিটিআই প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া। যা মাটিতে পাওয়া যায়। এই কীটনাশকের পুরো নাম (বাসিলাস থুরিনজেনসিস ইসরায়েলেনসি)।

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, বিটিআই প্রাকৃতিক, সাশ্রয়ী ও টেকসই। এটি মূলত পেটের বিষক্রিয়াসহ মাইক্রোবায়াল উৎসর একটি নিম্ন-বিষাক্ত কীটনাশক হিসেবে ব্যবহার করা যায়। ব্যাকটেরিয়াটি বড় টক্সিন তৈরি করতে পারে, যা কীটপতঙ্গের খাওয়া বন্ধ করে দেয়। জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, যেসব জায়গায় এখন বিটিআই ব্যবহার হচ্ছে, সেখানে এটা বেশ কাজে দিচ্ছে। ঢাকাতেও এটা কাজে দেবে আশা করা যায়। তবে সঠিকভাবে, সঠিকমাত্রায়, সঠিক জায়গায় সঠিক সময়ে প্রয়োগ করা গেলে বিটিআই ভালো ফলাফল দেয়।