রবীন্দ্রনাথের গানই চিরকাল মানুষের মনে বেঁচে থাকবে

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

শ্রাবণী সেন
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে নিজেকে সমর্পণ করেছেন শুধু রবীন্দ্রগানে। শৈশব থেকে বাড়ির পরিবেশে এবং মায়ের শিক্ষা ও চর্চায় ধ্যান-জ্ঞান বলতে ছিল রবীন্দ্রনাথ এবং তারই গানের বিশাল ভাণ্ডার। পঁয়ত্রিশটি বছর শুধু সেই গানে নিয়োজিত রাখলেও এখনো তার মনে হয়, ‘আমার পথ-চলার আরো কত যে বাকি। যা চেয়েছি, যা পেয়েছি, তা তো বিশাল রবীন্দ্র-ভাণ্ডারের অংশ মাত্র। আমার জীবনকালে সেই পরিপূর্ণতা না এলেও পরের জন্মেও আমি খুঁজে নিতে চাই রবীন্দ্রগানের অমৃত সুধারস।’
রবীন্দ্রগানের এই মাহাত্ম্য কতজন-ই বা উপলব্ধি করতে পারেন? এই নিয়ে সন্দেহ আছে প্রখ্যাত রবীন্দ্রসংগীতশিল্পী শ্রাবণী সেনের মনেও। রবীন্দ্রনাথকে না চিনে, না বুঝে অনেকেই তার গান গাইছেন। কিন্তু প্রশ্ন, কতটা ‘শুদ্ধ’ সেই গান? অভিমানী শ্রাবণী প্রতিবাদ না জানিয়ে পারলেন না। বলছেন, ‘গানের দুই কলি শিখতে না শিখতেই স্টেজে উঠে পড়েছেন অনেকেই। গানের আগে ও পরে সাময়িক বিরতি দিয়ে নিজের ডায়ালগ (রবীন্দ্রনাথের নয়) জুড়ে দিয়ে শ্রোতাদের কাছে কদর বাড়াচ্ছেন। কেউ কেউ গলা কাঁপিয়ে প্রকৃত গানের সুরকেই বিকৃত করে দিচ্ছেন। কিছু শিল্পীর জন্য গানের বাজার নষ্ট হচ্ছে।’
তা হলে রবীন্দ্রগান কি এখন পুরোপুরি অভিভাবকহীন? এমন প্রশ্ন অনেক সময় শ্রোতাদের কাছ থেকেও শুনতে হয়। উপায়ও নেই মানছেন শ্রাবণী। কারণ সেই অভিভাবককে খুঁজে দেবেন কে? ‘বিশ্বভারতী না হলেও এমন একজন রবীন্দ্র-বিশেষজ্ঞকে দায়িত্ব দেয়া হোক যিনি শুরু থেকেই গানের নামে কোনো বজ্জাতি মেনে নেবেন না। ইতিমধ্যেই এই বিষয়ে নানা জনে নানা কথা বলছেন। প্রতিবাদের ভাষাও জোরালো হচ্ছে।’
শ্রাবণীর ধারণা, নতুন প্রজন্মের কাছে শুধু সঠিক বার্তা নয়, তাদের গানের ভুল-ত্রæটিগুলোও ধরানো দরকার। যেমন এর দৃষ্টান্ত তিনি নিজেই। বললেন, ‘দু’-এক বছর আগে এক উঠতি শিল্পীকে ডেকে বললাম, তার গাওয়া গানে কোথায় এবং কী সমস?্যা হচ্ছে। গান কখনো মাড়ি চেপে হয় না। বাড়িতে অভ?্যাস করো। গানের গতি বদলে যাবে। ঠিক এক বছর বাদে যখন তার গান শুনলাম, সেই সমস্যা কাটিয়ে সে আরও পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।’
শ্রাবণীর বিশ্বাস, অন?্যান?্য অভিজ্ঞ শিল্পীরাও যদি এমন ভাবে এগিয়ে আসেন তবে শুদ্ধ রবীন্দ্রসংগীতের প্রভাবে অবাঞ্ছিত বেনোজলের দাপট কমতে বাধ?্য। প্রতি বছর রবীন্দ্রজয়ন্তী এলেই এই প্রজন্মের কিছু শিল্পীর আচরণ যেন বদলে যায়। এই দিনটি যেন রবীন্দ্রনাথকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য নয়, কতগুলো গান কে গাইল তার হিসাব এবং প্রচার চলতে থাকে দিনভর।
‘এমনও দেখি অনুষ্ঠানে হন্তদন্ত হয়ে ঢুকে শিল্পী বলছেন, এতগুলো গান এত সব অনুষ্ঠানে করে এলাম। এখনও এত বাকি। আর কিছু নয়, তাদের কাছে আমার বিনীত প্রশ্ন, এই ধকল এবং শারীরিক পরিশ্রমে তাদের গাওয়া গানের প্রকৃত মাধুর্য সত্যিই কি শ্রোতাদের কাছে পৌঁছাতে পেরেছিল? এটা হয় না। সম্ভবও নয়। তার ওপর, তারা মাত্র কয়েকটি নির্বাচিত গান ঘুরে ফিরে শোনাচ্ছেন শ্রোতাদের। এই বিশাল গানের ভাণ্ডার থেকে অশ্রæত গান শোনাবার আগ্রহ তাদের একদমই নেই। কারণ সময় ও চর্চার বড় অভাব তাদের।’
ইদানীং তো রবীন্দ্রজয়ন্তীর হিড়িক আরো বেড়েছে। পরিসংখ্যান তাই বলছে। শ্রাবণীর কথায়, ‘তা বাড়ুক ক্ষতি নেই। খেয়াল করে দেখলাম অনুষ্ঠান বাড়লেও কিন্তু কমতে শুরু করেছে সেই সব শিল্পীর আনাগোনা। যারা দ্রুত রবীন্দ্রগানের হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছিল। স্বপ্ন আছে, অথচ সাধ্যি নেই। কণ্ঠ আছে, কিন্তু চর্চা নেই। ফলে যা পরিণাম হওয়ার তাই হয়েছে। রবীন্দ্রগানের এই বিশাল অঙ্গনে নতুন প্রতিভার অন্বেষণ কেমন যেন থমকে আছে।’ তবে শ্রাবণীর বিশ্বাস, রবীন্দ্রনাথের গানই চিরকাল মানুষের মনে বেঁচে থাকবে, অন্য কিছু নয়।