মুখ ও মুখোশ
বাংলাদেশি সিনেমার যাত্রা শুরু

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ১৭ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

ছবি: সংগৃহীত
১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট শাহবাগ হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় মুখ ও মুখোশ ছবির মহরত, আর ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তি পায় ইতিহাস সৃষ্টিকারী এ ছবিটি। মেলার পাঠকদের জন্য আজ রইল বাংলাদেশের ইতিহাস সৃষ্টিকারী প্রথম চলচ্চিত্রটির আদ্যোপান্ত। লিখেছেন মেলা প্রতিবেদক
তখন এমন একটি সময় যখন ব্রিটিশরা এ অঞ্চল ছেড়েছে, কিন্তু চলছে পাকিস্তান শাসন। তখনো পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমান বাংলাদেশ) নিজস্ব কোনো চলচ্চিত্র শিল্প গড়ে ওঠেনি। ঢাকাসহ প্রধান শহরগুলোর সিনেমা হলগুলোতে কলকাতা কিংবা লাহোরের চলচ্চিত্র দেখানো হতো। সে সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের চলচ্চিত্র প্রযোজক, গুলিস্তান সিনেমার মালিক অবাঙালি এফ দোসানির পূর্ব পাকিস্তানে চলচ্চিত্র প্রযোজনার ব্যাপারে নেতিবাচক মন্তব্য করেন। অন্য বাঙালিদের মতো সে সময়ে ফুঁসে ওঠেন নাট্যজন আব্দুল জব্বার খান। সৃষ্টি হয় নতুন এক অধ্যায়ের, নির্মিত হয় ‘মুখ ও মুখোশ’ নামক বাংলাদেশের প্রথম চলচ্চিত্র।
বাংলা ১৩২২ সনের ৭ বৈশাখ (১৯১৬ইং) তারিখে মুন্সীগঞ্জের লৌহজং উপজেলার উত্তর মসদগাঁও নামক স্থানে জন্মগ্রহণ করেন আব্দুল জব্বার খান। তার পিতা হাজি মোহাম্মদ জমশের খান পাটের ব্যবসা করতেন। শৈশবে স্কুলজীবন থেকেই তিনি জড়িয়ে পড়েন নাটকের সঙ্গে। অভিনয় করেন বেহুলা, সোহরাব রোস্তমের মতো নাটকে। ভারতের বিখ্যাত অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক প্রমথেশ বড়–য়ার সঙ্গে সখ্যের দরুন চলচ্চিত্রের প্রতি ঝোঁক সৃষ্টি হয় তার। ১৯৪১ সালে আহসানুল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল থেকে ডিপ্লোমা করে যোগ দেন চাকরিতে। ১৯৪৯ সালে পাকাপোক্তভাবে ঢাকায় চলে আসেন তিনি, এখানে সংগঠিত করেন কমলাপুর ড্রামাটিক অ্যাসোসিয়েশন। এ সংগঠনের উদ্যোগেই তিনি টিপু সুলতান ও আলীবর্দী খানের মতো নাটক মঞ্চায়ন করেন। এরপর রচনা করেন ‘ঈসাখাঁ’ (১৯৫০), ‘প্রতিজ্ঞা’ (১৯৫১), ‘ডাকাত’ (১৯৫৩), ‘জগোদেশ’ (১৯৫৯)।
অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে ছবিটি নির্মাণের উদ্যোগ নিলেও আব্দুল জব্বার খানের ছিল না তেমন পূর্ব অভিজ্ঞতা। ‘মুখ ও মুখোশ’ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের জন্য প্রাথমিক গল্প হিসেবে আব্দুল জব্বার খান ডাকাত নাটকের পাণ্ডুলিপি এবং সঙ্গে কবি জসীমউদ্দীন, কাজী নজরুল ইসলামের কিছু বই নিয়ে কলকাতায় যান। তার সফরসঙ্গী ছিলেন কিউ এম জামান, যিনি কলকাতা ও মুম্বাইয়ে সহকারী পরিচালকের কাজ করেছেন। জামানের সহযোগিতায় পরিচয় হয় কলকাতার চিত্রনাট্যকার মনি বোসের সঙ্গে, যিনি গল্প বাছা এবং প্রাথমিক চিত্রনাট্যের কাজটি করে দেন। ঠিক হয় আব্দুল জব্বারের লেখা ‘ডাকাত’ নাটকের গল্প থেকেই নির্মিত হবে ছবি। কলকাতায় তিনি আরো দেখা করলেন কিউ এম জামানের বস চিত্রগ্রাহক মুরারী মোহনের সঙ্গে, যার পরামর্শক্রমে কেনা হলো পুরনো একটি ক্যামেরা।
ছবির চিত্রগ্রহণের কাজটি শেষমেশ করেন আব্দুল জব্বারের কলকাতা সফরসঙ্গী এই কিউ এম জামানই। ছবির মেকআপ ম্যান হিসেবে আসেন কলকাতা থেকে শ্যাম বাবু। সমর দাসের সংগীত পরিচালনায় ছবির গানে কণ্ঠ দেন আবদুল আলীম ও মাহবুবা হাসনাত। শব্দগ্রহণ করেন মইনুল ইসলাম। পোস্টার ডিজাইন করেন সুভাষ দত্ত। ছবির প্রধান চরিত্রে হাজির হলেন অভিনেতা ইনাম আহমেদ। দ্বিতীয় প্রধান পুরুষ চরিত্রে অভিনয় করেন স্বয়ং আব্দুল জব্বার খান। ছবির নায়িকা হলেন চট্টগ্রামের মেয়ে পূর্ণিমা সেন। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন নাজমা (পিয়ারী), জহরত আরা, আলী মনসুর, রফিক, নুরুল আনাম খান, সাইফুদ্দীন, বিলকিস বারী প্রমুখ।
শুটিংয়ের মূল স্থানগুলো ছিল সিদ্ধেশ্বরী, তেজগাঁও, রাজারবাগ, কমলাপুর, লালমাটিয়া, জিঞ্জিরা এবং টঙ্গীর নানা জায়গা। বাংলা ভাষায় নির্মিত প্রথম এ সিনেমার দৈর্ঘ্য ছিল ৯৯ মিনিট। ১৯৫৪ সালের ৬ আগস্ট শাহবাগ হোটেলে অনুষ্ঠিত হয় মুখ ও মুখোশ ছবির মহরত। ওই অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ইসকান্দার মীর্জা। আসলে ছবির আনুষ্ঠানিক এ মহরত অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রায় ৮ মাস আগেই শুরু হয়েছিল ছবির শুটিং, কোনো প্রকার মহরত ছাড়াই। ছবির দৃশ্যধারণ এরপর চলে ১৯৫৫ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত। অসামাজিক কর্মকাণ্ড, পারিবারিক কলহ ও দুর্নীতির মতো বিষয়বন্তু নিয়ে নির্মিত হয় ‘মুখ ও মুখোশ’।
স্থানীয় অভিনেতারা সিনেমায় অভিনয়ের পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়াই অভিনয় করেন এতে, অবশ্য সেটা বিনা পারিশ্রমিকেই। ঢাকায় স্থানীয়ভাবে কোনো ফিল্ম স্টুডিও না থাকায় ছবির নেগেটিভ ডেভেলপের জন্য একে পাঠানো হয় লাহোরে। লাহোরের শাহনূর স্টুডিওতে এ ছবির পরিস্ফূটন কাজ সম্পন্ন হয়। সিনেমাটির সম্পাদনা করেন পশ্চিম পাকিস্তানে আব্দুল লতিফ। মুখ ও মুখোশের প্রথম প্রদর্শনী হয় লাহোরে। ঢাকায় ফিরে আসার পর ছবিটি প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনীর বিষয়ে কোনো হল মালিক আগ্রহ দেখাচ্ছিল না।
ছবি মুক্তির আগেই লোকমুখে চাউর হয় এটা নাকি কোনো ছবিই হয়নি! দর্শক হলে গিয়ে ছবি দেখে অসন্তুষ্টিতে হলের চেয়ারও ভেঙে ফেলতে পারে। তবে এমন অবস্থায় আব্দুল জব্বার খানের পাশে দাঁড়ান মুকুল আজাদ ও রূপমহল সিনেমা হলের মালিক কমল বাবু। তিনি রাজি হন ছবিটি মুক্তি দিতে। ১৯৫৬ সালের ৩ আগস্ট মুক্তির তারিখ হয়। ছবি উদ্বোধন করলেন তখনকার গভর্নর শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। ছবি শেষে নিন্দার বদলে বাহবাই পান আব্দুল জব্বার। জিত হয় বাঙালি জাতির।