ঘুরে দাঁড়াচ্ছে ন্যাশনাল ব্যাংক

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০১ আগস্ট ২০২৪, ১২:০০ এএম
প্রিন্ট সংস্করণ

তৌহিদুল আলম খান
ভোরের কাগজ : এক সময়ের সেরা ব্যাংক বর্তমানে খারাপ অবস্থায় পতিত হয়েছে। কেন ব্যাংকটির এই অবস্থা এবং উত্তরণের উপায় কী? আর মাত্র ছয় মাসে কী কৌশল অবলম্বন করে গত জুন মাসে ব্যাংকটিকে মাসিক মুনাফায় ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হলেন?
তৌহিদুল আলম খান : একটা সময় পর অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে খেলাপি ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে ন্যাশনাল ব্যাংক। দক্ষ ও সৎ ব্যবস্থাপনায়ও ভাটা পড়ে। চলতি বছরের জানুয়ারির ২৫ তারিখে আমি যোগ দেই। এখানে যোগ দিয়ে প্রথমেই এর ইতিহাস ঘেটে প্রথমেই দেখলাম- কোনো নিয়মকানুন না মেনে, খারাপ ঋণ বিতরণ করা হয়েছে, যা ব্যাংকটিকে নেতিবাচক অবস্থায় নিয়ে গিয়েছে। আমি প্রথমেই খেলাপি ঋণ আদায়ে সক্রিয় হলাম। এ পদক্ষেপের ফলে দীর্ঘ আড়াই বছর পর ব্যাংকটি মাসিক মুনাফায় ফিরেছে। জুন মাসের অনিরীক্ষিত মাসিক মুনাফা হয়েছে টাকা ৭৪ দশমিক ৫১ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে আমরা আদায় করেছি প্রায় ৬০০ কোটি টাকা। এ কাজটি আমাদের জন্য এত সহজসাধ্য ছিল না। এজন্য আমাদের শাখাগুলোর জনবল ও প্রধানকার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের নিরলসভাবে দক্ষতার সঙ্গে এ কাজ করেছেন। তবে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে আকাক্সিক্ষত ও পূর্ব পরিকল্পিত খেলাপি ঋণ আদায় সম্ভব না হলে এই মুনাফার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন হবে।
ভোরের কাগজ : এ সফলতার জন্য কী ধরনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছিলেন? ব্যাংকের অন্যান্য কর্মকর্তারা আপনাকে কীভাবে সহযোগিতা করেছে?
তৌহিদুল আলম খান : প্রথমেই যথাযথ সংস্কারের মাধ্যমে ব্যাংকের আইন বিভাগকে শক্তিশালী করি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে, আইন বিভাগের একজন নতুন বিভাগীয় প্রধান নিয়োগের পাশাপাশি কিছু কর্মকর্তাকে ওই বিভাগে পদায়ন ও সংস্কারের মাধ্যমে বিভাগটি শক্তিশালী করি। এছাড়া দুজন উপব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেয়া হয় যারা নিজেদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে স্ব স্ব ক্ষেত্রের সমস্যা চিহ্নিতকরণ এবং চিহ্নিত বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের পরামর্শ নেয়ার পাশাপাশি সুদূরপ্রসারী, সময়োপযোগী ও কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে সক্ষম।
খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সরাসরি তত্ত্বাবধানে একটি ‘রিকভারি টাক্সফোর্স’ গঠন করি। বড় বড় ঋণ আদায়ের জন্য ঋণগ্রহীতাদের সঙ্গে যোগাযোগসহ ঋণ খেলাপিদের কাছে আমি নিজেই যাওয়া শুরু করি। ফলে ঋণগ্রহীতাদের বুঝাতে সক্ষম হই যে, ব্যাংকের টাকা ফেরত না দিয়ে আর স্বস্তিতে থাকা যাবে না। এ প্রক্রিয়ায় ঋণ আদায়ে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সফলতা পাওয়ার পর একাধিক বড় বড় ঋণগ্রহীতা নিজে থেকেই আমাদের কাছে খেলাপি ঋণের বিষয়ে সমাধানের জন্য আসছেন- যা ব্যাংকের জন্য একটি ইতিবাচক দিক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনার আলোকে যথাসম্ভব ছাড় দিয়ে দীর্ঘদিনের খেলাপি ঋণের সময়সীমা দিয়ে সম্পূর্ণ আদায়ের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়েছে।
অর্থাৎ নিয়ম অনুযায়ী, যদি কোনবিতরণকৃত ঋণ বিরূপ/মন্দ মানে শ্রেণিকৃত হয়, সেক্ষেত্রে নগদ যা আদায় হবে তাই ইন্টারেস্ট সাসপেন্স থেকে আয় খাতে স্থানান্তর করা যায়। জুনে মুনাফা করার ক্ষেত্রে এটি একটি বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে।
বিভিন্ন সূচকের আলোকে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বিবেচনায় আমরা শাখাগুলোকে ভালো এবং মন্দ দুই ভাগে ভাগ করি। এছাড়া কিছু ঋণ ছিল যেগুলো খেলাপি দেখানো উচিত কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে তাদের খেলাপি দেখানো হচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী এদেরও খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সিআইবি-তে রিপোর্ট করা হয়। তবে বড় গ্রুপকে খেলাপি হিসেবে রিপোর্ট করার ফলে অনেক বড় ঋণগ্রহীতারা স্ব-ইচ্ছায় এগিয়ে আসতে শুরু করেন। এ কাজটি ঋণ নিয়মিতকরণের ক্ষেত্রে টনিকের মতো কাজ করেছে।
আমরা ব্যাংকের সবগুলো শাখা প্রধানদের নিয়ে নিয়মিত ভার্চুয়াল (জুম) মিটিংয়ের মাধ্যমে নিয়মিত মনিটরিং-সংক্রান্ত কার্যক্রম তদারকি করে থাকি। পাশাপাশি আমি ব্যক্তিগতভাবে ঢাকাসহ সারাদেশের বিভিন্ন শাখা সশরীরে পরিদর্শন শুরু করি। এতে করে ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আরো উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এক্ষেত্রে সব সহকর্মীদের ই-মেইল করে একটি স্লোগান নির্ধারণ করে দিলাম- ‘টুগেদার টাওয়ার্ডস ট্রাম্প’ বা ‘ট্রিপল টি’। অর্থাৎ সবাই মিলে একসঙ্গে শীর্ষে যাব। ঋণ আদায়ের অগ্রগতি ও হালনাগাদ তথ্য আদান-প্রদানের জন্য শাখাপ্রধানসহ প্রধান কার্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত অন্যান্য কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ত করে একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ চালু করে নিয়মিত যোগাযোগ অব্যাহত রাখি।
ভোরের কাগজ : আমরা জেনেছি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে, অতীতে সংঘটিত বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্যই ব্যাংকটি একটি খারাপ অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে কি কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন?
তৌহিদুল আলম খান : যে সব কর্মকর্তা ও কর্মচারী পূর্বেকার অনেক অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাদের বিরুদ্ধে অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষার মাধ্যমে দায়-দায়িত্ব নিরূপণ করা হচ্ছে। দায়ী কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের কার্যক্রম চলমান আছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকের অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ও পরিপালন-সংক্রান্ত বিষয়ে জিরো টলারেন্স পলিসি নেয়া হয়েছে। একটি দক্ষ ও প্রফেশনাল ‘বোর্ড অডিট কমিটি’ গঠন করা হয়েছে যার দিকনির্দেশনায় সব ধরনের অডিট কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং নিয়মিত সভা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সুচারুভাবে এ বিষয়গুলো তদারকি করা হচ্ছে যাতে ব্যাংকটিতে শীঘ্রই সুশাসন ফিরিয়ে আনা যায়।
ভোরের কাগজ : ব্যাংকটিকে ঘুরে দাঁড়াতে আপনাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কী? নতুন পরিচালনা পর্ষদ এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা দিয়েছেন কি?
তৌহিদুল আলম খান : ন্যাশনাল ব্যাংকে অনেক বড় বড় গ্রাহক রয়েছেন যারা আমাদের নিয়মিত এবং অনেক পুরনো এবং নিয়মিত লেনদেন করেন। ব্যাংকের জন্মলগ্ন থেকেই তারা আমাদের সঙ্গে আছেন। ব্যাংক সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু সংবাদের জন্য সাময়িক যে ক্ষতি হয়েছে সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়াতে আমাদের বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় হচ্ছে- আমাদের এখন যে পরিচালনা পর্ষদ আছে, তাদের সবাই প্রফেশনাল এবং তারা সবাই স্ব স্ব স্থানে সফল ব্যক্তি। তাদের গঠনমূলক পরামর্শ, সুদূরপ্রসারী চিন্তাভাবনা ও নির্দেশনা আমাদের জন্য একটি বড় শক্তি যা ব্যাংকটিকে নিকটতম সময়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে সহযোগিতা করবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ভোরের কাগজ : আপনি দায়িত্ব নিয়েছেন ছয় মাস। এই সময়ের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে কোন বিষয়টিকে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে মনে করেন?
তৌহিদুল আলম খান : আমি আগেই বলেছি ব্যাংকটিতে বেশ কিছু বড় অঙ্কের খারাপ ঋণ আছে। অতীতে অনেক অনিয়মও দুর্নীতি হয়েছে। এগুলোকে অতিক্রম করে এত শিগগির সুশাসনের দিকে এগিয়ে যাওয়া এত সহজ কাজ নয়। কারণ অতীতের পুঞ্জিভূত অনিয়মের সঙ্গে যারা জড়িত এবং দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেয়ার বিষয়টি এতদিন দৃশ্যমান হয়নি। বর্তমানে আইনগত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দায়ী ব্যক্তিদের শাস্তি দেয়াই হচ্ছে একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
ভোরের কাগজ : ব্যাংকের ডিপোজিট বাড়াতে এবং গ্রাহক আকৃষ্ট করতে নতুন কোনো পণ্য বাজারে এনেছেন কি না? আনলে সেগুলো কী কী? এ পর্যন্ত আপনার আমাদের ডিপোজিট মোবিলাইজেশনে আরো কী কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
তৌহিদুল আলম খান : এখন আমাদের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে বিদ্যমান আমানত ধরে রাখা এবং নতুন আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে আমানত বাড়ানো। এক্ষেত্রে আমরা ক্ষুদ্র আমানত বাড়ানোর জন্য কিছু বিশেষ পদক্ষেপ নিয়েছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বিশেষ বিশেষ সেগমেন্টের কথা চিন্তা করে আমরা কিছু ডিপোজিট প্রডাক্ট চালু করেছি। যেমন : প্রয়োজন, ট্রিপল বেনিফিট স্কিম এবং নিশ্চিন্ত অবসর। এছাড়া নারীদের জন্য একটি বিশেষ ডিপোজিট পণ্য চালু করেছি যার নাম ‘এনবিএল জোনাকি’। এর বাইরে কিছু পুরনো ডিপোজিট পণ্য আমরা নতুন করে শুরু করেছি। তার মধ্যে রয়েছে, কোটিপতি স্কিম, সোনার বাংলা স্কিম’ এবং ‘এনবিএল শিক্ষার্থী’।
ভোরের কাগজ : বর্তমানে আপনারা কি নতুন কোনো বিনিয়োগে যাচ্ছেন? যেসব শাখা ভালো পারফরমেন্স করতে পারছে না সেগুলোর জন্য কী পদক্ষেপ নিয়েছেন?
তৌহিদুল আলম খান : আমরা নতুন বিনিয়োগে কিছু কৌশল অবলম্বন করেছি। বিনিয়োগের ক্ষেত্রে কৃষি, ভোক্তা এবং এসএমই অর্থাৎ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের দিকেই বেশি জোর দিচ্ছি। ব্যাংকের বিশাল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সারা দেশব্যাপী এ ধরনের বিনিয়োগ যেমন বিভিন্ন উদ্যোক্তা তৈরিতে সহায়তা করবে তেমনি বিনিয়োগ ঝুঁকিও হ্রাস পাবে।
ভোরের কাগজ : ডিজিটাল বাংলাদেশে আপনার ব্যাংকটিকে কতটুকু ডিজিটালাইজড করেছেন?
তৌহিদুল আলম খান : ‘এনবিএল আই পাওয়ার’ নামে যে ডিজিটাল অ্যাপস রয়েছে তা অন্যান্য ভালো ব্যাংকের মতো বেশ কিছু আধুনিক বৈশিষ্ট রয়েছে ও সুবিধা রয়েছে। এছাড়া আরো কিছু স্পেশাল অ্যাপস তৈরি করা হচ্ছে যা আমরা অচিরেই গ্রাহকদের সামনে উপস্থাপন করব। এনবিএল ‘কিউপে’ নামে প্রবাসীদের জন্য আমাদের আলাদা একটি অ্যাপস রয়েছে যার মাধ্যমে প্রবাসীরা অতি সহজেই রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন। সমপ্রতি ন্যাশনাল ব্যাংকের ওয়েবসাইটটিকে নতুন করে ঢেলে সাজিয়েছি। আমি মনে করি, যে কোনো প্রতিষ্ঠানের আয়না হচ্ছে ওই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট। তাই আমরা চেষ্টা করেছি গ্রাহকবান্ধব একটি ওয়েবসাইট তৈরি করতে। এছাড়া ফেসবুক, লিংকডইনসহ অন্যান্য সোসাল মিডিয়াগুলোতে ন্যাশনাল ব্যাংকের সব কর্মকাণ্ডকে উপস্থাপনের জন্য জোর দিচ্ছি।