গ্রামের উন্নয়নই উন্নত বাংলাদেশ

মুহাম্মাদ শরিফুর রহমান
প্রকাশ: ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, ০৪:২৪ এএম

মুহাম্মাদ শরিফুর রহমান, চেয়ারম্যান, এসডিজি মডেল ভিলেজ বাংলাদেশ
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়ন একটি যুগান্তকারী উদ্যোগ। জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০১৫ সালে গৃহীত ১৭টি অভীষ্ট এবং ১৬৯টি লক্ষ্য ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জনের জন্য বাংলাদেশ প্রতিশ্রুতি-বদ্ধ। এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের মধ্য দিয়ে একটি টেকসই, ন্যায়সঙ্গত ও উন্নত সমাজ গড়ে তোলার সম্ভাবনা রয়েছে।
গ্রাম-ভিত্তিক উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা
বাংলাদেশের প্রায় ৬০% মানুষ গ্রামে বাস করে। গ্রামই বাংলাদেশের অর্থনীতি, সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মূল ভিত্তি। কিন্তু দারিদ্র্য, বেকারত্ব, অপর্যাপ্ত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, এবং বৈষম্যের মতো চ্যালেঞ্জ এখনও গ্রামীণ জনপদের উন্নয়নকে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। গ্রাম-ভিত্তিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করতে হলে এসডিজি বাস্তবায়নকে গ্রামীণ জীবনের কেন্দ্রে নিয়ে আসতে হবে। এর মাধ্যমে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূলধারায় যুক্ত করা সম্ভব হবে।
এসডিজির জন্য আদর্শ গ্রাম
একটি আদর্শ এসডিজি মডেল ভিলেজ এমন একটি সমাজ যেখানে প্রতিটি লক্ষ্য গ্রামীণ জীবনে বাস্তবায়িত হবে। এটি হতে পারে একটি উন্নয়নের নমুনা যা সারা দেশের গ্রামগুলোতে প্রয়োগযোগ্য। প্রত্যেক পরিবারের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা নিশ্চিত করতে হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কুটির শিল্প এবং কৃষি-ভিত্তিক অর্থনীতিকে টেকসই করতে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, সেচ ব্যবস্থা, এবং খাদ্য সংরক্ষণের আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার নিশ্চিত করে ক্ষুধা মুক্ত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
স্বাস্থ্যসেবা মানুষের মৌলিক অধিকার। প্রতিটি গ্রামে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সরঞ্জাম সরবরাহের মাধ্যমে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা উন্নত করা প্রয়োজন। পাশাপাশি, মাদকমুক্ত সমাজ গড়ে তোলার জন্য সামাজিক সচেতনতা এবং কঠোর আইনের প্রয়োগ জরুরি। আমরা জানি, শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। গ্রামীণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি এবং নৈতিক শিক্ষার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার পাশাপাশি, নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও সুযোগ নিশ্চিত করতে সামাজিক ও পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন প্রয়োজন। এসডিজি ৭ বাস্তবায়নে গ্রামে নবায়নযোগ্য শক্তি, বিশেষ করে সৌর শক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। পাশাপাশি, পরিবেশ-বান্ধব কৌশল গ্রহণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ ও জীব-বৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে।
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে গ্রামই সব
বাংলাদেশ একটি কৃষিনির্ভর দেশ। দেশের মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬০% মানুষ এখনও গ্রামে বাস করে এবং তাদের জীবিকার প্রধান উৎস কৃষি। দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো, সংস্কৃতি, এবং সামাজিক জীবন কৃষির ওপর নির্ভরশীল। এই প্রেক্ষাপটে গ্রাম উন্নয়নকে গুরুত্ব দেওয়া না হলে জাতীয় উন্নয়ন টেকসই হবে না। প্রথমত, কৃষির উন্নয়ন গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করে। বাংলাদেশের জিডিপিতে কৃষির অবদান এখনও উল্লেখযোগ্য। উন্নত কৃষি ব্যবস্থা ও আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করলে কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যা দারিদ্র্য দূরীকরণে সহায়তা করবে। এটি শুধু গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জীবনের মান উন্নয়নেই ভূমিকা রাখবে না, বরং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। দ্বিতীয়ত, গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন যেমন সড়ক, বিদ্যুৎ, স্বাস্থ্যসেবা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন, কৃষিকে আরও কার্যকর এবং লাভজনক করতে সাহায্য করবে। কৃষি পণ্যের সঠিক বাজারজাতকরণ এবং সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা গেলে কৃষকদের আয় বৃদ্ধি পাবে। তৃতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তন জনিত প্রভাব মোকাবিলায় গ্রামীণ উন্নয়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। টেকসই কৃষি পদ্ধতি এবং পরিবেশ-বান্ধব কৌশল গ্রহণ করে গ্রামীণ এলাকা জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় সক্ষম হবে।
চ্যালেঞ্জ ও সমাধান
এসডিজি বাস্তবায়নের পথে বাংলাদেশের বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং প্রযুক্তিগত দুর্বলতা যেমন একটি প্রধান বাধা, তেমনি জনসচেতনতার অভাবও উন্নয়নের পথে অন্তরায়। তবে, এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলার জন্য কিছু কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রয়োজন। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোর সহায়তা নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্থানীয় জনগণকে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করা।
টেকসই ভবিষ্যতের পথে
২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জন করতে পারলে বাংলাদেশ একটি উন্নত, টেকসই এবং সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাবে। গ্রামীণ উন্নয়নকে এই প্রক্রিয়ার মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হলে তা সার্বিক উন্নয়নের গতিকে আরও ত্বরান্বিত করবে। গ্রাম থেকেই বাংলাদেশ হবে উন্নত। কৃষিনির্ভর গ্রামীণ উন্নয়ন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক কাঠামোকে আরও স্থিতিশীল করবে। কৃষিভিত্তিক গ্রামীণ অর্থনীতি শক্তিশালী হলে শহরমুখী মানুষের চাপ কমবে, যা দেশের সামগ্রিক ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়তা করবে। সুতরাং, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য গ্রাম ও কৃষি উন্নয়ন একান্ত অপরিহার্য।
লেখক: মুহাম্মাদ শরিফুর রহমান, চেয়ারম্যান, এসডিজি মডেল ভিলেজ বাংলাদেশ; ইমেইল: sdgmodelvillage@gmail.com