সবার আগে বাংলাদেশ: ঐক্যের মোহনীয় সুর

মাহবুব নাহিদ
প্রকাশ: ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১৭ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
স্বাধীন দেশে উড়বেই যেন স্বাধীন পতাকা। আসিফ আকবরের এই গানের সুরেই যেন মিলে গেছে ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ কনসার্টের সার্থকতা। বাংলাদেশের মানুষ এক অনন্য স্বাদের বিজয়ে উদযাপন করেছে এবার। যেই বিজয় সত্যিকারেই মানুষের বিজয়, যেই বিজয় কোনো ব্যক্তিপূজার নয়, কোনো দলপূজার নয়, যেই বিজয় পুরো দেশকে এক সুতোয় বাঁধার অসামান্য এক সারথি।
বাংলাদেশের নাম উচ্চারণ করলেই মনে হয়, হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দনে সেই নাম ছড়িয়ে পড়েছে। আর যখন কেউ বলে, ‘সবার আগে বাংলাদেশ’, তখন যেন রক্তের প্রতিটি কণিকা নতুন করে জেগে ওঠে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক লাল-সবুজের পতাকা, আমাদের মুক্তির ইতিহাস, আমাদের গৌরব—সব একসঙ্গে মিলে যায় এই স্লোগানে। ১৬ বছরের দমন-পীড়ন আর অন্ধকার সময় পার করে বিজয় দিবসে নতুন সূর্যোদয়ের মতো উজ্জ্বল এই ডাক যেন আমাদের স্বপ্ন ও সাহসের মশাল হয়ে উঠেছে।
২০২৪-এর বিজয় দিবস আমাদের জন্য শুধুই অতীতের স্মরণ নয়; এটি নতুন করে ভবিষ্যৎ রচনা করার অঙ্গীকার। মুক্তিযুদ্ধ আমাদের আত্মপরিচয়ের শিকড় আর আজকের দিন আমাদের পথচলার শক্তি। ১৯৭১-এর রক্তঝরা দিনগুলোর চেতনা নিয়ে আমরা আজ দাঁড়িয়েছি নতুন প্রতিজ্ঞায়—যে বাংলাদেশ হবে সমৃদ্ধি, মর্যাদা, আর সাম্যের প্রতীক।
মানিক মিয়া এভিনিউতে "সবার আগে বাংলাদেশ" কনসার্ট যেন গোটা জাতির একটি অঘোষিত মিলনমেলা হয়ে উঠেছিল। দেশের সেরা শিল্পীরা একত্রিত হয়ে গাইলেন বিজয়ের গান, স্বাধীনতার গান। জেমস, শিরোনামহীন, সোলস, ডিফারেন্ট টাচ থেকে শুরু করে ইমরান, কণা, এবং জেফারের পরিবেশনা যেন তরুণদের নতুন আশায় উজ্জীবিত করল। কিন্তু সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী ছিল সেই শিল্পীদের ফিরে আসা, যারা দীর্ঘদিন ধরে নির্যাতিত ও অবহেলিত ছিলেন। আসিফ আকবর, মনির খান, বেবী নাজনিন, কনক চাঁপার মতো শিল্পীদের কণ্ঠে সেদিন শুধু গান ছিল না; ছিল জমে থাকা আবেগ, দুঃখ আর বিজয়ের অশ্রু।
সেই ১৬ বছর ছিল একটি অন্ধকার অধ্যায়, যেখানে ফ্যাসিবাদী শাসন কণ্ঠ রুদ্ধ করেছিল। শিল্পীরা গাইতে পারতেন না, তাদের মঞ্চে ওঠার অধিকার ছিল না। কিন্তু মানুষ তাদের ভুলেনি। মানুষ তাদের ভালোবাসা দিয়ে জিতিয়েছে। আর সেই ভালোবাসা সেদিন উন্মুক্ত আকাশের নিচে এক অদ্ভুত শক্তিতে পরিণত হয়েছিল।
"সবার আগে বাংলাদেশ" কনসার্ট শুধু একটি অনুষ্ঠান ছিল না, এটি ছিল একটি যুগান্তকারী মুহূর্ত। এটি প্রমাণ করল, বাংলাদেশের মানুষ একত্রিত হলে কোনো অপশক্তি তাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। এই কনসার্ট শুধু বিনোদনের জায়গায় সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি ছিল একটি জাতির ঐক্যের উদযাপন। দলমতের ঊর্ধ্বে উঠে, বর্ণ, ধর্ম, গোত্র নির্বিশেষে সবাই সেখানে উপস্থিত ছিল এক অভিন্ন পরিচয়ে—আমরা বাংলাদেশি।
তারেক রহমানের উদ্যোগে এবং শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানীর আহ্বানে এমন একটি ঐতিহাসিক আয়োজন সত্যিই একটি নবযুগের সূচনা। কনসার্টের প্রতিটি সুরে, প্রতিটি কথায় ফুটে উঠেছিল একটি বার্তা—বাংলাদেশ আমাদের সবার। এখানে কোনো বিভাজন নেই, কোনো ভেদাভেদ নেই।
সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত ছিল সুলতান সালাউদ্দিন টুকুর কণ্ঠে স্লোগান—সবার আগে বাংলাদেশ। তার সেই দৃপ্ত আহ্বানে যেন পুরো জাতি গর্জে উঠল। লাখো কণ্ঠ মিলে গেল এক জায়গায়। মনে হচ্ছিল, কেবল মানিক মিয়া এভিনিউ নয়, সারা বাংলাদেশ একসঙ্গে শপথ নিচ্ছে—আমাদের পতাকা কখনো নত হবে না, আমাদের স্বাধীনতা কখনো বিপন্ন হবে না।
"সবার আগে বাংলাদেশ" এর আহবায়ক বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানী বলেন, সবার আগে বাংলাদেশ এমন একটা জায়গা যেখানে দেশের সকল শ্রেণির সকল ধর্ম বর্ণ মতের মানুষ একাকার হয়ে মিলে যাবে। বিদেশি সংস্কৃতির বেড়াজাল ছিন্ন করে বাংলাদেশের মানুষ মেতে উঠবে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির মূর্ছনায়। এই গানের সুর শুধুমাত্র গানের সুরই নয়, এই সুর যেন স্বৈরাচারের শৃঙ্খল ভাঙার আওয়াজ, সবকিছু ছাপিয়ে, সকল কিছুর ঊর্ধ্বে এগিয়ে যাক আমাদের বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
"সবার আগে বাংলাদেশ" এর সদস্য এবং বিএনপির প্রচার সম্পাদক সুলতান সালাউদ্দিন টুকু বলেন "সবার আগে বাংলাদেশ" এই স্লোগান শুধু একটি বাক্য নয়, এটি একটি জাতির আত্মা। এটি আমাদের শিকড়ের শক্তি, আমাদের ভবিষ্যতের আলোকবর্তিকা। আমাদের পরিচয়, আমাদের গৌরব, আমাদের প্রতিজ্ঞা—সব এক জায়গায় মিলে যায় এই শব্দগুলোতে। এখানে কেউ সংখ্যালঘু নয়, কেউ পরাধীন নয়। এখানে আমরা সবাই এক, সবাই বাংলাদেশি।
আজকের বাংলাদেশ কোনো বিভক্তি নয়, কোনো সংকীর্ণতা নয়। এটি একটি উন্মুক্ত দেশ, যেখানে মানুষ মাথা উঁচু করে বাঁচবে। যেখানে স্বাধীনতার আদর্শ হবে জীবনের পথপ্রদর্শক। "সবার আগে বাংলাদেশ" আমাদের সেই অঙ্গীকারের নাম, যা নিয়ে আমরা গড়ব এক উন্নত, আত্মমর্যাদাশীল, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক