কপ২৯ সমাপ্তির ডাক হতাশা নাকি আশার আলো

অনুপমা নিলয়া ত্রয়ী
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৭:৩৬ পিএম

অনুপমা নিলয়া ত্রয়ী, জলবায়ু অধিকারকর্মী ও গবেষক, স্পেন
প্রায় ২০০ দেশের অংশগ্রহণে এবছরের প্রতীক্ষিত জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৯ এইবার আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত হয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে চলা এবারের আয়োজন বেশ দীর্ঘমেয়াদে হয়েছে। অনেকাংশে বিতর্কিত ছিল এবারের আয়োজন। সব দেশে ঐক্যমত্যে পৌঁছাতে বেশ সময় লাগে। একদিকে স্বল্পোন্নত ও ভুক্তভোগী দেশের কথা উপেক্ষা করার কারণে কপ২৯ শেষ দিনের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন আছে। অন্যদিকে কেউ কেউ এবারের ঘোষণাকে ত্রুটিপূর্ণ আপস বলে উল্লেখ করেছেন । আয়োজক দেশ আজারবাইজানের প্রস্তুতির ঘাটতি নিয়েও প্রশ্ন দেখা যায় প্রথম থেকেই । অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন সংস্থা ও কর্মীরা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী উন্নত দেশের উপর চাপ ছিল। এছাড়াও স্বল্পোন্নত ও ক্ষতিগ্রস্ত দেশ নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার আশার আলো খোঁজা চেষ্টা করে। শেষ পর্যন্ত এই সম্মেলনের ফলাফল একদিকে আশার আলো দেখালেও, অন্যদিকে তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
আলোচনার শেষদিনে নতুন আর্থিক লক্ষ্যমাত্রা ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করা হয়, যা প্রত্যাশিত ১.৩ ট্রিলিয়ন ডলারের তুলনায় অনেক কম। বিশেষত এই অর্থায়ন পরিকল্পনার সুনির্দিষ্ট উৎস এখনও পরিষ্কার নয়। অর্থ সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে আসার কারণে অনেক দেশ ঋণের ঝুঁকির আশংকা করছে । এই সিদ্ধান্ত রাষ্ট্রসমূহের জন্য আংশিক স্বস্তি নিয়ে আসলেও স্বল্পোন্নত দেশের যারা জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের প্রয়োজনের তুলনায় এই তহবিল অপ্রতুল।
কপ২৯-এর উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে অন্যতম ছিল প্যারিস চুক্তির আর্টিকেল ৬ নিয়ে দীর্ঘ দশ বছরের আলোচনার সমাপ্তি। কার্বন ক্রেডিট বাণিজ্যের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পরিবেশগত মূল্যায়ন প্রক্রিয়া উন্নত করা হয়েছে। এর ফলে বিভিন্ন দেশ এখন সহজেই কার্বন বাজারে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এটি ভবিষ্যতের টেকসই পরিবেশ নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর লস এন্ড ড্যামেজ তহবিল চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যা ২০২৫ সাল থেকে কার্যকর হবে। তবে এ পর্যন্ত মাত্র ৭৩০ মিলিয়ন ডলার প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেছে, যা উল্লেখযোগ্যভাবে কম। এই তহবিল জলবায়ু দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য সহায়তা প্রদানের উদ্দেশ্যে তৈরি হলেও, বাংলাদেশ এর পর্যাপ্ততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছে।
নারী ও লিঙ্গ সংক্রান্ত কর্মপরিকল্পনার মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়টি ছিল বিতর্কের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু। উন্নয়নশীল দেশগুলো লিঙ্গ-সমন্বিত নীতির জন্য নির্ধারিত অর্থায়নের দাবি জানালেও উন্নত দেশগুলো এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে। ফলস্বরূপ, এই পরিকল্পনার মেয়াদ বৃদ্ধি পেলেও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। সবচেয়ে বড় উদ্বেগের বিষয় হলো, কপ২৯ আলোচনায় জ্বালানি তেল নির্ভরতা থেকে সরে আসার বিষয়ে কোনও কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি। এই গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু কপ৩০ পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। এর ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর উপর আরও বেশি বোঝা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনের নির্বাহী সেক্রেটারি সাইমন স্টিয়েল বলেন, অনেক দেশ যা চেয়েছিল তা পায়নি, আর আমরা বাকু থেকে কাজের পাহাড় নিয়ে ফেরত যাচ্ছি।
অনেক দেশের তাদের নেতাদের অনুপস্থিতি, জীবাশ্ম জ্বালানী লবিস্টের শঙ্কাজনক উপস্থিতি ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রত্যাবর্তনের কারণে কপ২৯ আশানুরূপ ফলাফলে গুরুত্বপূর্ণ বাঁধা সৃষ্টি করে। এখন আমাদের ও আগামী প্রজন্মের ভবিষ্যৎ অনেকাংশেই বিশ্ব নেতাদের রাজনৈতিক ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল, কারণ বিজ্ঞান বলছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ সেলসিয়াসের উপরে যাওয়া মানে মানবিক বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশ ও অন্যান্য স্বল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য কপ২৯ একদিকে যেমন কিছু আশা জাগিয়েছে, তেমনি এর সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় আমাদের সম্মিলিত উদ্যোগের গুরুত্ব আরও বাড়িয়েছে। এখন কপ৩০ দিকে তাকিয়ে বিশ্ব, কারণ প্যারিসের পর থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জলবায়ু এই শীর্ষ সম্মেলন আগামী ১০ বছরের জন্য পৃথিবীর জলবায়ু পরিকল্পনা নির্ধারণ করবে।
অনুপমা নিলয়া ত্রয়ী, জলবায়ু অধিকারকর্মী ও গবেষক, স্পেন