×

মুক্তচিন্তা

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

Icon

সাইফুল ইসলাম শান্ত

প্রকাশ: ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:২৩ পিএম

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড হোক সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি

   

সারাজীবন শান্তির জন্য কাজ করা মাদার তেরেসা বলেছিলেন, 'একটি মিষ্টি হাসি শান্তির বার্তার শুরু'। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্পদ, যা দেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়নে ভূমিকা পালন করে আসছে। তবে কখনো কখনো কিছু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী এই সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করে। তারা বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বা হানাহানির চেষ্টা করে। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ সবসময় এ ধরনের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে সম্প্রীতির বন্ধনকে আরো দৃঢ় করেছে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত না করে কোনো জাতি উন্নতি করতে পারে না। সম্প্রীতি না থাকলে দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বিনষ্ট হয়, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ে। সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ সংঘাতের সূত্রপাত ঘটায়, গৃহযুদ্ধেও রূপ নেয়। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন ধর্মীয় স্থানের সুরক্ষা এবং আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি বৃদ্ধিতে বাংলাদেশের একনিষ্ঠতার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি পর্তুগালের ক্যাসকেইসে অনুষ্ঠিত ধর্মীয় স্থানগুলোর সুরক্ষায় জাতিসংঘের বৈশ্বিক সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্বকালে তিনি এ প্রতিশ্রুতি দেন।

আজকের সমাজে অতি উৎসাহী কিছু মানুষ ধর্মকে ব্যবহার করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করেন। যা কোনো ধর্মই সমর্থন করে না। ইসলাম ধর্মে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের কোনো স্থান নেই। সাম্প্রদায়িকতার নামে যারা বিশৃঙ্খলা করে তাদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, যারা সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে এবং সাম্প্রদায়িকতার জন্য জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের সমাজভুক্ত নয় (আবু দাউদ)।’

এছাড়া অমুসলিমদের জান-মাল-ইজ্জত সংরক্ষণের ব্যাপারে রাসূল (সা.) কঠোর সতর্কবাণী দিয়ে বলেন,‘যে ব্যক্তি কোনো চুক্তিবদ্ধ অমুসলিমকে হত্যা করল, সে জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের দূরত্বে থেকেও জান্নাতের সুঘ্রাণ পাওয়া যায়’- (বুখারি)। অন্য এক  হাদিসে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! যে ব্যক্তি চুক্তিবদ্ধ অমুসলিম নাগরিকের ওপর অত্যাচার করে অথবা তার অধিকার থেকে কম দেয় কিংবা সামর্থ্য-বহির্ভূতভাবে কোনো কিছু চাপিয়ে দেয় বা জোর করে তার কোনো সম্পদ নিয়ে যায়, তবে কেয়ামতের দিন আমি সেই ব্যক্তির প্রতিবাদকারী হবো (আবু দাউদ)।’

পাশাপাশি হিন্দু ধর্মগ্রন্থ গীতায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক শৃঙ্খলা ও শান্তি বজায় রাখার ক্ষেত্রে প্রত্যেক ব্যক্তির একটি স্বতন্ত্র ভূমিকা এবং বাধ্যবাধকতা রয়েছে মর্মে উল্লেখ রয়েছে। অধ্যায় ৩, শ্লোক ৩৫-এ বলা হয়েছে: ‘অসম্পূর্ণভাবে অন্যের ধর্ম পূরণ করার চেয়ে নিজের ধর্মকে পূর্ণ করা ভালো। নিজের সহজাত প্রকৃতি অনুসারে কাজ করলে, একজনের পাপ হয় না।’

এছাড়া, খ্রিষ্টান ধর্মের ‘বাইবেল’ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত্তিপ্রস্তর হিসেবে প্রেম এবং সমবেদনাকে জোর দেয়।  ম্যাথিউরের গসপেল (২২:৩৯), যিশু বলেছেন: ‘তুমি তোমার প্রতিবেশীকে নিজের মতো ভালোবাসবে।’

বাংলাদেশ বিভিন্ন ধর্ম এবং সংস্কৃতির একটি মিলনস্থল। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মের মানুষ একসঙ্গে বসবাস করে আসছে। ব্রিটিশ শাসনের অধীনে ঔপনিবেশিক আমলে বিভাজনমূলক নীতির কারণে মাঝে মাঝে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭ সালে ভারতের বিভাজন, যার ফলে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমান বাংলাদেশ) সৃষ্টি হয়, তা উল্লেখযোগ্য সাম্প্রদায়িক সহিংসতার সাক্ষী হয়। তবু পূর্ববঙ্গ (পরে বাংলাদেশ)-এর জনগণ মূলত সহাবস্থানের চেতনাকে ধরে রেখে সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত পরিচয়কে ধর্মীয় পার্থক্যের ওপর অগ্রাধিকার দিয়েছিল।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রাম ১৯৭১ সালে ধর্মীয় বিভাজনকে অতিক্রম করে সমতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির ভিত্তিতে লড়াই করা হয়েছিল। যার পরিপ্রেক্ষিতে বহু ত্যাগের বিনিময়ে গঠিত নতুন জাতি একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার সংবিধান সব নাগরিকের জন্য ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমান অধিকার নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি উন্নয়নে কৌশল তৈরি করার সময় আঞ্চলিক প্রেক্ষাপট অনুধাবন করা গুরুত্বপূর্ণ। যেমন, ভারতের ধর্মীয় বৈচিত্র্য রয়েছে, যেখানে হিন্দু, মুসলিম, খ্রিষ্টান, শিখসহ অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করে। তথাপি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সেখানে একটি স্থায়ী সমস্যা, যা প্রায়ই হিন্দু এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। উদাহরণস্বরূপ, গুজরাট দাঙ্গা (২০০২) চলাকালীন ১ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে, যার সঙ্গে হিন্দু জাতীয়তাবাদী মনোভাব এবং সম্পর্কিত সংঘাতের উত্থান হয়েছে।

এ অঞ্চলের অবস্থা বিশ্লেষণ করলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক প্রতিবেশী দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে রয়েছে।

আমরা কিছু কৌশল ব্যবহার করে টেকসই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিশ্চিত করতে পারি। এর মধ্যে আন্তঃধর্মীয় সংলাপ পরিচালনা করা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বৃদ্ধির অন্যতম কার্যকর উপায় হতে পারে। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা উৎসাহিত করা, যা ভুল বোঝাবুঝি দূর করতে এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। ধর্মীয় নেতা ও সম্প্রদায়ের  প্রভাবশালীরা এই সংলাপগুলো কার্যকর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে নিয়মিত আন্তঃধর্মীয় ফোরাম, কর্মশালা এবং সেমিনার  আয়োজন করা যেতে পারে।

এছাড়া স্কুলগুলোর পাঠ্যক্রমে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সম্পর্কে আরও নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। যাতে সমস্ত সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের গুরুত্ব বোঝানো যায়। সেইসাথে, পাঠ্যবইগুলোতে যে কোনও ঘৃণা বা বৈষম্যকে উস্কে দিতে পারে এমন বিষয়বস্তু থাকলে তা বাদ দিয়ে এর পরিবর্তে দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের অবদানকে তুলে ধরা যেতে পারে।

দেশের গণমাধ্যমগুলো সংবেদনশীলতা এড়িয়ে আরও দায়িত্বশীল প্রতিবেদন প্রচার করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সেই সাথে যা সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার ঘটনা আরও খারাপ করতে পারে তার পরিবর্তে, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, আন্তঃধর্মীয় সহযোগিতা এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির উদাহরণগুলোকে তুলে ধরার উপর মনোযোগী হতে হবে। 

সাম্প্রদায়িক সহিংসতা মোকাবিলা এবং প্রতিরোধে শক্তিশালী আইনি কাঠামো প্রয়োজন। বাংলাদেশে ঘৃণামূলক বক্তব্য এবং সহিংসতায় উস্কানি দেয়ার বিরুদ্ধে আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করার দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হবে। সেই সাথে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকারদের জন্য দ্রুত এবং নিরপেক্ষ বিচার ভবিষ্যতের ঘটনার বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করতে পারে। 

মাঠ পর্যায়ে সব ধর্মের সদস্যদের নিয়ে শান্তি কমিটি করে যৌথ সাম্প্রদায়িক কার্যক্রম আয়োজন এবং সম্ভাব্য উত্তেজনার উৎস মোকাবিলায় স্থানীয় কর্তৃপক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সহযোগিতা করতে পারে। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক সম্মান বাড়ানোর জন্য ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক উৎসব একসাথে উদযাপন করা যেতে পারে।

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে প্রভাব ফেলতে পারে এমন বিভিন্ন বিষয়ে সজাগ থাকা প্রয়োজন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকেরও কর্তব্য। আমাদের প্রতিদিনের আচরণ ও চিন্তাধারায় এই সম্প্রীতির মানসিকতা ধরে রাখতে হবে। তবেই আমরা একটি সত্যিকার অর্থে মানবিক ও উন্নত সমাজ গড়ে তুলতে পারব, যেখানে সব ধর্ম, বর্ণ ও সংস্কৃতির মানুষ সমানভাবে সম্মানিত ও নিরাপদ থাকবে। আমাদের বুঝতে হবে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বাংলাদেশের জাতীয় ঐক্যের মেরুদণ্ড। এটি আমাদের একটি শক্তিশালী জাতি হিসেবে বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। তাই আমাদের সবার উচিত এই সম্প্রীতির মন্ত্রকে হৃদয়ে ধারণ করে একটি উন্নত, শান্তিপূর্ণ ও সম্প্রীতিময় বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করা।

লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App