জলবায়ু সম্মেলনে আমরা কী পাচ্ছি?

অনুপমা নিলয়া ত্রয়ী
প্রকাশ: ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:০৮ পিএম

অনুপমা নিলয়া ত্রয়ী, জলবায়ু অধিকারকর্মী ও গবেষক, স্পেন
জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ ২৯-এর এক সপ্তাহ পার হলো। দ্বিতীয় সপ্তাহের আলোচনার দিকে এখন সবার চোখ। প্রথম সপ্তাহের আলোচনায় কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অগ্রগতি হলেও, বেশ কিছু ক্ষেত্রে থমকে গেছে আলোচনা। কপ২৯-এর আলোচনার দিন যত গড়াচ্ছে, পরিস্থিতি ততই জটিল ও দ্বন্দ্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। তৃতীয় দিনে ছোট দ্বীপ রাষ্ট্রগুলো জি২০-কে নির্গমন কমানোর জন্য চাপ দিচ্ছে, ব্রাজিলের দ্বৈত বার্তা, আর্জেন্টিনার প্রতিনিধি দলের প্রত্যাহার, এবং একটি নতুন জলবায়ু অর্থায়নের অনানুষ্ঠানিক খসড়া আলোচনার কেন্দ্রে এসেছে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত কাঠামো কনভেনশনের আওতায় সাবসিডিয়ারি বডির সেশন দেখা গেছে আন্তর্জাতিক জলবায়ু আলোচনার একটি বিমর্ষ চিত্র। প্রশমন, অভিযোজন, লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ড এবং প্রযুক্তি স্থানান্তর নিয়ে আলোচনা স্থগিত রেখে ২০২৫ সালের জুন মাসে পরবর্তী সেশনে পাঠানো হয়েছে।
১৩ নভেম্বর ২০২৪-এ বাকুর কপ২৯ সম্মেলনে আলোচনার সংবেদনশীল পর্যায়ে প্রবেশ করা হয়েছে। গ্লোবাল সাউথের মূল আলোচকরা, যেমন আফ্রিকান গ্রুপ, এলএমডিসি, এবং জি৭৭-এর প্রতিনিধিরা সরাসরি ও সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দাবি করছেন। খসড়ায় দুটি প্রস্তাবের মধ্যে একটি হলো একটি নির্দিষ্ট আর্থিক লক্ষ্য নির্ধারণ করা এবং অন্যটি হলো ১০০ বিলিয়ন থেকে ২ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পর্যন্ত বহুতল বিনিয়োগ লক্ষ্য।
বিশেষ করে, উন্নয়নশীল দেশগুলো ১.৩ ট্রিলিয়ন বা তার বেশি মার্কিন ডলার দাবি করছে, যেখানে এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) এবং সিডস (ছোট দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র)-এর জন্য বার্ষিক ২২০ বিলিয়ন এবং ৩৯ বিলিয়ন বরাদ্দ প্রস্তাব করা হয়েছে। সপ্তাহের শেষে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান নিয়ে কিছুটা আশার আলো দেখা গেলেও, দ্বিতীয় সপ্তাহে এই বিষয়ে আলোচনা স্থগিত রাখা হয়। অভিযোজন কমিটির কার্যকারিতা পর্যালোচনায় একটি যৌথ পর্যবেক্ষণের প্রস্তাব দেওয়া হলেও ভাষার ব্যবহারে মতভেদ থাকায় এটি আটকে যায়। সৌদি আরব ও অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিক সহায়তার সরাসরি উল্লেখ চাইলেও ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র তা প্রত্যাখ্যান করেছে।
কপের একটি প্লাটফর্ম ১০ ট্রিলিয়নের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় বেসরকারি মূলধনের প্রবাহ ত্বরান্বিত করার মাধ্যমে। অন্যদিকে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ৩.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল ঘোষণা করে। এছাড়াও আজারবাইজানের ব্যাংকিং সেক্টর ২০৩০ সালের মধ্যে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার সবুজ প্রকল্পে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে। সুইডেন জাতিসংঘের গ্রিন ক্লাইমেট ফান্ডে ২০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ও যুক্তরাজ্য গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৯৯০ থেকে ৮১ ভাগ কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
প্রথম সপ্তাহের শেষে ওয়ারশো ইন্টারন্যাশনাল মেকানিজম পুনর্বিবেচনা নিয়ে আলোচনা থমকে গেছে এবং পরবর্তী ২০২৫ সেশন পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়েছে। সান্তিয়াগো নেটওয়ার্কের অবস্থান এবং আর্থিক ব্যবস্থা নিয়ে আলোচনা জটিলতার মধ্যে রয়েছে।এছাড়াও উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তার অভাবে ক্ষুব্ধ। এই পুনরাবৃত্তি বৈষম্য জলবায়ু অর্থায়নের একটি পদ্ধতিগত সমস্যার প্রতিফলন। বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনুস সাম্প্রতিক বন্যায় $১.২ বিলিয়ন ক্ষতির কথা তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন, জলবায়ু তহবিল থেকে প্রাপ্ত ৩৪০–৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার অনুদান এবং ২৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই অপ্রতুল।
ব্রাজিল তার নতুন জলবায়ু পরিকল্পনায় ২০৩৫ সালের মধ্যে নির্গমন ৫৯–৬৭% কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। পাশাপাশি, তারা অ্যামাজনের কার্বন শোষণের ক্ষমতার ওপর নির্ভর করছে। তবে, এই প্রতিশ্রুতি তাদের জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন ৩৬% বৃদ্ধির পরিকল্পনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ নিয়ে সমালোচকরা বলছেন, এটি বৈশ্বিক শক্তি রূপান্তরের নেতৃত্ব দেওয়ার থেকে অনেক দূরে। আর্জেন্টিনার নতুন প্রেসিডেন্ট হাভিয়ার মিয়েল কপ ২৯ থেকে তার প্রতিনিধি দলকে সরিয়ে নিয়েছেন। তিনি জলবায়ু পরিবর্তনকে বামদলীয় মিথ্যা বলে দাবি করেছেন, যা সম্মেলনের বিতর্কে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
এদিকে ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার রিপোর্ট বলছে, বর্তমান নীতিগুলো অব্যাহত থাকলে, শতাব্দীর শেষে তাপমাত্রা ২.৭°সি বাড়তে পারে। ২০২১ সালের কপ ২৬ থেকে এ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। লেখক সোফিয়া গনজালেস বলেছেন, নির্গমন হ্রাসের কৌশল কার্যকর করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। কপ ২৯ এর প্রধান আলোচক ইয়ালচিন রাফিয়েভ একটি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, সব দেশকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের এক সপ্তাহের হিসাব এটাই। এখন দেখার বিষয়, কপ ২৯-এর পরবর্তী আলোচনা বাস্তবিক অগ্রগতির দিকে নিয়ে যায়, নাকি নতুন কোনো জটিলতা তৈরি করে।
লেখক: অনুপমা নিলয়া ত্রয়ী, জলবায়ু অধিকারকর্মী ও গবেষক, স্পেন