×

সিলেট

হাওর জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঝকমক করে ওঠা জোনাকী পোকা

Icon

রাসেল আহমদ, মধ্যনগর (সুনামগঞ্জ) থেকে

প্রকাশ: ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০১:০৫ পিএম

হাওর জনপদ থেকে হারিয়ে যাচ্ছে ঝকমক করে ওঠা জোনাকী পোকা

ছবি : সংগৃহীত

   

সুনামগঞ্জের মধ্যনগরের হাওর, বিল, পুকুর ও ডোবার পাড়ে ঝোপঝাড় আর গ্রামের গাছ-গাছালি, আড়া জঙ্গলে রাত হলেই অন্ধকারে ঝকমক করে ওঠা সেই জোনাকিদের এখন আর দেখতে পাওয়া যায়না। জীবনে আমাদের এসে গেছে অনেক রকম বৈদ্যুতিক আলো। ফলে জোনাকিরা হারিয়ে যাচ্ছে সেই আলোর সাথে পাল্লা দিতে না পেরে।

ঘুটঘুটে অন্ধকার গাছগাছালি, লতাপাতা আর ঝোপঝাড়ের ফাঁকে তারার মতো মিটমিটে আলো জ্বালিয়ে রাতের নীরবতাকে মোহনীয় করে তোলতো জোনাকি। কিন্তু ক্রমাগত আলো দুষণ, দেশি গাছপালা ও গুল্মলতা হ্রাস, হাওরের কৃষিজমিতে সার, কীটনাশক ও কেমিক্যালের অবাধ ব্যবহার, পাকা ঘরবাড়ি নির্মাণ এবং খাল-বিল ও পুকুরে খামারভিত্তিক মাছ চাষের দরুন জোনাকির খাদ্য-খাবার, প্রাকৃতিক প্রজনন এবং নিরাপদ বসতিস্থল ধ্বংস হচ্ছে। প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র বিনষ্ট হওয়ায় আলোর বাহক নিশাচর জোনাকিরা অন্ধকার পথের যাত্রী হচ্ছে।

জোনাকি বিটল শ্রেণির বাদামি পোকা। সব জোনাকির আলো এক নয়। কোনোটির আলো সবুজ, কোনোটির হলুদ বা কমলা হয়। এরা রাতের আধাঁরে অবিরাম আলো ছড়ায় না। জ্বলে আর নেভে। যেন দৃষ্টিনন্দন খেলা। জোনাকির লেজে এন লুসিফেরাজ এবং লুসিফেরিন এনজাইম থাকে, যা থেকে আলো ছড়ায়। আলো ছড়ানার মূল কারণ কিন্তু মানুষকে খুশি করা নয়। বরং পুরুষ জোনাকি আলো জ্বালিয়ে স্ত্রী জোনাকিকে আকর্ষণ করে এবং পরে যৌন মিলন ঘটায়।

দিনে জোনাকিরা গৃহস্থের গোবরকুরি, পুকুর, ডোবা, খাল বিল, নদী পাড়ের লতা-ঘাস এবং ঝোপ-জঙ্গলে লুকিয়ে থাকে। এরা ক্ষুদ্রাকারের পোকা, কেঁচো, শামুকের ডিম বা পঁচা প্রাণী ও আবর্জনা খায়। বয়স্ক জোনাকির প্রিয় খাবার গাছের ফুলফলের মধু ও রস।

সুনামগঞ্জের মধ্যনগর উপজেলার বংশীকুণ্ডা কলেজের প্রভাষক প্রকৃতি প্রেমী ও গবেষক দেলোয়ার হোসেন গবেষণা থেকে জানান, জোনাকি পোকা বিলীন হওয়ার অন্যতম কারণ আলোর দুষণ। এরা তীব্র আলো সহ্য করতে পারে না। গ্রামীণ জনপদে ঘরবাড়ি, হাটবাজার, দোকানপাট, রাস্তাঘাট অনেকাংশে বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত থাকে। এমনকি পুকুর, জলাশয় ও বিলে মাছ চাষের জন্য রাতে বিদ্যুতের আলো জ্বলে। রাতে বিদ্যুৎ আলোর ফাঁদে পড়ে জোনাকি পোকা মারা যায়। তাছাড় গ্রামে বসতভিটা সংলগ্ন আড়াজঙ্গল কমে যাচ্ছে। তিন দশক আগেও সারা দেশে আড়াজঙ্গল ছিল ৭ লাখ ৭৪ হাজার হেক্টর। বর্তমানে তা অর্ধেকে দাঁড়িয়েছে। আড়াজঙ্গলের কদম, শেওড়া, পলাশ, জিগা, মান্দার, হরতকীসহ শতাধিক প্রজাতির দেশি গাছগাছালির ফুল, ফল ও রস বিভিন্ন পশু পাখী এবং জোনাকির খাবারের উৎস ছিল। বাড়িঘর নির্মাণে শুধু যে আড়াজঙ্গল কমেছে তাই নয়, উদ্ভিদ জগতেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শতকরা ৯০ ভাগ বাড়িতে বিদেশি প্রজাতির গাছ মেহগিনি, রেইনট্রি , ইউক্যালিপ্টাস, আকাশমণি স্থান করে নিয়েছে।

এসব গাছে পাখ-পাখালি বাসা বাঁধে না। এখান থেকে খাবারও মেলে না। আকাশমণি ও ইউক্যালিপ্টাস গাছের পাতা সহজে পঁচে না। গাছের নিচে কোনো গুল্মলতাদি বা যাস গজায়না। চিরায়ত গ্রামীণ আড়াজঙ্গলের নির্মম রূপান্তর এটি। উদ্ভিদ জগতে বিদেশি এসব গাছের এমন আহ্লাদী বিস্তার শুধু পশুপাখি নায়, জোনাকির মতো শত কীটপতঙ্গের খাবারদাবার, বংশ বিস্তার ও বেঁচে থাকার বড় চ্যালেঞ্জ। প্রাণ-প্রকৃতি ও চিরায়ত প্রতিবেশের ওপর অশুভ প্রভাব পড়ায় ইকো সিস্টেমকে বদলে দিচ্ছে বলে জানান তিনি।

একটি বেসরকারি অনলাইন গণমাধ্যমের পরিবেশ ও জলবায়ু বিষয়ক বিশেষ প্রতিনিধি মধ্যনগর উপজেলার বাসিন্দা বলেন, উফশী ফল, ফসল ও সবজি আবাদ এবং কলম চারার উদ্যানে ব্যাপক রাসায়নিক সার, কীটনাশক ও কেমিক্যাল প্রয়োগ হয়। এতে প্রামীণ হালটের ঝোপজঙ্গল বা জমির আইলের ঘাসলতায় আশ্রয় নেয়া জোনাকিরা মারা যায়।

বেসরকারি পরিবেশবাদী সংগঠন বারসিকের আঞ্চলিক সমন্বয়কারী, লেখক ও গবেষক অহিদুর রহমান বলেন, হালটে অনাদরে গজিয়ে উঠা বিভিন্ন গাছের ঝোপ জঙ্গল জোনাকির নিরাপদ আবাসস্থল ছিল। কিন্তু গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পের মাধ্যমে পাকাকরণে ঝোপঝাড় ও গাছ-গাছালি ব্যাপকহারে নিধন হওয়ায় জোনাকি খাদ্য ও আবাস হারাচ্ছে। তাই গ্রামের পরে গ্রাম ঘুরেও এখন আর জোনাকির আলো দেখা মেলে না।

মধ্যনগরের হাতপাটন গ্রামের বাসিন্দা সত্তরউর্ধ্ব বয়সী প্রবীণ দ্বিজেন্দ্র তালুকদার জানান, এক দশক আগেও গ্রামে কিছু জোনাকির দেখা মিলত। এখন গ্রাম জোনাকিশূন্য। নতুন প্রজন্ম শুধু গল্প, কবিতা, গানে মায়াবী আলো ছড়ানো জোনাকির কথা শুনবে।

মধ্যনগরের পাহাড়ঘেঁষা সীমান্তবর্তী লক্ষীপুর গ্রামের বাসিন্দা কবি হাজং শ্রী দশরথ চন্দ্র অধিকারী বলেন, জোনাকি সাধারনত জলাশয়ের পাশে বাস করে। আর বৃষ্টির পানিতে সব কিটনাশক ধুয়ে জলাশয়ে মেশে। জোনাকীর জীবনচক্র এখন হুমকির মুখে। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো দেখা যাবে অনেক খুঁজেও জোনাকি পাওয়া যাবেনা। আমাদের এখনই একত্রে হতে হবে। কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে। নতুন প্রজম্মের জন্য হলেও এটা আমাদের করতে হবে।

সুনামগঞ্জ জেলার বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মকর্তা মাহমুদুল হক খান বলেন, এটা ঠিক যে, জোনাকী পোকা এখন আর চোখে পড়েনা। আমরা আগে দেখতাম গ্রামের ছোট ছোট ঝোপঝাড় অথবা বড় ছন ঘাস এসবের আশেপাশে জোনাকী পোকারা থাকতো। এখন প্রকৃতির উপর মানুষ অত্যাচার করায় প্রকৃতি বিরূপ হয়ে গেছে। হারিয়ে যাচ্ছে জীব-বৈচিত্র্য। প্রকৃতিতে ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে আমরা বন বিভাগ বনায়ন করছি। একই সাথে পশু-পাখি যাতে খাদ্যের অভাবে মারা না যায় প্রাকৃতিক ভাবে যেন তারা খাবার পায় সেজন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহন করেছি এবং এ লক্ষে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা প্রত্যেক বনায়নের সাথে পশু-পাখির খাদ্য উপযোগী কিছু গাছ রোপণ করে থাকি।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App