বাংলাদেশের সুইচ ব্যাংক এমসিসিএইচএসএল!

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০১:৫০ পিএম

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সঙ্গে দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আগষ্টিন পিউরীফিকেশন
মাত্র ১০ বছরের ব্যবধানে ২২২ কোটি টাকার একটি সমবায় প্রতিষ্ঠানের সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩০০ কোটি টাকার ওপরে। সদ্য সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড (এমসিসিএইচএসএল) আঙ্গুল ফুলে বটগাছ হয়েছে! অনৈতিক সুবিধা প্রধান ও কালো টাকা সাদা করার মাধ্যমে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সহায়তায় রকেট গতিতে বদলে গেছে প্রতিষ্ঠানটি। সমবায় আইনে নিবন্ধন নিলেও রীতিমতো ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে এই সোসাইটির বিরুদ্ধে। প্রতিষ্ঠানটির ভেতর-বাইরে এই নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশের অর্থখাতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির এমন গুরুতর উদাহরণ সৃষ্টিতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আগষ্টিন পিউরীফিকেশন। যিনি ইতিমধ্যে সমবায়ে মাফিয়া হিসেবে পরিচিত। এছাড়া তিনি আইনবহির্ভূতভাবে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রমের মাধ্যমে কালো টাকার আমানত গ্রহণ করেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে আগষ্টিন পিউরীফিকেশন দায়িত্বভার গ্রহণের সময় প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ছিল ২২২ কোটি টাকা। ১০ বছর পর ২০২২ সালে এসে এই সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৩০০ কোটি টাকার ওপরে।
সূত্রমতে, সমবায় সমিতি আইন ২০০১ (সংশোধিত ২০০২,ও ২০১৩) এর ২৬ ধারায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক ব্যতীত কোন সমবায় সমিতি উহার সদস্য ছাড়া অন্যকোন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নিকট থেকে আমানত গ্রহণ বা ঋণ প্রদান করতে পারবে না। অথচ দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির চেয়ারম্যান আগষ্টিন পিউরীফিকেশন আইন বহির্ভূতভাবে অখ্রীষ্টান ও অসদস্যদের সঞ্চয়ী বা বিনিয়োগকারী সদস্য নাম দিয়ে তাদের থেকে আমানত গ্রহণ করছেন।
এমনকি আইন ভঙ্গ করে তফসিলি ব্যাংকের আদলে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তথা সেন্ট্রাল অ্যাসোসিয়েশন অব খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভস, লক্ষ্মীবাজার খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, তুমিলিয়া খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, নাগরী খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, হারবাইদ খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, নয়ানগর খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, দড়িপাড়া খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, রাঙ্গামাটিয়া খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, ধরেন্ডা খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, ভাদুন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেড, মঠবাড়ী খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লিমিটেডসহ বিভিন্ন প্রাথমিক ও কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতিরও আমানত রাখছে; যা সমবায় আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যান আগষ্টিন পিউরীফিকেশন
বিশেষ করে মুসলিমসহ অন্যান্য অখ্রীষ্টান সরকারি কর্মকর্তাদের অবৈধভাবে উপার্জিত কালো টাকা চড়া সুদে আমানত রাখছেন। এমসিসিএইচএসএল-এর আমানতের বিপরীতে সুদের হার ব্যাংকের প্রচলিত সুদের হারের দ্বিগুণেরও বেশি। ১৫% পর্যন্ত সুদ দেয়া হয়। সমবায় অধিদপ্তরের অডিট রিপোর্টে নিবন্ধকের সার্কুলার ও ব্যাংকের প্রচলিত সুদের হারের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমানতের সুদের হার নির্ধারণ করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
সুদের হার বেশি, আমানতের বিপরীতে ব্যাংকের মত ভ্যাট ট্যাক্স দিতে হয় না, আবার খ্রীষ্টান প্রতিষ্ঠানে আমানত রাখলে কেউ জানতে পারবে না- এসব কারণে মুসলিম পুলিশ কর্মকর্তা, সমবায় অধিদপ্তরসহ বিভিন্ন দপ্তরের দুর্নীতিবাজ সরকারি কর্মকর্তারা তাদের উপার্জিত কালো টাকা এখানে আমানত রাখা নিরাপদ মনে করে রাখছেন বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, এক্ষেত্রে খ্রীষ্টান সদস্যদের আইডি ব্যবহার করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় অখ্রীষ্টানদের আমানত গ্রহণ করা হয়। খ্রীষ্টানদের সদস্য হওয়া বা আমানত রাখার ক্ষেত্রে বিবাহিতদের ক্ষেত্রে গির্জার বিবাহ সনদ এবং অবিবাহিতদের ক্ষেত্রে গির্জার বাপতিস্ম সনদ দাখিল করতে হয়।
আর মুসলিমসহ অন্যান্য অখ্রীষ্টান আমানতকারিদের নামে খ্রীষ্টান হওয়ার ভুয়া এফিডেভিট তৈরি করে ডকুমেন্টস হিসেবে অফিসে সংরক্ষিত করা হয়। কেবল কালো টাকা আমানত রাখার জন্যে কাগজপত্রে তারা খ্রীষ্টান সাজার অভিনব পন্থা অবলম্বন করে। এমসিসিএইচএসএল-এ মুসলিম নামে অনেক সঞ্চয়ী আমানত একাউন্টের সন্ধান পাওয়া গেছে। নিরাপদে কালো টাকা রাখার নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান হওয়ায় ইতিমধ্যে এমসিসিএইচএসএল বাংলাদেশের সুইচ ব্যাংক আখ্যা পেয়েছে।
এছাড়া সমবায় সমিতি আইন-২০১৩ (সংশোধন)-এর ১৮(১) ধারা ভঙ্গ করে এমসিসিএইচএসএল ১৪টি শাখা কার্যালয় এবং সমবায় সমিতি বিধিমালা-২০০৪ এর ১২(২) বিধি লঙ্ঘন করে অনুমোদিত কর্ম এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এ সকল বিষয়ে সমবায় অধিদপ্তর পরিচালিত অডিট রিপোর্টে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সমালোচনা করা হয়েছে।
বেআইনি আমানত গ্রহণ, শাখা পরিচালনা ও কর্ম এলাকার বাইরে কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধকরণ এবং সমবায় আইন, বিধিমালা ও এমসিসিএইচএসএল’র উপ-আইন বহির্ভূত কার্যক্রম থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে অডিট রিপোর্টে। দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম সম্পর্কে সমবায় অধিদপ্তর অবগত রয়েছে বলে জানা গেছে। তবে মাসোয়ারা গ্রহণকারী কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার পৃষ্ঠপোষকতায় নির্বিঘ্নে অবৈধ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সমবায় প্রতিষ্ঠানটি।
প্রসঙ্গত, আগষ্টিন পিউরীফিকেশন ১৯৬৩ সালের ২৬ নভেম্বর তুরাগ নদীর তীরবর্তী, তৎকালীন মাউছাইদ ধর্মপল্লীর অন্তর্গত পাগার গ্রামের গোপাল মাতব্বরের বাড়ির পিতা হীরা পিউরীফিকেশন ও মাতা আন্না কোড়াইয়ার পরিবারের জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারে ছয় ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি চতুর্থ।
ব্যক্তিজীবনে পিউরীফিকেশন ১৯৮৬ সালে ভেরোনিকা সুন্দরী রোজারিওকে বিয়ে করেন। তাদের পরিবারে দুই ছেলে। এক ছেলে বউ প্রমোদ ব্লেইস পিউরীফিকেশন ও তার স্ত্রী লীনা গমেজ এবং অন্য ছেলে পেপিলন হেনরী পিউরীফিকেশন ও তার স্ত্রী ডায়না গ্লোরিয়া রোজারিও। নাতি অভিক আগষ্টিন পিউরীফিকেশন, অ্যারিয়াস আগষ্টিন পিউরীফিকেশন ও আর্ভিক আগষ্টিন পিউরীফিকেশন।
আগষ্টিন পিউরীফিকেশনের ‘স্বস্তি নিবাস লিমিটেড’ নামে একটি আবাসন ও ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
১৯৭৭ সালের ১৪ এপ্রিলে ঢাকা শহরে খ্রিষ্টান ব্যক্তিদের আবাসনের সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে গঠিত হয় দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেড। আগষ্টিন পিউরীফিকেশন ২০০৩-২০০৬ মেয়াদে সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটির পরিচালক পদে নিয়োজিত হন। এরপর ২০০৬ সালে সোসাইটির ব্যবস্থাপনা কমিটির ম্যানেজার পদে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সোসাইটিতে দুই মেয়াদে দায়িত্ব পালন করার পর ২০১২ সালে দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি লিমিটেডের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন।
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে আগষ্টিন পিউরীফিকেশন দায়িত্বভার গ্রহণের সময় প্রতিষ্ঠানটির মোট সম্পদ ছিল ২২২ কোটি টাকা। যা ২০২২ সালে এসে হয়েছে ২৩০০ কোটি টাকার ওপর। তবে চলতি বছর পর্যন্ত কত টাকার সম্পদ হয়েছে সে তথ্য ওয়েবসাইটে উল্লেখ নেই। দি মেট্রোপলিটন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কালো টাকা সাদা করতে এখানে ক্রমশ সম্পদের পরিমাণ বেড়েই চলেছে।
সম্পদের পাহাড়ের ওপরে থাকা এমসিসিএইচএসএল-এর চেয়ারম্যান আগষ্টিন পিউরীফিকেশন সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১১৩, হোমল্যান্ড, মিশিগানে একটি বাড়ি ক্রয় করেছেন। বাড়ি ক্রয়ের সুবাদে তিনি টাকা পাচার করে আমেরিকায় নিয়ে গেছেন এবং সুস্পষ্টভাবে মানি লন্ডারিং করেছেন। তবে শেখ হাসিনার সরকারের সময় তার এমন উত্থান ও বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগ, প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক অনিয়ম, আইনের লঙ্ঘন ও কালো টাকা সাদা করার বিস্তর অভিযোগ থাকলেও তখন কেউ কথা বলার সাহস পায়নি।
এসব অভিযোগের বিষয়ে বহুবার আগষ্টিন পিউরীফিকেশনের সেল নাম্বার ও হোয়াটসঅ্যাপ নাম্বারে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তার সেল নাম্বার বন্ধ পাওয়া গেছে। এমনকি পরিচয় দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে তাকে ম্যাসেজ পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি।
তবে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সংবাদ সম্মেলনে সাবেক কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে চক্রান্তের অভিযোগ করেন খ্রীষ্টান কো-অপারেটিভ হাউজিং সোসাইটির চেয়ারম্যান আগস্টিন পিউরীফিকেশন। একইভাবে দেশের সব খ্রিষ্টান ক্রেডিট ইউনিয়নের সমন্বয়কারী সংস্থা দ্য কো-অপারেটিভ ক্রেডিট ইউনিয়ন লীগ অব বাংলাদেশ (কাল্ব) ঘিরেও ষড়যন্ত্র চলছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
সংবাদ সম্মেলনে আগস্টিন পিউরীফিকেশন বলেন, কাল্বের সাবেক বোর্ডের কিছু অসাধু পরিচালক দায়িত্ব পালনের সময় স্থাপনা নির্মাণ ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনার নামে বিপুল পরিমাণ অর্থ লুটপাট করেছেন। সাধারণ সদস্যদের দাবির মুখে বর্তমান কমিটি বিষয়টি খতিয়ে দেখতে অভ্যন্তরীণ তদন্ত করে। ওই চক্রের কেউ কেউ বতর্মান কমিটিতেও ছিলেন। অনিয়ম ও দুর্নীতি প্রমাণিত হওয়ায় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া শুরু হলে তারা পদত্যাগ করে আত্মগোপনে চলে যান। তদন্তে সাবেক কমিটির জমি কেনা ও কাল্ব রিসোর্টে বার অনুমোদনের লাইসেন্স বাবদ বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাৎ ধরা পড়ে। তাদের প্ররোচনায় প্রতিষ্ঠান দুটি ঘিরে অসত্য ও বানোয়াট তথ্য ছড়ানো হচ্ছে।