নিষিদ্ধ হলেই ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে, আইন কী বলছে?

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:২৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণার পর থেকে গত ছয় দিনে বেশ কয়েকজন নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। জুলাই-আগস্ট মাসের গণঅভ্যুত্থানে এই ছাত্র সংগঠনটির নেতাকর্মীদের ভূমিকার কারণে তাদের বিরুদ্ধে এর মধ্যে একাধিক মামলা হয়েছে।
এখন প্রশ্ন উঠেছে নিষিদ্ধ ঘোষিত হলেই কী কোন সংগঠনের নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করা যাবে? আইনে কী রয়েছে? আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাই বা কী বলছেন?
সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবীরা বলছেন, আইনানুযায়ী সংগঠন নিষিদ্ধ হোক বা না হোক সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যায় না। ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলেই গ্রেপ্তার করা যাবে। একই সঙ্গে সংগঠনকে নিষিদ্ধ ঘোষণার দিন থেকে যদি ওই সংগঠনের ব্যানারে কেউ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে তবে তাকে গ্রেপ্তার বা শাস্তির আওতায় আনা যাবে বলে জানিয়েছেন আইনজীবীরা।
আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জানিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। কোন মামলার আসামি হলে সেই ব্যক্তিদেরই গ্রেপ্তার করছে পুলিশ।
সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার
প্রায় প্রতিদিনই ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের পুলিশ গ্রেপ্তার করছে। রাজধানী ঢাকায় যাদের গ্রেপ্তার করা হয় পুলিশের পক্ষ থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তা জানানো হয়। পুলিশ জানিয়েছে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে সেক্ষেত্রে তাদেরকেই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে যদি সে কোন মামলার আসামী হয়ে থাকে। পুলিশ বলছে নিষিদ্ধ ঘোষিত সংগঠন কোন ধরনের তৎপরতা চালালে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, এখন যদি নিষিদ্ধ ঘোষিত কোন সংগঠন কোন রকমের তৎপরতা চালায় সেক্ষেত্রে তাদেরকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ কোন ধরনের কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলে।
আরো পড়ুন: রাষ্ট্রপতি অপসারণে বিএনপির আপত্তি কেন?
পুলিশের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ অক্টোবর থেকে ঢাকায় ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি, হল কমিটিসহ মোট ১২ জন নেতাকর্মীকে উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান করা হয়েছে। তাদেরকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা, হত্যার অভিযোগে করা মামলায় উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এছাড়া ঢাকার বাইরেও বিভিন্ন জেলায় ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের উপ-পুলিশ কমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান করা হয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতে সরকারি মহিলা কলেজে পরীক্ষার হল থেকে এক ছাত্রলীগ নেত্রীকে গ্রেপ্তারের বিষয়টি আলোড়ন তুলেছে। বিস্ফোরক মামলায় পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করেছে।
আইন যা বলছে
গত ২৩ অক্টোবর অন্তর্বর্তী সরকার বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে। ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন ২০০৯’ অনুযায়ী সরকার সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ সত্তা হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে।
এর আগে আওয়ামী লীগ সরকার এই আইন অনুযায়ী জামায়াতে ইসলামী, এর অঙ্গ সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে গত ১ আগস্ট নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিল। একই আইনে আগে হিযবুত তাহরীরকে নিষিদ্ধ করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলছেন, কারো বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অপরাধের অভিযোগ থাকলে গ্রেপ্তার করা যাবে। তিনি বলেন, ওদের বিরুদ্ধে কোন স্পেসিফিক অপরাধের অভিযোগ থাকলে যেমন মারামারি, গুলি করেছে, আগুন জ্বালিয়েছে ওইটার ক্ষেত্রে সংগঠন নিষিদ্ধ হোক বা না হোক কিছু যায় আসে না, গ্রেপ্তার করতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, ব্যক্তিগত ফৌজদারি অপরাধের অভিযোগ থাকলে ছাত্রলীগ হোক ছাত্রদল হোক অপরাধের জন্য অ্যারেস্ট করতে পারবে। নিষিদ্ধ সংগঠন যদি সাংগঠনিক কাজ করে তখন তাকে অ্যারেস্ট করতে পারবে।
আরো পড়ুন: সাংবাদিক ফারাবী হাফিজকে ‘দেখে নেয়ার’ হুমকি ছাত্রলীগের
আরেক আইনজীবী সিহাব উদ্দিন খান বলেছেন, আগে ছাত্রলীগ করেছে, শুধুমাত্র এই কারণে গ্রেপ্তার করলে সেটা আইনসিদ্ধ হবে না। ছাত্রলীগের পদধারী বা এ সংগঠনের রাজনীতি করলেই গ্রেপ্তার করা যাবে বিষয়টি এমন নয়। সন্ত্রাসবিরোধী আইনে যেদিন থেকে সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে সেদিন থেকে তারা কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না।
তিনি বলেন, নিষিদ্ধ করার পর থেকে যদি সংগঠনটির নেতাকর্মীরা তাদের ওই ব্যানারে সংগঠনের কোন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, সভা-সমাবেশ করে বা কোন ধরনের কর্মসূচি দেয় তাহলে শাস্তির আওতায় আসবে। তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কিন্তু কমিটিতে থাকলেই গ্রেপ্তার করা যাবে বিষয়টি এমন নয়।
উদাহরণস্বরূপ আইনজীবী সিহাব উদ্দিন খান বলেন, ফৌজদারি মামলায় যে কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলেই গ্রেপ্তার করা যাবে। যদি কোন ছাত্রলীগ কর্মী কোন হত্যা মামলার আসামী হয় তবে তাকে যে কোন সময় গ্রেপ্তার করতে পারবে।
এরই মধ্যে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জুলাই ফাউন্ডেশনের সাধারণ সম্পাদক সারজিস আলম এ গণগ্রেপ্তার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকলেই তাকে গ্রেপ্তার সমর্থন করেন না উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের) হলের কমিটিতে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্যই জুলাইয়ের আন্দোলন আগস্ট পর্যন্ত গড়িয়েছে।
পোস্টে তিনি লিখেছেন, এই ৮০% ছেলের কেউ যদি পূর্বে কোনো অন্যায়ের সঙ্গে জড়িত থাকে তবে তদন্ত সাপেক্ষে তার শাস্তি হোক, কেউ যদি পরে কোনো অন্যায়ে জড়িত হয় তবে তদন্ত সাপেক্ষে তারও শাস্তি হোক। কিন্তু যখন দরকার ছিল তখন রাজপথে নামালাম আর এখন ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের পোস্টেড দেখেই গণহারে গ্রেপ্তার হবে এটা কখনোই সমর্থন করি না। এটা হতে পারে না।
আইনে শাস্তি কী?
সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি সন্ত্রাসী কাজ করলে, সন্ত্রাসী কাজে অংশ নিলে, সন্ত্রাসী কাজের জন্য প্রস্তুতি নিলে বা সন্ত্রাসী কাজ সংঘটনে সাহায্য বা উৎসাহ দিলে সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত বলে বিবেচিত হবে। এছাড়া সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত কাউকে সমর্থন বা সহায়তা দিলেও সেই ব্যক্তি, সত্তা বা সংগঠন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত বলে বিবেচিত হবে।
এ আইনের ১০ ধারায় অপরাধ ও দণ্ড সম্পর্কে বলা হয়েছে। এতে বলা হয়, যদি কোন ব্যক্তি এই আইনের অধীন অপরাধ সংঘটনের ষড়যন্ত্র করেন, তাহলে তিনি উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত সর্বোচ্চ শাস্তির দুই তৃতীয়াংশ মেয়াদের যে কোন কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
আরো পড়ুন: যেভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বিএনপি
যদি উক্ত অপরাধের জন্য নির্ধারিত শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হয়, তাহলে অপরাধের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা অনূর্ধ্ব চৌদ্দ বছরের কারাদণ্ড হবে, কিন্তু তা চার বছরের কম হবে না। দোষী প্রমাণিত হলে অপরাধের গুরুত্ব অনুসারে এই আইনের আলোকে আদালত আসামীদের সাজা নির্ধারণ করেন।
যে কারণে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ
ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে গত ২৩ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার। সেই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, যেহেতু বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে বিশেষ করিয়া বিগত ১৫ বৎসরের স্বৈরাচারী শাসনামলে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগ হত্যা, নির্যাতন, গণরুম কেন্দ্রিক নিপীড়ন, ছাত্রাবাসে সিট বাণিজ্য, টেন্ডারবাজী, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়নসহ নানাবিধ জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিল এবং এ সম্পর্কিত প্রামাণ্য তথ্য দেশের সব গণমাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে এবং কিছু সন্ত্রাসী ঘটনায় সংগঠনটির নেতাকর্মীদের অপরাধ আদালতেও প্রমাণিত হইয়াছে।
যেহেতু ১৫ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রী ও সাধারণ জনগণকে উম্মুক্ত ও বেপরোয়া সশস্ত্র আক্রমণ করিয়া শত শত নিরপরাধ শিক্ষার্থী ও ব্যক্তিদের হত্যা করিয়াছে এবং আরো অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করিয়াছে।'
এ প্রজ্ঞাপনে সরকার জানিয়েছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পরেও ছাত্রলীগ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রমূলক, ধ্বংসাত্মক ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ড এবং বিভিন্ন সন্ত্রাসী কাজের সঙ্গে জড়িত রয়েছে। সরকারের কাছে যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ রয়েছে বলেও জানানো হয়েছে। এসব কারণে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়েছে।