×

সাময়িকী

দিদির স্বপ্ন কি পূরণ হবে না?

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ০৮:২৭ পিএম

দিদির স্বপ্ন কি পূরণ হবে না?
   

দিদি চলে গেছেন ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। দিদির আশ্রম গড়ার স্বপ্ন এখন ধূলিস্যাৎ হওয়ার পথে। দিদি চলে যাওয়ার পর তাঁর বই বিক্রিও স্থবির হয়ে গেছে। দিদির বাড়ি, যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পোড়া ঘর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স করার আশ্বাস দিয়েছিলেন বোয়ালখালীর সাংসদ মঈনুদ্দিন খান বাদল সাহেব। তিনি নিজেই তো চলে গেলেন হঠাৎ। দিদি রমা চৌধুরীর স্মৃতিও একদিন মুছে যাবে। এখনো চাইলে প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর দপ্তর থেকে দিদির স্বপ্ন ‘অনাথ আশ্রম’ এবং দিদির স্মৃতির উদ্দেশ্যে কিছু করতে পারেন।

২০১৩ সালের ২৭ জুলাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে গণভবনে দেখা করতে যান দিদি। দিদি, রমা চৌধুরী তখনো একাত্তরের জননী হিসেবে মানুষের কাছে পরিচিতি পাননি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের এই প্রক্রিয়ার সবটুকুজুড়ে আমি ছিলাম দিদির সার্বক্ষণিক সঙ্গী। দিদি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যেতে চাননি। দিদি ফোনে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল ভাইকে বলেছিলেন আমাকে দেখতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী নিজে আসুক আমার সাথে দেখা করতে। আমি যাবো না। দুদিন ধরে দিদি নারাজ ছিলেন যেতে। এসব কথা তখন মিডিয়ার মাধ্যমে অনেকেই জেনেছেন। তবুও শেষ পর্যন্ত দিদি আমাকে সাথে নিয়ে দেখা করতে যান প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে। কিন্তু দিদির শর্ত ছিল প্রধানমন্ত্রী তাঁকে যেন কিছু না দেন। দিলেও দিদি ফিরিয়ে দেবেন। দিদি কেন, কোন কারণে, কোন অভিমান থেকে এবং কতটা মনের জোরে নিজের চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যেও এমন কথা বললেন? দিদিকে কি প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছিলেন? দিদিকে কি দেশের মানুষরা বুঝেছিল? দিদি একজন সন্তানহারা, মুক্তিযুদ্ধের কারণে সর্বস্বহারা নির্যাতিত, নিষ্পেষিত নারী। সেই নারী, সেই মানুষটাকে আসলে কয়জন বুঝতে পেরেছিল?

২০১৩ সালের জুলাই মাসের ২৪ তারিখ ফোন করেন প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী মাহবুবুল হক শাকিল। তিনি ফোন করে দিদির সাথে কথা বলেন। দিদিকে আমন্ত্রণ জানান প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার। দিদি সবিনয়ে সে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। দিদি বলেন, আমি অতি সাধারণ একজন মানুষ আমার সাথে প্রধানমন্ত্রী দেখা করে কি করবেন? আর আমি কোথাও যাই না। আমার কয়েকটা পোষা বিড়াল আছে তাদের একা রেখে আমি কোথাও যেতে পারি না। শাকিল ভাই বলেন, কিছু করার জন্য নয়, আপনাকে একটু দেখতে চাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী। দিদি কোনোমতেই রাজি হন না। দিদি বলেন, আমাকে দেখতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী নিজে আসুক আমার কাছে। আমি তাঁকে দুইটা ডালভাত রান্না করে খাওয়াবো! দিদি সহজ সরল মানুষ তাই সহজেই এমন কথা বলতে পারেন। শাকিল ভাই বলেন, প্রধানমন্ত্রী তো একা কোথাও যেতে পারেন না, তাঁর সাথে অনেক লোক যাবেন। দিদি একজন শিশুর মতোই বলেন, যত লোক আসুক, আর্মি, পুলিশ যারাই আসুক আমার বিল্ডিংয়ের ছাদে সবাইকে বসাতে পারবো। আর সবাইকে খাওয়াতেও পারবো একবেলা। শাকিল ভাই দিদির শিশুসুলভ কথা শুনে আশ্চর্য হন আবার বেশ মজাও পান। সেদিন তিনি আমন্ত্রণ জানিয়ে বিফল হলেও আমাকে জানিয়ে রাখেন দিদি মত বদলালে তাঁকে যেন জানানো হয়। কিন্তু দিদি মত বদলান না। পরিচিত অনেকেই দিদিকে বোঝাতে চেষ্টা করেন। দিদি কিছুতেই রাজি হন না যেতে। পরদিন শাকিল ভাইয়ের প্রতিনিধি হয়ে আসেন সাবেক ছাত্র নেতা সীমান্ত তালুকদার। এসে সব খবরাখবর নেন দিদির। দিদি কীভাবে কোথায় থাকেন সব ছবি তুলে, ভিডিও করে পাঠিয়ে দেন শাকিল ভাইকে। সীমান্ত দা দিদিকে বারবার অনুরোধ করেন যেন দিদি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যান। সেদিনও শাকিল ভাই সীমান্ত দা’র ফোনে দিদির সাথে কথা বলেন। কিন্তু দিদি অনড় থাকেন তাঁর সিদ্ধান্তে। সীমান্ত দা আমাকে বলে যান তিনি ঢাকায় চলে যাচ্ছেন। আমি যেন চেষ্টা করি দিদিকে রাজি করাতে। সীমান্ত দা বলেন দিদি যেভাবে চান সেভাবেই নেয়া হবে। চাইলে আপডাউন প্লেনের টিকেটের ব্যবস্থা করে দেবেন। আমি বললাম ঠিক আছে যদি যেদিন গিয়ে সেদিন ফিরতে পারেন তাহলে হয়তো রাজি হতেও পারেন। কিন্তু আমি সেদিন রাজি করাতে পারি না। পরেরদিন শুক্রবার। আমাদের আগেই জানানো হয়েছে সাক্ষাৎ পর্ব অনুষ্ঠিত হবে শনিবার কিন্তু অন্তত দুদিন আগে সেটা ফাইনাল জানিয়ে রাখতে হবে। শুক্রবার ২৬ তারিখ বেলা ১১টার সময়ও ফাইনাল করতে পারি না যাওয়া।

অন্যদিকে সীমান্ত দা, শাকিল ভাই আমাকে ফোনে খবর নিচ্ছেন। দিদির সিদ্ধান্ত জানতে চাইছেন। আমি কিছুই জানাতে পারছি না। শুক্রবার বেলা ১১টার একটু পরে আমি চেরাগি পাহাড়ে তালেবের দোকানে চা খাচ্ছিলাম তখন সেখানে আসে দিদিকে নিয়ে বাক বদলের রিপোর্ট ‘একাত্তরে সব হারিয়ে বইয়ের ফেরিওয়ালা’ শিরোনামে বাংলা নিউজ টুয়েন্টি ফোর ডটকমের রিপোর্টার রমেন দাশগুপ্ত। রমেনকে আমি বললাম বিস্তারিত। ও শুনে আশ্চর্য হলো। আমি ওকে বললাম তোমার কথা তো দিদি শোনে তুমি একবার বুঝিয়ে বলো। রমেন সাথে সাথে বললো চলেন, আমি দিদিকে রাজি করাবো। রমেন আমার সাথে রুমে গিয়ে দিদিকে আবদার করে বললো, আপনি এটা ভালো করছেন না। আপনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে যাবেন না, আপনি বঙ্গবন্ধুর মেয়ের সাথে দেখা করতে যাবেন। আর আপনি তো নিজ থেকে যাচ্ছেন না, আপনি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমন্ত্রিত হয়ে যাচ্ছেন। এমন আরো অনেক কথা বলে দিদিকে রাজি করিয়ে ফেলে রমেন। আমি সাথে সাথে শাকিল ভাইকে জানাই। শাকিল ভাই আবার কথা বলেন দিদির সাথে। দিদি বলেন, আমি যেতে রাজি আছি তবে একটা শর্ত আছে আমার। আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে কিছু নিতে পারবো না। আমাকে তিনি দেখতে চাইছেন এবং তাঁর অনেক কাজ তাই আসতে পারছেন না আমার কাছে, এজন্যই আমি শুধু দেখা করতে যেতে পারি। তবে রাগ করবেন না ভাই, আমাকে প্রধানমন্ত্রী যেন কিছু দিতে না চায়। যদি চায় আমি কিন্তু নিতে পারবো না। শাকিল ভাই আবারো আশ্চর্য হলেও মেনে নিলেন দিদির শর্ত।

আমি সীমান্ত দা’কে জানালাম দিদি রাজি হয়েছেন। সীমান্ত দা খুশি হন তবে বলেন, এত দেরি করেছেন এখন তো কোনো ফ্লাইটের টিকেট পাবো না। আপনারা আজ রাতের ট্রেনেই রওনা দেন, আমি আপনাদের জন্য প্রথম শ্রেণির একটা স্লিপার বুকিং দিচ্ছি। বিকেল ৪টার মধ্যে সীমান্ত দা লোক পাঠালেন টিকেট নিয়ে। আমরা রাতের মেইলে রওনা দিলাম ঢাকার উদ্দেশে।

আমরা পরেরদিন সকাল ৭টায় ঢাকা এয়ারপোর্ট স্টেশনে নামলাম। সেখানে সীমান্ত দা’র এক বন্ধু আমাদের রিসিভ করে নিয়ে গেলেন তাঁর উত্তরার বাসায়। সেখানে সীমান্ত দা ছিলেন। সীমান্ত দাসহ আমরা গাড়িতে চলে গেলাম গণভবনের খুব কাছেই শাকিল ভাইয়ের বাসায়। সেখানে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আমরা সকাল ১০টায় গেলাম গণভবনে। দিদি খালি পায়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে গণভবনে দেখা করে খালি হাতে চলে এলেন। প্রধানমন্ত্রীকে নিজের দুটি বই উপহার দিয়ে এলেন। সেই সাক্ষাৎ পর্ব মিডিয়ার কল্যাণে সবার জানা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে দিদির জীবনে কী কোনো পরিবর্তন এসেছিলো? সেটা জানা হলো না কারোই।

প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে আসার পরে দিদি বেঁচে থাকতে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে আর কেউ কোনোদিন খবর নেয়নি। কেউ একটু জানতে চায়নি তিনি কেমন আছেন। এমনকি দিদি যখন মৃত্যু শয্যায় তখনো বিছানায় শুয়ে অনেক মিডিয়াতেই বলেছেন, আমি আমার বোন প্রধানমন্ত্রীকে একটু দেখতে চাই। কিন্তু জানি সেটা সম্ভব ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর এত ব্যস্ততা শত প্রটোকল পেরিয়ে দিদিকে দেখতে আসা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শুধু একটা কথা তবু বলছি দিদির স্বপ্ন সফল করায় প্রধানমন্ত্রী কিছুটা সহযোগিতা কি করতে পারতেন না? বা তাঁর দপ্তর থেকে কেউ সে উদ্যোগ কি নিতে পারতেন না? আসলে কি নির্লোভ, স্বাবলম্বী, স্বনির্ভর, আপন খেয়ালে চলা একজন প্রচারবিমুখ রমা চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রী বুঝতে পেরেছিলেন? যদি বুঝতেন তবে তাঁর সাথে দেখা করে বোন হিসেবে নিজের সম্পর্ক তৈরি করে আসার পরও কোনোদিন সেই বোনের খবর নেয়ার দরকার মনে করলেন না। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল এই কয় বছরে কেউ অন্তত দিদির আশ্রম গড়ার কাজে পাশে এসে দাঁড়ালেও তো দিদির স্বপ্ন সার্থকতা পেতে পারত।

দিদি চলে গেছেন ২০১৮ সালের ৩ সেপ্টেম্বর। দিদির আশ্রম গড়ার স্বপ্ন এখন ধূলিস্যাৎ হওয়ার পথে। দিদি চলে যাওয়ার পর তাঁর বই বিক্রিও স্থবির হয়ে গেছে। দিদির বাড়ি, যুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পোড়া ঘর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি কমপ্লেক্স করার আশ্বাস দিয়েছিলেন বোয়ালখালীর সাংসদ মঈনুদ্দিন খান বাদল সাহেব। তিনি নিজেই তো চলে গেলেন হঠাৎ। দিদি রমা চৌধুরীর স্মৃতিও একদিন মুছে যাবে। এখনো চাইলে প্রধানমন্ত্রী কিংবা তাঁর দপ্তর থেকে দিদির স্বপ্ন ‘অনাথ আশ্রম’ এবং দিদির স্মৃতির উদ্দেশ্যে কিছু করতে পারেন। দিদি জীবদ্দশায় কিছুই পেলেন না। তাঁর মৃত্যুর পর হলেও, তাঁর আত্মার শান্তি কামনায় কিছু একটা করে তাঁর স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখা উচিত। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একজন রমা চৌধুরীকে বুঝতে পারেননি। দেশের মানুষও তাঁকে বোঝেনি। আজ চাইলে দিদিকে কিছু দিতে না পারার গ্লানি থেকে মুক্তি পেতে পারেন সবাই। দিদির স্বপ্ন ‘দীপংকর স্মৃতি অনাথালয়’ গড়ে উঠতে পারে এখনো। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের পোড়া ভিটে সংরক্ষণে সবাই ব্রতী হোক সেটাই কামনা। দিদির ২য় মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাই তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App