সিসা দূষণ ও ঢাকাবাসীর সঙ্কট

ইলিয়াস মাহমুদ দিপু
প্রকাশ: ০৮ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৪৬ পিএম

ইলিয়াস মাহমুদ দিপু, জলবায়ু বিশ্লেষক
সিসা দূষণ বাংলাদেশের সাম্প্রতিক সময়ের নতুন এক নীরব মহামারির নাম। এই ধাতুর প্রভাবে আমাদের দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হুমকির মুখে পড়েছে। শুধু অর্থনীতি নয় আমাদের দেশের ভবিষ্যত মানবশক্তিকে গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। আমরা দেখেছি, ল্যানসেট প্ল্যানেটারি হেলথ জার্নালে প্রকাশিত গবেষণায় সিসার প্রভাব দেখা গেছে। আমাদের অজান্তেই সিসা দূষণ এখন বাংলাদেশের জন্য একটি ভয়াবহ সংকট বলা যায়। গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, সিসা দূষণ দেশের শিশুদের বুদ্ধিমত্তা কমিয়ে দিচ্ছে। আবার প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগের মতো মারাত্মক রোগের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে সিসা।
জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২ থেকে দেখা যায় ঢাকার সমন্বয়কৃত জনসংখ্যা ৪ কোটির মত। এই বিশাল জনসংখ্যার মধ্যে বড় একটা অংশ শিশু। শিশুরা সিসা দূষণের শিকার হয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে বাধার সম্মুখীন হচ্ছে, যার ফলে স্বাভাবিক শেখার অক্ষমতা, আচরণগত সমস্যা দেখা যায়। শিশুরা সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ হারিয়ে যাচ্ছে। গবেষণায় আরো দেখা গেছে, পাঁচ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে সিসা দূষণের কারণে আইকিউ কমে যাচ্ছে। বলা যায় দেশের জিডিপির ৩.৬ শতাংশের উপরে প্রভাব পড়ছে সিসা দূষণের কারণে।
শিশুদের পাশাপাশি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্যও সিসা দূষণ ভয়ঙ্কর। প্রতি বছর ২৫ বছরের বেশি বয়সী প্রায় ১ লাখ ৪০ হাজারের মত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক হৃদরোগে মারা যাচ্ছেন। বলা যায় এর অন্যতম কারণ সিসা দূষণ। বাংলাদেশে সিসা দূষণের প্রধান উৎসগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যবহৃত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ, সিসাযুক্ত রঙ, অ্যালুমিনিয়ামের বাসন, সিরামিকের খাবারের পাত্র, মশলা, খেলনা, প্রসাধনী, ও সিসার কারণে দূষিত পানি। এছাড়া দেশের ভৌগোলিক অবস্থানও একটি বড় ভূমিকা পালন করে। গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্র-মেঘনা অববাহিকার কারণে দক্ষিণাঞ্চলে সিসার ঘনত্ব বেশি, যা ধান, গম, সবজি এবং মাছের মতো খাদ্যদ্রব্যে দূষণ ছড়াচ্ছে।
শিশুরা প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় সিসার ক্ষতিকর প্রভাবের প্রতি বেশি সংবেদনশীল। সিসা শিশু-কিশোরের মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রে স্থায়ী ক্ষতি করে, যার ফলে বুদ্ধিমত্তা হ্রাস, আচরণগত সমস্যা এবং শিক্ষার অনেক মানসিক ও শারীরিক অক্ষমতা দেখা দেয়। ইউনিসেফ, আইইডিসিআর এবং আইসিডিডিআরবি পরিচালিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, খুলনা, টাঙ্গাইল, পটুয়াখালী এবং সিলেটের ৯৮০ শিশুর রক্তে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৪০ শতাংশ শিশুর রক্তে এবং ঢাকার ৫০০ শিশুর মধ্যে ৮০ শতাংশের রক্তে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নিরাপদ সীমা ৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি সিসা পাওয়া গেছে। এমনকি গর্ভবতী নারীদের ভ্রূণের মধ্যে সিসার বিষাক্ত প্রভাব ছড়িয়ে পরতে পারে।
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বাংলাদেশের সরকার ও বিভিন্ন সংস্থা ২০৪০ সালের মধ্যে সিসা দূষণ পুরোপুরি নির্মূল করার জন্য কাজ করছে। সিসার উৎস চিহ্নিত করা, রক্তে সিসার মাত্রা পর্যবেক্ষণ, বিষাক্ত স্থান পরিষ্কার ও সচেতনতা বৃদ্ধির মত কাজ নেয়া হচ্ছে। সরকারের পাশাপাশি নাগরিকদেরও সচেতন হতে হবে। সিসাযুক্ত রঙ, মশলা বা অন্যান্য দূষিত পণ্য ব্যবহারে সতর্ক থাকা এবং সঠিক তথ্য জানার জন্য জনসাধারণকে উৎসাহিত করতে হবে।
সিসা দূষণ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নীরব মহামারি। এটি শুধু শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের ক্ষতি করছে না, বরং দেশের অর্থনীতিকে দুর্বল করে তুলছে। এখনই সময় সিসা দূষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার। কারণ একটি সিসামুক্ত বাংলাদেশ মানে একটি সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
লেখক: ইলিয়াস মাহমুদ দিপু, জলবায়ু বিশ্লেষক, ইমেইল: eliasmdipu@gmail.com