জাতিসংঘের প্রতিবেদন
মীর মুগ্ধের মাথায় উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেল থেকে গুলি করা হয়েছিল

বাসস
প্রকাশ: ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ১০:১৭ পিএম

মীর মুগ্ধ। ফাইল ছবি
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত ১৮ জুলাই উত্তরায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহৃত উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সামরিক রাইফেল থেকে মীর মুগ্ধের মাথায় গুলি করা হয়েছিল।
১৮ জুলাই উত্তরায় বিক্ষোভকারীদের মধ্যে পানি বিতরণের সময় ২৫ বছর বয়সী ছাত্র মীর মুগ্ধকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার (ওএইচসিএইচআর) বুধবার (১২ ফেব্রুয়ারি) ‘বাংলাদেশে ২০২৪ সালের জুলাই ও আগস্টের বিক্ষোভের সঙ্গে সম্পর্কিত মানবাধিকার লঙ্ঘন ও নির্যাতন’ শীর্ষক তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
জাতিসংঘের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উত্তরায় সেদিন পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি’র বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে, ভুক্তভোগী ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকে জানা গেছে যে, বিএনএস সেন্টার, আজমপুর, উত্তরা পূর্ব পুলিশ স্টেশন এবং মাইলস্টোন কলেজসহ উত্তরার বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থী এবং অন্যান্য বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছিল।
সকালে একটি বড় বিক্ষোভের আগাম খবর পেয়ে ১৮ জুলাই সকালে র্যাব, আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন, বিজিবি, আনসার এবং সশস্ত্র আওয়ামী লীগ সমর্থকদের সহায়তায় পুলিশ বাহিনী উত্তরার বিএনএস সেন্টারে অবস্থান নেয়।
সকাল সাড়ে ১১টার দিকে পুলিশ এবং র্যাব বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য কাঁদানে গ্যাস, রাবার বুলেট এবং সাউন্ড গ্রেনেড নিক্ষেপ করলে সংঘর্ষ শুরু হয়।
একটি বিবরণে পরিস্থিতিকে ‘শব্দ ও ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন ভীতিকর পরিবেশ’ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ওএইচসিএইচআর একাধিক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানতে পেরেছে যে, একটি পুলিশ সাঁজোয়া যান বিক্ষোভকারীদের একটি দলকে ধাওয়া করছিল এবং পুলিশ অফিসাররা গাড়ি থেকে জনতার উপর গুলি চালাচ্ছিল।
জাতিসংঘের তথ্য অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দুপুরের পর পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে ওঠে। প্রত্যক্ষদর্শীরা পুলিশ ও র্যাবকে বিভিন্ন অবস্থান থেকে সামরিক রাইফেল থেকে বিক্ষোভকারীদের উপর প্রাণঘাতী গুলি চালানোর বর্ণনা দিয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ ও ছবিগুলো নিশ্চিত করে যে,উত্তরা থানার ছাদ থেকে পুলিশ গুলি চালাচ্ছিল।’
শত শত বিক্ষোভকারী গুলিবিদ্ধ হন এবং গুলিবিদ্ধ বেশ কয়েকজন মার যায়। নিকটবর্তী একটি হাসপাতালে ৯১ জন আহত রোগী চিকিৎসা নিয়েছে এবং ছয়জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে, যার মধ্যে পাঁচজন শিক্ষার্থী ছিলেন।
চিকিৎসা বিবরণ ও তথ্য বিশ্লেষণ করে ওএইচসিএইচআর নিশ্চিত হয়েছে যে, পুলিশ ও র্যাব সদস্যদের ব্যবহৃত প্রাণঘাতী গুলিতে তারা মারা গেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,‘নিহতদের মধ্যে মীর মুগ্ধও ছিলেন। ২৫ বছর বয়সী ছাত্র মুগ্ধ বিক্ষোভকারীদের মধ্যে পানি বিতরণ করছিলেন। পড়ন্ত বিকেলের দিকে রাইফেল থেকে তার মাথায় প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে গুলি করা হয়েছিল।’
ওএইচসিএইচআর একটি ভিডিও পেয়েছে যাতে দেখা গেছে যে, রবীন্দ্র সরণিতে মীর মুগ্ধকে বিকেল ৫টা ৫০ মিনিটে গুলি করার সময় ও স্থানটি রেকর্ড করা হয়েছে।
একই সময়ে একই এলাকায়, একজন প্রতিবাদী নেতার মাথায় গুলি করা হয়েছিল। তিনি বেঁচে গেলেও দীর্ঘমেয়াদী গুরুতর আঘাত পান। প্রথমে তাকে একটি সাউন্ড গ্রেনেড আঘাত করে, তারপর একটি ধাতব গুলি তার মাথার পিছনে আঘাত করে এবং তারপরে দুটি রাইফেলের গুলি তার মুখে লাগে।
প্রতিবেদন অনুসারে, একটি গুলি তার ভ্রুতে আঘাত করে, দ্বিতীয়টি তার নাকের পাশে ঢুকে মাথার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যায়। এই আঘাতের ফলে তার ডান কানের ৯৫ শতাংশ শ্রবণশক্তি হ্রাস পেয়েছে এবং ডান অক্সিপিটাল হাড়ে ফ্র্যাকচার হয়। তার স্নায়ুতে অপরিবর্তনীয় ক্ষতি হয়।
ওএইচসিএইচআর উল্লেখ করেছে যে, তারা চোখ, পেট, পিঠ এবং অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গে আঘাতপ্রাপ্ত আরো বেশ কয়েক জন ছাত্রের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য সংগ্রহ করেছে। একজন ছাত্রকে দুবার গুলি করা হয়েছিল, তার উপরের পায়ে ৪২টি ধাতব গুলির আঘাত রয়েছে। যখন সে ওএইচসিএইচআরের সঙ্গে তার গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনা সম্পর্কে কথা বলেছিল তখনও ত্বকের টিস্যুর গভীরে প্রবেশ করা একটি গুলি তার পায়ের ভিতরেই ছিল।
এই ভুক্তভোগীদের মেডিকেল রেকর্ডের ফরেনসিক পর্যালোচনা নিশ্চিত করেছে যে, তাদের ক্ষতগুলো শটগান থেকে ছোড়া ৮ নম্বর ধাতব গুলি দ্বারা সৃষ্ট। উত্তরা পূর্ব থানার কাছে একজন পুলিশ অফিসার ধাতব গুলি দিয়ে আরেক ছাত্রকে গুলি করেছিল।
ভুক্তভোগী বর্ণনা করেছেন যে, ‘আমি ভেবেছিলাম সে আমার মাথায় গুলি করেছে এবং সেই কারণেই আমি দেখতে পাচ্ছি না। আমি কল্পনাও করিনি যে, সে আমার চোখে গুলি করেছে।’
রিপোর্টে দেখা গেছে যে, আঘাতের ফলে তার রেটিনা, লেন্স এবং কর্নিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
তৃতীয় একজন ছাত্রকে বিকেল ৫টা ৩০ মিনিটের দিকে থানার কাছে দুবার প্রাণঘাতি গুলি করা হয়েছিল। প্রথম গুলিটি তার ডান হাতে আঘাত করেছিল এবং দ্বিতীয়টি তার পেটে আঘাত করেছিল। সে শ্বাসকষ্ট এবং বাড়ি ফিরতে না পারার ভয়ের কথা বর্ণনা করেছে।
জাতিসংঘের রিপোর্ট অনুসারে, ওএইচসিএইচআরের ফরেনসিক চিকিৎসকের পর্যালোচনায় মেডিকেল রেকর্ড ও ছবিগুলো ইঙ্গিত দেয় যে, উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাইফেলের গুলি তার বাহুতে আঘাত করেছিল।