ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত নিয়ে 'কঠোর অবস্থানে'র ইঙ্গিত স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১২ জানুয়ারি ২০২৫, ১১:৩৭ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জিরো লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে ভারতকে কোনও কাজ করতে দেয়া হবে না। এর মধ্যে তিনটি জেলার পাঁচটি সীমান্তে বিএসএফকে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। একই সঙ্গে সীমান্ত বিষয়ে সমঝোতা স্মারকগুলো লঙ্ঘন করে ভারত যেসব কাজ করতে চেয়েছিল সেসব বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
রবিবার (১২ জানুয়ারি) ঢাকায় সচিবালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, এখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতীয় হাইকমিশনারকে তলব করে বাংলাদেশের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত করবে। আমাদের বিজিবি শক্ত অবস্থান নেয়ায় তারা কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে। বিজিবিকে সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে।
সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক বৈঠকের পর বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে অবহিত করতে এ প্রেস ব্রিফিং ডাকা হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশের তিনটি জেলার কয়েকটি সীমান্তে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কয়েকটি স্থাপনা নির্মাণ কাজ নিয়ে আপত্তি তোলার পর সীমান্তে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে।
বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকো সীমান্তে সীমান্ত রক্ষীদের সঙ্গে গ্রামবাসীরা জড়ো হওয়ার ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার ঘটনা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে।অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে নানা ইস্যুতে টানাপোড়েনের মধ্য দিয়েই নতুন করে আবার সীমান্ত ইস্যুটি সামনে এলো। বিশেষ করে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীরা কয়েকটি এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ কাজ শুরুর পর বাংলাদেশের তরফ থেকে তীব্র প্রতিবাদ করা হচ্ছে।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানান, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ ও উভয় দেশের সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে এখন পর্যন্ত চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত যুগ্ম সীমান্ত নির্দেশাবলী-১৯৭৫ অনুযায়ী উভয় দেশের শূন্য লাইনের ১৫০ গজের মধ্যে প্রতিরক্ষা সামর্থ্যতা সম্বলিত যেকোনও কাজ সম্পন্নের বিষয়ে সুস্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এছাড়া শূন্য লাইন থেকে ১৫০ গজের ভেতরে কোনও উন্নয়নমূলক কাজ করতে হলে একে অপরের কাছ থেকে সম্মতি নিতে হবে। সম্মতি ছাড়া তারা করতে পারবে না। বিএসএফ কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু বিজিবি শক্ত অবস্থান নেয়ায় তা বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
জানা গেছে, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বিদ্যমান ৪ হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩২৭১ কিলোমিটারে কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে ভারত। বাকি আছে ৮৮৫ কিলোমিটার এবং এরই বিভিন্ন অংশে স্থাপনা নির্মাণ শুরু করলে বিজিবি তীব্র আপত্তি জানায়। কর্মকর্তারা বলছেন, এ আপত্তি জানানোর মূল কারণ হলো চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তিন বিঘা করিডোর, নওগাঁর পত্নীতলা ও লালমনিরহাটের ভারতীয়রা জিরো লাইন থেকে ১৫০ গজের মধ্যেই নির্মাণ কাজ শুরু করেছে, যা উভয় দেশের সমঝোতা অনুযায়ী হওয়ার কথা নয় বলে বাংলাদেশ মনে করে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, বিগত সরকারের আমলে ২০১০ সাল থেকে ২০২৩ সাল সময়ের মধ্যে কতগুলো অসম কাজ করা হয়েছে। সীমান্তে বেড়া দেয়া নিয়ে যেসব অসম সমঝোতা চুক্তি হয়েছে সেগুলো বাতিলের বিষয়ে পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশের অবস্থান জানাতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করা হয়েছে। তারা ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে অবহিত করবেন।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মতে, এটি ভারতের করা উচিত হয়নি। যদিও তিনি মনে করেন, বাংলাদেশে গত আওয়ামী লীগ সরকার ভারতকে করতে দিয়েছে বলেই তারা সেটি করেছে।
এর মধ্যে ১৬০টি স্থানে বেড়া দিয়েছে। আরও ৭৮টি স্থানে ঝামেলা রয়ে গেছে। জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, তিন বিঘা করিডোর, নওগাঁর পত্নীতলা ও লালমনিরহাটে সাম্প্রতিক সময়ে সমস্যা দেখা গিয়েছে। এসব নিয়ে বিজিবি-বিসিএফ আলোচনা হয়েছে। তবে বিজিবি শক্ত অবস্থান নেয়ায় তারা কাজ বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে।
প্রসঙ্গত, তিন বিঘা করিডোর নিয়ে বাংলাদেশ ভারত চুক্তির আলোকে বাংলাদেশে বায়াত্তর সালে সংসদে চুক্তি অনুমোদন করে বেরুবাড়ী ভারতকে হস্তান্তর করলেও ভারত তিন বিঘা করিডোরের কর্তৃত্ব বাংলাদেশকে দেয়নি। যদিও ২০১০ সালে উভয় দেশের মধ্যে চুক্তি অনুযায়ী করিডোর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার কথা। কিন্তু এখন সেখানেই জিরো লাইনে কাঁটাতারের বেড়া তৈরির উদ্যোগ নিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ।
তিনি বলেন, কিন্তু এর পরিবর্তে ঝামেলা হয়েছে দহগ্রাম আঙ্গরপোতায় জিরো লাইনে কাঁটাতারের বেড়া দিতে পারবে বলা হয়েছে। এখন আইনগতভাবে আমরা বাধা দিতে পারি না কারণ বাংলাদেশ সরকার লিখিত দিয়েছে। বিজিবি ও স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদের কারণে তিন বিঘা করিডোর ও নওগাঁর পত্নীতলাসহ কয়েকটি জায়গায় ভারত যে কাজ শুরু করেছিলো সেটি বন্ধ হয়েছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এ কাজগুলো আমরা করতে দিবো না। বরং আমরা চিঠি দিবো যাতে অসম চুক্তি বাদ দেয়া যায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়েছে। তারা (ভারত) সমস্যার চেষ্টা করলেও আমরা যেভাবে হোক সমাধানের চেষ্টা করবো।
উপদেষ্টার ব্রিফিংয়ের কিছুক্ষণ পরেই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলবে মন্ত্রণালয়ে হাজির হন ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। তার কাছে বাংলাদেশের আপত্তির বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
ভারতের দিক থেকে নতুন সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন এবং একই সঙ্গে নজরদারির জন্য একাধিক বৈদ্যুতিক যন্ত্র এবং অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সঙ্গে প্রহরীদের সতর্ক করার জন্যও কিছু যন্ত্র লাগানো হয়েছে বিভিন্ন জায়গায়। নতুন এই সমন্বিত ব্যবস্থাপনাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ বলছে 'ইলেকট্রনিক সারভেইল্যান্স অ্যাট ভালনারাবেল প্যাচেস– ইএসভিপি' বা 'অসুরক্ষিত এলাকাগুলির জন্য বৈদ্যুতিক নজরদারি' ব্যবস্থা।
অন্যদিকে যেসব স্থানে কাঁটাতারের বেড়া স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছে বিএসএফ তার কয়েকটি জিরো লাইন থেকে দেড়শ গজের ভেতরে হওয়াতেই আপত্তি করছে বাংলাদেশের বিজিবি। আবার যেখানে নদী বা অন্য কোন কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেয়ার সুযোগ নেই সেখানে নজরদারির জন্য উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাসহ বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে।
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের বাংলাদেশ অংশে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে তিন দিন ধরে একরকম টানাপোড়েন বা উত্তেজনার পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল, যার কিছু ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়ে পড়েছে। সেখানে সীমান্তের ১২০০ গজের মতো অংশে কোনও কাঁটাতারের বেড়া ছিল না এবং সেই বেড়া তৈরির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে ভারতের অভ্যন্তরে ১০০ গজ ভেতরে মাটি খোঁড়া হচ্ছিল বলে বাংলাদেশের বিজিবি জানিয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের তীব্র আপত্তির মুখে ভারতীয়দের কাজটি বন্ধ করতে হয়েছে।
এ নিয়ে কয়েক দফায় দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে পতাকা বৈঠক হলেও খুব একটা লাভ হয়নি। তবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জানিয়েছেন শেষ পর্যন্ত ভারতীয়রা 'কাজটি বন্ধ করতে বাধ্য হয়েছে'। এর আগে গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই বিভিন্ন ইস্যুতে ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক টানাপোড়েন শুরু হয়।
বিশেষ করে 'বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন' ও সনাতন ধর্মাবলম্বীদের একজন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা দেখা দেয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে কোলকাতা ও আগরতলায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনাও ঘটেছে। এছাড়া ভারতকে উদ্দেশ্য করে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার বক্তব্যও নানাভাবে আলোচনায় এসেছে। তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামকে উদ্ধৃত করে সরকারি বার্তা সংস্থা বাসস বলেছিল, 'ভারতের শাসকগোষ্ঠী ও হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলো দু'দেশের জনগণের মধ্যে গণতান্ত্রিক সম্পর্ক ও সম্প্রীতি চায় না'।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ কুমিল্লায় এক অনুষ্ঠানে বলেন, 'ভারতের সাথে নতজানু পররাষ্ট্রনীতি থেকে অন্তর্বর্তী সরকার সরে এসেছে'। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন গত মাসে নরসিংদীতে এক অনুষ্ঠানে বলেন, ভারতকে আমরা স্পষ্ট বার্তা দিয়েছি যে আমরা ভালো সম্পর্ক চাই, দুপক্ষেরই স্বার্থের ভিত্তিতে। আমরা সব দেশের সঙ্গেও সুসম্পর্ক চাই, সম্মানের ভিত্তিতে সমতার ভিত্তিতে। সেই লক্ষ্যেই সরকার কাজ করে যাচ্ছে।
'কূটনৈতিক সম্পর্কের দৃশ্যমান অবনতি' এবং উভয় দেশের 'রাজনৈতিক উত্তেজনার' মধ্যেই ডিসেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকায় বৈঠক করেছেন বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্র সচিব। সেই বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেন, আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে একটি ইতিবাচক ও গঠনমূলক সম্পর্ক গড়তে চাই, যা হতে হবে পারস্পরিক আস্থা, মর্যাদা, স্বার্থ ও একে অপরের উদ্বেগগুলো নিয়ে সংবেদনশীলতার ভিত্তিতে।
শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর দুই দেশের মধ্যে এটিই ছিলো উচ্চ পর্যায়ের প্রথম বৈঠক। বৈঠকে সীমান্ত, বাণিজ্য ও পানিসহ বিভিন্ন ইস্যু আলোচনায় এসেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সীমান্তের কয়েকটি জায়গায় স্থাপনা নিয়ে নির্মাণ বিরোধে জড়িয়ে পড়লো দুই দেশ এবং এতে উভয় পক্ষেই নিজ নিজ সীমান্ত রক্ষীদের সাথে স্থানীয় গ্রামবাসীদেরও যোগ দিতে দেখা গেছে।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার ব্রিফিংয়ের কিছুক্ষণের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মা। পরে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, সীমান্তে কাঁটা তারের বেড়ার বিষয়ে উভয় দেশের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। এ ব্যাপারে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ ও বিজিবির মধ্যে যোগাযোগ রয়েছে। আমরা আশা করি, সীমান্তে অপরাধ দমনের বিষয়ে সহযোগিতার মাধ্যমে সেই বোঝাপড়ার বাস্তবায়ন হবে। ভারতীয় হাইকমিশনার এসময় সীমান্তে অপরাধী চলাচল বন্ধ ও চোরাচালান ও পাচার দমন নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলেও জানান।