ফিরে দেখা ২০২৪
একতরফা নির্বাচন, ছাগলকাণ্ড, হাসিনার দেশত্যাগসহ যত বিরল ঘটনা

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১:১৮ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে ঘটনাবহুল এক বছর ২০২৪। সাড়ে ৩ দশকে দ্বিতীয়বারের মতো অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের ঘটনা ঘটলো। তবে স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে ক্ষমতায় থাকা কোনো সরকারপ্রধানের আন্দোলনের মুখে দেশত্যাগ করে অন্য দেশে আশ্রয় নেয়ার নজির এটাই প্রথম। বছরজুড়ে নির্বাচন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, আন্দোলন-বিক্ষোভ, সরকার পতন, নতুন সরকার গঠনের মতো একের পর এক চড়াই উৎরাইয়ের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ। মুখোমুখি হয়েছে নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতা ও সমীকরণের। এই সালতামামিতে বাংলাদেশের ২০২৪কে ফিরে দেখার চেষ্টা করা হয়েছে।
৭ জানুয়ারি: আরেকটি বিতর্কিত ভোট
আগের বছরের রাজনৈতিক অস্থিরতার ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সাল শুরু হয়েছিল রাজনৈতিক টানাপোড়েন ও অনিশ্চয়তাকে সামনে রেখে। সেই টানাপোড়েনের মধ্যেই ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর অনুপস্থিতি এবং ভোটার উপস্থিতির হারের কারণে বিতর্কিত হয় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড গড়ে পঞ্চমবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। বিএনপিবিহীন ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দুই শতাধিক আসন পেলেও আগের সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি মাত্র ১১টি আসন পায়। যেখানে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা মিলে পেয়েছেন ৬২ আসন। ফলে সংসদে বিরোধী দল কে হবে, তা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়।
ভারত বিরোধী প্রচারণা ও রাজনীতি
নির্বাচনের পরপর নতুন রূপে ভারত বিরোধী রাজনীতি দানা বাঁধতে থাকে বাংলাদেশে। গতি পায় 'ভারতীয় পণ্য বয়কট,' 'বয়কট ইন্ডিয়া' ও 'ইন্ডিয়া আউট' ক্যাম্পেইন। বিতর্কিত নির্বাচন করেও আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার জন্য দায়ী করা হয় ভারতের সমর্থনকে। বিরোধী দল বিএনপি ও সরকারি দল আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে রীতিমত রাজনৈতিক তর্কবিতর্ক চলে। বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়ে সামনে আসে আরো কয়েকটি রাজনৈতিক দল।
দুর্নীতি: ছাগল কাণ্ড ও অন্যান্য
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের 'দুর্নীতির ধারণা সূচকে' বাংলাদেশ বরাবরই নিচের দিকে অবস্থান করে। ২০২৪ সালের শুরুতে সংস্থাটি জানায়, আগের বছরে জরিপ অনুযায়ী দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে দেশটির অবস্থান দশম। চব্বিশে সাবেক সেনাপ্রধান, সাবেক পুলিশ প্রধানের দুর্নীতি সংক্রান্ত খবর ব্যাপকভাবে আলোচিত হয়। আরো কয়েকটি দুর্নীতির খবরও আলোড়ন তোলে জনপরিসরে।
২০ মে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল (অব.) আজিজ আহমেদ এবং তার পরিবারের সদস্যদের যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেশটি। গণতন্ত্রের অবনতি ও দুর্নীতিতে জড়িত থাকার কারণ দেখিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর এই নিষেধাজ্ঞা দেয়। তবে নিষেধাজ্ঞার প্রতিক্রিয়ায় সাবেক এ সেনাপ্রধান দাবি করেন শাস্তি পাওয়ার মতো কোনো অপরাধ তিনি করেননি।
আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে ঘুস গ্রহণের অভিযোগ আনে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয় ব্যক্তি স্বার্থের বিনিময়ে সরকারি নিয়োগের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তিনি। সাবেক পুলিশ প্রধান বেনজীর আহমেদের বিশাল বিত্ত-বৈভব নিয়ে গত ৩১ মার্চ প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশ করে দেশের একটি সংবাদপত্র। এরপর বিভিন্ন গণমাধ্যমে তার সম্পদ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়।
যেসব খবরে সাবেক এই আইজিপি ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ উঠে আসে। এসব অভিযোগর প্রেক্ষিতে তথ্য যাচাই বাছাই করে গত ১৮ই এপ্রিল অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এর দু'দিন পরে ২০ এপ্রিল ভিডিও বার্তায় বেনজীর আহমেদ দাবি করেন তিনি ও তার পরিবারের নামে যে সব খবর প্রকাশিত হচ্ছে তা মিথ্যা ও অসত্য। অবশ্য, এই আলোচনার মধ্যেই দেশ ছাড়েন।
২৩ মে বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি ও ব্যাংক হিসাব জব্দের করার আদেশ দেন আদালত। ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়ার 'অঢেল সম্পদ' নিয়েও প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। পুলিশ সদস্যদের নিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোকে "উদ্দেশ্যমূলক ও অতিরঞ্জিত" বলে অভিহিত করে এর প্রতিবাদ জানায় পুলিশ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন।
ঈদুল আযহা অর্থাৎ কোরবানির ঈদের আগে একটি এগ্রো ফার্ম থেকে কোরবানি উপলক্ষে '১৫ লাখ টাকার' একটি ছাগল কিনতে গিয়ে তুমুল আলোচনার জন্ম দেন মতিউর রহমান নামে এক রাজস্ব কর্মকর্তার ছেলে। ভাইরাল হওয়া খবরের সূত্র ধরে মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতির অভিযোগ সামনে আসতে থাকে। তার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, তার পিয়ন দুর্নীতি করে চারশো কোটি টাকা অবৈধ সম্পদের মালিক হয়েছেন। এই তথ্য জনমনে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে।
৫ জুন: মুক্তিযোদ্ধা কোটা পুনর্বহাল
ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকারি নিয়োগের দুই শ্রেণিতে কোটা ব্যবস্থা বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল, সেটি অবৈধ ঘোষণা করে উচ্চ আদালত। এর ফলে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহাল হয়। ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া আসতে থাকে শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে। যৌক্তিক সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনের কথা বলেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসগুলোতে দাবির সপক্ষে প্রচার-প্রচারণা শুরু হয়।
ঘটনাবহুল জুলাই: আন্দোলনের মাস
কোটা সংস্কার আন্দোলনের একই সময়ে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থা থেকে নিজেদের নাম কাটাতে আন্দোলনে নামেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা। জুন মাসে ধীরগতিতে আন্দোলনের যে প্রেক্ষাপট তৈরি হচ্ছিল জুলাইয়ের শুরুতে এসে সেটি গতি পায়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পৃথক আন্দোলনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো উত্তপ্ত এবং একইসঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রমের দিক থেকে স্থবির হয়ে পড়ে।
টানা কর্মসূচি চালিয়ে যেতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। 'বাংলা ব্লকেড' নামের কর্মসূচি ব্যাপক সাড়া ফেলে।এর মধ্যে ১০ তারিখে হাইকোর্টের দেয়া রায়ে স্থিতাবস্থা দেয় আপিল বিভাগ। তবে পরবর্তী শুনানির সময় ধার্য করে চার সপ্তাহ পর। ওই দিন দিবাগত রাতে চীন সফর থেকে ফেরেন শেখ হাসিনা। ১৪ই জুলাই চীন সফর উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে হাসিনা বলেন, কোটা নিয়ে আদালত থেকে সমাধান না আসলে সরকারের কিছু করার নেই।
তিনি সেখানে প্রশ্ন করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর এত ক্ষোভ কেন? মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতিপুতিরা পাবে? তার এই বক্তব্যের জেরে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। ওই রাত থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ বিক্ষোভ শুরু হয়। এ সময় স্লোগান দিতে দেখা যায় – তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার। বিক্ষোভ মোকাবেলায় বলপ্রয়োগের পথে হাঁটে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ।
সহিংসতায় রক্তাক্ত বিশ্ববিদ্যালয়
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি রাজধানীর বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলার খবর জানা যায়। দুই পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘাতে আহত হয় অনেকে। ১৬ জুলাই প্রথম প্রাণহানির ঘটনা ঘটে। আন্দোলনে ছাত্রলীগ ও পুলিশের সাথে সহিংসতায় সারা দেশে ছয় জনের মৃত্যু হয়। এদের মধ্যে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাইদের পুলিশের গুলির সামনে বুক পেতে দাঁড়ানো ও নিহত হওয়ার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
দেশজুড়েই বিক্ষোভের প্রতীক হয়ে ওঠেন রংপুরের এই শিক্ষার্থী। এদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রায় সব ক্যাম্পাস থেকে ছাত্রলীগ বিতাড়িত হয়। যা ক্ষমতাসীন দলের কোনো সংগঠনের জন্য একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ১৭ জুলাইও সংঘাত সহিংসতা অব্যাহত থাকে। দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। জাতির উদ্দেশে ভাষণে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা 'হত্যাকাণ্ডসহ অনভিপ্রেত ঘটনার তদন্তের" আশ্বাস দিয়ে বলেন, আমার বিশ্বাস, আমাদের ছাত্র সমাজ সর্বোচ্চ আদালত থেকে ন্যায় বিচার পাবে। তাদের হতাশ হতে হবে না।
১৮ ও ১৯ জুলাই
হত্যা ও হামলার প্রতিবাদে সারাদেশে ১৮ জুলাই কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। এদিন রাজধানীর শনির আখড়ায় পুলিশের সাথে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় পাল্টাপাল্টি ধাওয়া ও সংঘর্ষে বন্ধ হয়ে যায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক। বাড্ডা, উত্তরা, যাত্রাবাড়ি ও মিরপুর এলাকা রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকেও আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের সংঘাত-সহিংসতার খবর আসতে থাকে।
রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম - বাংলাদেশ টেলিভিশনের বা বিটিভি ভবনে আগুন দেয় বিক্ষুব্ধরা। এদিন ঢাকার বিভিন্ন রাস্তায় বিপুল সংখ্যক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী সমবেত হন। তাদের সঙ্গে কোথাও কোথাও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। ১৮ জুলাই বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত ২৫ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হতে পেরেছিল। আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল মৃত্যুর সংখ্যা আরো বেশি হবে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে মোবাইল ইন্টারনেটের সংযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এক পর্যায়ে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় মোবাইল ইন্টারনেট। রাতের বেলা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটও বন্ধ হয়ে যায়। উদ্ভুত পরিস্থতিতে আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনায় বসতে সরকার রাজি বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। আলোচনার প্রস্তাব নাকচ করে শিক্ষার্থীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
১৯ জুলাই শুক্রবারও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যাপক বিক্ষোভ ও সংঘর্ষ চলমান থাকে। জনপদগুলোতে থমথমে হয়ে ওঠে পরিস্থিতি। ঢাকায় মেট্রোরেল স্টেশন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের টোল প্লাজা, মিরপুর ইনডোর স্টেডিয়ামসহ বিভিন্ন সরকারি স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। নরসিংদীতে কারাগারে হামলা ও আগুনের পর আটশোর বেশি বন্দি পালানোর ঘটনা ঘটে। সারা দেশে সংঘর্ষে অন্তত ৫৬ জন নিহত হওয়ার তথ্য নিশ্চিতভাবে জানা যায়। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হওয়ার সংখ্যাও তার বেশ কয়েক গুণ বেশি ছিল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রাত ১২টা থেকে জারি করা হয় কারফিউ।
জুলাইয়ের শেষ ১০ দিন
কারফিউর মধ্যেও ২০ জুলাই শনিবার ঢাকা, সাভার, গাজীপুর, ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন স্থানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে বিক্ষোভকারীদের সংঘাতের ঘটনা ঘটে। বহু বিক্ষোভকারী হতাহত হন। ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে নিহত হন অন্তত ২৬ জন। এই কয়েক দিনে অন্তত ২০৮ জনের মৃত্যুর তথ্য নিশ্চিত করতে সমর্থ হয় বিবিসি বাংলা। এর মধ্যে কেবল ঢাকা মহানগরীর হাসপাতালগুলোতেই থেকেই অন্তত ১৬৫ জনের মৃত্যুর খবর আসে।
২২ জুলাই আপিল বিভাগের শুনানিতে কোটা পুনর্বহাল নিয়ে হাইকোর্টের রায় বাতিল হয়। মেধা ৯৩ শতাংশ, মুক্তিযোদ্ধা কোটা ৫ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী কোটা ১ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ও তৃতীয় লিঙ্গ কোটা ১ শতাংশ নির্ধারণের আদেশ দেয় আদালত। ২২ জুলাই, সোমবার কমপ্লিট শাটডাউন ৪৮ ঘণ্টার জন্য স্থগিতের ঘোষণা দেন কোটা আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম।
কারফিউ জারি থাকায় সহিংসতা হ্রাস পেতে থাকলেও উৎকণ্ঠা ও টানাপোড়েন চলতেই থাকে। আন্দোলনের জের ধরে ঢাকাসহ দেশের নানা জায়গায় গ্রেফতার ও মামলার সংখ্যা বাড়ে। ২৬ জুলাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তিন সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম ও আবু বাকের মজুমদারকে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ ওঠার পর রাতে গোয়েন্দা পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয় "নিরাপত্তাজনিত কারণে" তাদের হেফাজতে নেয়া হয়েছে।
পরের কয়েকদিনে আরো কয়েকজন সমন্বয়ককে ডিবি অফিসে নেয়া হয়। গোয়েন্দা পুলিশের 'হেফাজতে' থাকা অবস্থায় কর্মসূচি প্রত্যাহার করার একটি ভিডিও বার্তা দেন কোটা সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম। তবে অন্য সমন্বয়করা অভিযোগ করেন, জিম্মি করে নির্যাতনের মুখে এই বক্তব্য দেওয়ানো হয়েছে।
আগস্টের বাংলাদেশ
পহেলা আগস্ট জামায়াত ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্রশিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, সন্ত্রাসবিরোধী আইনের ২০০৯ এর ধারা ১৮(১) এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে, বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী এবং বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবিরসহ উহার সকল অঙ্গসংগঠনকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিষিদ্ধ ঘোষণা করিল।
দোসরা আগস্ট শিক্ষক ও নাগরিক সমাজের 'দ্রোহযাত্রা' কর্মসূচিতে যোগ দেন কয়েক হাজার মানুষ। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর হয়ে টিএসসি এলাকা ঘুরে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে সমাবেশ করেন তারা। তেসরা আগস্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ও চট্টগ্রামের নিউমার্কেট এলাকায় বিশাল সমাবেশ হয়, যেখানে অংশ নেন হাজার হাজার মানুষ। এছাড়া রংপুর, সিলেট, ফরিদপুর, রাজশাহী, বগুড়া, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ, বরগুনা, সিরাজগঞ্জ, কুমিল্লা, সিলেটসহ অনেক স্থানে মিছিল ও সমাবেশ হয়।
ঢাকার সমাবেশ থেকে সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ঘোষণা করা হয় এক দফা। সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, এ সরকারের কোনোভাবেই আর এক মিনিট ক্ষমতায় থাকার অধিকার নেই। শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করলেই হবে না, বরং যেসব খুন, লুটপাট, দুর্নীতি এদেশে হয়েছে তার বিচার হতে হবে। আমরা পদত্যাগ দিয়ে তাকে এক্সিট রুট দিতে চাই না। তাকে পদত্যাগও করতে হবে, বিচারের আওতায়ও আনতে হবে।
শেখ হাসিনা আলোচনার আগ্রহ প্রকাশ করলেও তারা তা প্রত্যাখ্যান করেন। আন্দোলনকারীদের তরফে চার তারিখ থেকে 'সর্বাত্মক অসহযোগ' কর্মসূচি পালনের ডাক দেয়া হয়। অসহযোগ কর্মসূচি ঘিরে উদ্ভূত পরিস্থিতি সামলাতে চার তারিখ থেকেই তিনদিনের সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সরকার। ৪ আগস্ট সারাদেশে সহিংসতায় পুলিশসহ অন্তত ৮৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়। আহত হন অনেক মানুষ। প্রথমে ৬ আগস্ট ঘোষণা করা হলেও পরে একদিন এগিয়ে পাঁচই অগাস্ট সরকার পতনের দাবিতে লং মার্চ টু ঢাকা'র ডাক দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
৫ আগস্ট: শেখ হাসিনার পতন
৫ জুন কোটা ব্যবস্থা পুনর্বহালকে ঘিরে যে অসন্তোষ দানা বাঁধে ঠিক দুই মাসের মাথায় সেটিই সরকারের ভিত একেবারে নড়বড়ে করে দেয়। জুলাইয়ের তৃতীয় সপ্তাহে দেশ ছেড়ে পালানোর গুজব ছড়ানোর পর শেখ হাসিনা সদর্পে বলেছিলেন "শেখ হাসিনা পালায় না"। অথচ, দুই সপ্তাহের মাথায় ক্ষমতা ও দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেন তিনি। চৌঠা ও পাঁচই আগস্ট সরকার বিরোধী বিক্ষোভ প্রতিহত করতে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ঢাকার ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে জমায়েত ও পাহারার ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু, সরকারবিরোধীদের সঙ্গে মুখোমুখি অবস্থানে টিকতে পারেনি তারা।
সকালের দিকে ঢাকার প্রবেশপথগুলো নিরাপত্তা বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বেলা বাড়ার পর থেকে উত্তরাসহ কয়েকটি এলাকা দিয়ে আন্দোলনকারীরা শহরের ভেতরে ঢুকতে শুরু করে।দুপুর নাগাদ ঢাকার পথঘাট আক্ষরিক অর্থেই আন্দোলনকারীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। লাখ লাখ মানুষকে ঢাকার প্রধান সড়কগুলোতে অবস্থান নিয়ে মিছিল করতে দেখা যায়। আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তর আইএসপিআর এক বিবৃতিতে জানায়, দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ সময় দুপুর দুইটায় জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। এর মধ্যেই খবর আসে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগের পর বাংলাদেশ ছেড়ে গেছেন। সাথে ছিলেন তার বোন শেখ রেহানা।
ততক্ষণে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবন ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ঢুকে পড়েছেন আন্দোলনকারীরা। অনেকেই গণভবনের ভেতরে ঢুকে ভাঙচুর করেন। চেয়ার-টেবিলসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র নিয়ে বের হতে দেখা যায় অনেককে। বিকেল চারটা নাগাদ সেনাসদর থেকে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করেছেন। এখন একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবো এবং এই সরকারের মাধ্যমে এ দেশের সব কার্যকলাপ চলবে। এর আগে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে বৈঠক করেন।
জেনারেল জামান জানান, ওই বৈঠকে জামায়াতের আমির, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতৃবৃন্দ, জোনায়েদ সাকি ও আসিফ নজরুল উপস্থিত ছিলেন। তবে বৈঠকে আওয়ামী লীগের কেউ ছিল না বলে জানান তিনি। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ সাক্ষী হলো সরকারপ্রধানের পালিয়ে যাওয়ার মতো নজিরবিহীন এক ঘটনার।
সরকারবিহীন তিন দিন
৫ তারিখ থেকে তিন দিন বাংলাদেশে কার্যত কোনো সরকার ছিল না। এতে নেতৃত্ব সংকটে প্রশাসনে এক ধরনের অচলাবস্থা তৈরি হয়, যার ফলে দেশটির আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে ব্যাপক অবনতি দেখা দেয়। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয় ও নেতাকর্মীদের অনেকের বাড়িঘরে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। কোথাও কোথাও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষজন আক্রান্ত হচ্ছেন বলে জানা যায়। থানা ও পুলিশ ফাঁড়িতেও হামলা হয়। বেশকিছু থানা ভাঙচুর করে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়, অস্ত্র লুট ও কয়েদি পালানোর মতো ঘটনাও ঘটে। চুরি, ছিনতাই ও ডাকাতির মতো ঘটনার খবরও আসে। নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিতে অরাজকতা ঠেকাতে সেনাবাহিনী ও আনসার সদস্যদের মাঠে নামানো হয়। অনেক এলাকা সাধারণ মানুষ বা স্বেচ্ছাসেবীরা পাহারা দেয়ার দায়িত্ব নেন।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠন
তিনদিন পর নোবেলজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করা হয়। প্রাথমিকভাবে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৭ জন। পরে সেটি বেড়ে ২৪ জনে দাঁড়ায়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা হাসান আরিফের মৃত্যুতে বর্তমানে উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য সংখ্যা ২৩ জন। সরকার গঠনের পরপরই পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন ও অভিনন্দন পান মুহাম্মদ ইউনূস।
অন্যদিকে সরকারি, আধা-সরকারি, এমনকি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদত্যাগের হিড়িক দেখা যায়। এক্ষেত্রে কেউ কেউ স্বেচ্ছায় পদ ছেড়েছেন। আবার অনেক প্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ, অপমান-অপদস্তসহ নানান চাপের মুখে কর্তা ব্যক্তিরা পদত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে দায়িত্ব ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বেশিরভাগ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, সহ-উপাচার্য, প্রক্টরসহ শীর্ষ পদের ব্যক্তিরা।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে প্রধান বিচারপতিসহ আপিল বিভাগের অন্য বিচারপতিরাও পদত্যাগ করেন। পদত্যাগ করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ অন্য কমিশনাররাও। দেশজুড়ে প্রশাসনে ব্যাপক রদবদল আনা হয়। সচিব থেকে শুরু করে জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার, ইউএনওসহ বিভিন্ন পদে পরিবর্তন আসে। দীর্ঘদিন ধরে কারাগারে থাকা বিরোধী রাজনীতিকদের অনেকে মুক্তি পেয়েছেন এর মধ্যে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ দলটির অনেক নেতাকে বিভিন্ন মামলায় দেয়া সাজা বাতিল করে আদালত। জঙ্গিবাদের অভিযোগে আটক কয়েকজনের মুক্তি পাওয়ার খবরও সংবাদের শিরোনাম হয়।
সংখ্যালঘু ইস্যু
সরকার পতনের পর সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের প্রতিবাদ ও অধিকার প্রশ্নে কয়েকটি সংগঠন সোচ্চার হয়। আট দফা দাবিতে চট্টগ্রামে তারা সমাবেশ করে। সনাতনী জাগরণ মঞ্চ নামে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম গঠিত হয়। এর মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতারকে কেন্দ্র করে পরবর্তীতে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। পুলিশের সাথে তার অনুসারীদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় সাইফুল ইসলাম নামে এক আইনজীবী নিহত হন।
আগে থেকেই ভারতীয় গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের তথ্য ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তবে বিবিসি'র অনুসন্ধানে দেখা যায় এসময় ভুয়া খবর ও ছবি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। সুনামগঞ্জসহ কয়েকটি জায়গায় বেশ কিছু হামলার ঘটনাও ঘটে।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
পাঁচই অগাস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে টানাপোড়েন ক্রমশ স্পষ্ট হতে থাকে। অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক মোটামুটি সচল থাকলেও ভিসা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে পড়ে। জনসাধারণ পর্যায়েও সম্পর্কের একটা বড় অবনতি হয়েছে। একদিকে ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যমে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংখ্যালঘু এবং হিন্দুদের ওপর হামলা এবং অত্যাচারের নানা রকম তথ্য, অপতথ্য এবং গুজব ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখা গেছে।
অন্যদিকে, অভ্যুত্থানকারী ছাত্রনেতা এবং বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যায় ও প্রভাবশালী রাজনৈতিক শক্তিগুলো থেকে ভারতকে নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য করা হয় তাতেও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের অবনতি ঘটে। দুই দেশের মধ্যে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য বিবৃতিও চলে আসছে। অগাস্টের শেষ ভাগে বাংলাদেশের ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলে হঠাৎ বন্যা পরিস্থিতি তীব্র আকার ধারণ করে।
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় সব নদীই বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইতে থাকে। প্রাথমিকভাবে সেখানকার ডম্বুর বাঁধের গেট খুলে দেওয়ার খবর জানা গেলেও পরবর্তীতে রাজ্য সরকার জানায় পানি উপচে ভাটিতে থাকা বাংলাদেশকে প্লাবিত করেছে। তবে এ ঘটনায় ভারত সরকারের প্রতি 'অসহযোগিতা' ও 'অমানবিকতার অভিযোগ আনেন বাংলাদেশের অনেকে। তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম মন্তব্য করেন, বাংলাদেশের পূর্ব ও উত্তর পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ভারত 'অমানবিকতার পরিচয়' দিয়েছে।
ঘটনা আরো ঘনীভূত হয় সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের গ্রেফতার ও তার জামিন নামঞ্জুরকে কেন্দ্র করে সহিংসতা, এবং এসময় আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফের হত্যার ঘটনা ঘিরে। মি. দাসের মুক্তির দাবিতে কলকাতার ডেপুটি হাইকমিশন অভিমুখে কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপিসহ কয়েকটি ধর্মীয় সংগঠন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করতে শুরু করে। ভারতে আরো কয়েকটি বাংলাদেশি মিশনের কাছেও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের খবর পাওয়া যায়।
ঘটনা পরম্পরায় ২৮ নভেম্বর কলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়। বাংলাদেশেও ভারতের পতাকাকে অবমাননা করা হচ্ছে এমন অভিযোগে সরব হন ভারতের অনেকে। এরপর দোসরা ডিসেম্বর হঠাৎই আগরতলায় বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে হামলা, ভাঙচুর ও পতাকা অবমাননার ঘটনা ঘটে।
এ ঘটনায় বাংলাদেশ 'ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া' জানায়। অন্যদিকে ভারত দুঃখ প্রকাশ করে। পরবর্তীতে এ ঘটনায় কয়েকজনকে আটক ও তিন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। ডিসেম্বরের শেষে ভারত থেকে শেখ হাসিনাকে ফেরাতে একটি কূটনৈতিক পত্র বা 'নোট ভার্বালে' পাঠায় বাংলাদেশ।
সংস্কার ও বিচার
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর রাষ্ট্র সংস্কারের দাবি ক্রমশ জোরালো হয়ে ওঠে। সেই প্রেক্ষাপটে গুরুত্বপূর্ণ ছয়টি প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার সংস্কারে ছয় বিশিষ্ট নাগরিককে দায়িত্ব দেয়ার ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। অন্তর্বর্তী সরকারের এক মাস পার হওয়ার পর জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে এ ঘোষণা দেন প্রধান উপদেষ্টা। পরে একে একে বিভিন্ন খাতের সংস্কারের জন্য গঠিত কমিশনের মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫টিতে।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার দেশের অর্থনীতিকে কোন অবস্থায় রেখে গেছে তা জানতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে। শ্বেতপত্র বলা হয় - গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে ২৮ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। এর মধ্যে আদালতের রায়ে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী আংশিক বাতিল হয়ে যায়। এর ফলে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তনে আইনি বাধা দূর হয়ে যায়।
কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ঘটা হত্যা, নির্যাতনের বিচার করতে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুর্নগঠন করে সরকার। হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ নয় জনের বিরুদ্ধে তদন্ত করার সিদ্ধান্ত নেয় ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউশন। পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার পরিবার এবং তার মন্ত্রী-এমপিদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অজস্র অভিযোগ ও সংবাদ সামনে আসতে থাকে। মামলা হয়, তদন্ত শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন।
নাজুক ব্যাংক খাত: তারল্য সংকট
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাত নিয়ে দীর্ঘ দিন ধরেই চলছে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা। সেই চর্চায় বছরের শুরুর দিকে নতুন রসদ যোগায় 'নয়টি ব্যাংক রেড জোনে অবস্থান করছে', এই মর্মে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি গবেষণা প্রতিবেদন। তার আগে থেকেই ব্যাংকিং খাতকে সংস্কারের উদ্দেশ্যে সব দুর্বল বা খারাপ ব্যাংককে সবল বা ভালো ব্যাংকের সাথে একীভূত করার পরামর্শ দিয়ে আসছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। যদিও শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক পালাবদলে একীভূতকরণ কার্যকর হয়নি।
বছরের মাঝামাঝি থেকে বেসরকারি খাতের নয়টি ব্যাংকে তারল্য সংকট প্রকট হয়ে ওঠে। গ্রাহকদের প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহ করতে পারছিল না তারা। নভেম্বরে সাড়ে ২২ হাজার কোটি টাকা ছাপিয়ে ছয়টি দুর্বল ব্যাংককে দেয়ার কথা জানান নতুন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
ডলার ও রিজার্ভ সংকট
ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে অর্থনীতির ওপর চাপ বাড়তে থাকে। মে মাসে ডলারের বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি চালু করে ব্যাংকগুলোকে ১১৭ টাকায় মার্কিন ডলার ক্রয় বিক্রয় করতে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর আগে ১১০ টাকার আশেপাশে ডলার কেনাবেচা হচ্ছিলো। সর্বশেষ ১২৭ টাকায় ডিসেম্বরে ডলার বিক্রি হয় বাংলাদেশে। ওই মাসেই আগের দুই মাসের আমদানি বিল পরিশোধের পর ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ তের বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে আসার খবর প্রকাশ হওয়ায় পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে ওঠার আশঙ্কা তৈরি হয়। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর বছরের শেষ দিকে রিজার্ভ আবার ২০ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যায়।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন অন্তর্বর্তী সরকারের ১০০ দিনে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, "অন্তর্বর্তী সরকারের সময়কালে যে উদ্যোগ থেকে সবচেয়ে বেশি ফলাফল দেখা যাচ্ছে সেটা বৈদেশিক মুদ্রা বাজার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে।