নারী আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব
বেগম রোকেয়া দিবস আজ

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮:৩০ পিএম

ছবি : সংগৃহীত
আজ থেকে ১৪৪ বছর আগে, ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর, রংপুর জেলার মিঠাপুকুর থানার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বেগম রোকেয়া। আজ তার জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বেগম রোকেয়া।
তিনি নারী আন্দোলনের এক অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্ব। প্রকৃত নাম রোকেয়া খাতুন হলেও বিয়ের পর তিনি পরিচিত হন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন নামে। বাঙালি নারী শিক্ষা, সমাজে নারীর অধিকার ও মুক্তির প্রশ্নে তিনি ছিলেন প্রথম সুর তুলে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর।
বেগম রোকেয়া না থাকলে যে নারী শামসুননাহার হলের বাইরে তার গ্রাফিতি মোছে সে হয়তো আজ বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়ার মতো সুযোগই পেত না।
বেগম রোকেয়া ছিলেন সাহিত্যের একজন অগ্রগণ্য নাম। নারী শিক্ষা, মুসলিম নারীদের অধিকার এবং সমাজের নানা বৈষম্যের বিরুদ্ধে তার লেখনি ছিল প্রখর প্রতিবাদ। নারীর পেছনে আটকে থাকা কুসংস্কার ও অবরোধের বিপক্ষে তিনি সাহসী কণ্ঠে লিখেছিলেন, “যাহা যাহা পুরুষ পারিবে তাহাই নারী পারিবে।”
বেগম রোকেয়ার জন্ম হয়েছিল এক রক্ষণশীল মুসলিম জমিদার পরিবারে। তার বাবা আবু আলী হায়দার সাবের ছিলেন বিভিন্ন ভাষায় পারদর্শী, তবে মেয়েদের শিক্ষা বিষয়ে ছিলেন অত্যন্ত রক্ষণশীল। সেই সময়কার সমাজব্যবস্থার কারণে মেয়েরা শিক্ষা লাভে বাধাগ্রস্ত হলেও বেগম রোকেয়া তার বড় ভাই ইব্রাহীম সাবেরের সহায়তায় গোপনে বাংলা ও ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণ করেন।
১৮৯৮ সালে ১৮ বছর বয়সে বেগম রোকেয়ার জীবনসঙ্গী হন সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেন, যিনি ছিলেন এক মুক্তমনামী মানুষ। তার স্বামীর উৎসাহ ও সহযোগিতায় রোকেয়া শিক্ষায় এবং সাহিত্য চর্চায় পূর্ণভাবে মনোনিবেশ করেন। স্বামী সাখাওয়াত হোসেনের সহযোগিতায় ১৯০২ সালে ‘পিপাসা’ নামে একটি বাংলা গল্প রচনা করে সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন তিনি।
বেগম রোকেয়া সমাজের অবস্থা পরিবর্তন করতে তার লেখনীর মাধ্যমে নারী সমাজকে সচেতন করার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি তার রচিত গ্রন্থ “পদ্মরাগ”, “অবরোধবাসিনী”, “মতিচুর” এবং “সুলতানার স্বপ্ন”-এর মাধ্যমে নারী সমাজের অধিকার, শিক্ষা ও স্বাধীনতার জন্য কণ্ঠ তুলেন। “সুলতানার স্বপ্ন” গ্রন্থে তিনি প্রথমবারের মতো এক নারী চরিত্রের মাধ্যমে আধুনিক বিশ্বের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে নারী স্বাধীনভাবে শাসন ও নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
১৯০৯ সালে স্বামীর মৃত্যু পর, বেগম রোকেয়া ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন, যা পরে কলকাতায় পুনরায় চালু হয় এবং ১৯৩০ সালে মেয়েদের হাইস্কুলে পরিণত হয়। এছাড়া, তিনি ১৯১৬ সালে ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলাম’ নামে একটি মুসলিম মহিলা সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন, যা মুসলিম নারী সমাজের অধিকার ও উন্নয়নের জন্য কাজ করেছিল।
বেগম রোকেয়া নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা ও লিঙ্গসমতার পক্ষে বিভিন্ন প্রবন্ধ, গল্প ও উপন্যাসে যুক্তি তুলে ধরেছিলেন। তার বিশ্বাস ছিল, যে সমাজে নারীকে শিক্ষার অধিকার দেওয়া না হয়, সে সমাজ কখনও উন্নতির পথে এগিয়ে যেতে পারে না। তিনি তার সাহিত্যে ধর্মের দোহাই দিয়ে নারীর পিছিয়ে পড়ার কোনো যুক্তি মানেননি।
বেগম রোকেয়ার অবদান শুধু সাহিত্যে সীমাবদ্ধ ছিল না, তিনি নারী সমাজের উন্নয়ন এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেছেন জীবনব্যাপী। ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর, মাত্র ৫২ বছর বয়সে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
তার অসামান্য অবদানের জন্য বেগম রোকেয়া এখনো সর্বজন শ্রদ্ধেয়। ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর রংপুর বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ২০০৯ সালে তা বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে নামকরণ করা হয়। ঢাকায় তার নামে একটি আবাসিক হল এবং রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে একটি স্মৃতিকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।
বেগম রোকেয়ার অবদান চিরকাল স্মরণীয় থাকবে, কারণ তিনি নারী সমাজের উন্নয়নে যে আলোকবর্তিকা প্রজ্জ্বলিত করেছেন, তা আজও আমাদের পথপ্রদর্শক।