ঢাকার বিপদ আরো বাড়বে, কারণ জানা গেলো

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ০৮ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৫০ পিএম

নতুন করে আবারো সংশোধন হচ্ছে ড্যাপ।
বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-ড্যাপের (২০২২-৩৫) ফলে সুযোগ এসেছিল নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর। সুযোগ এসেছিল পরিকল্পিত ও বাসযোগ্য ঢাকা গড়ার; সেইসঙ্গে এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা ও জনঘনত্ব বাড়ানোরও। কিন্তু রাজউকের আওতাধীন সব এলাকা ও ১৬ ফুট রাস্তা পর্যন্ত যে হারে ‘ফার’ (এফএআর)-এর মান বাড়ানো হয়েছে, তাতে শহরকে বাসযোগ্য করার শেষ সুযোগও হাতছাড়া হতে যাচ্ছে। কারণ নতুন করে আবারো সংশোধন হচ্ছে ড্যাপ। এরই মধ্যে জনসাধারণের মতামতের জন্য সংশোধিত ড্যাপের খসড়া বিধিমালা দেয়া হয়েছে রাজউকের ওয়েব সাইটে। এরপর গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। প্রশ্ন উঠছে, নতুন ড্যাপ কার স্বার্থে, লাভবান হবে কে? আর ক্ষতিগ্রস্ত হবে কে? এ নিয়ে চলছে নানা আলোচনা-সমালোচনা।
নগরবিদদের মতে, আবারো ড্যাপ সংশোধনের ফলে পুরো সুবিধা পাবেন আবাসন ব্যবসায়ীরা। আর ভয়াবহ চাপ পড়বে ঢাকার ওপর, বাসযোগ্যতা হারাবে রাজধানী নগরী। ঝুঁকিতে পড়বে নগর জীবন। আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবি, নতুন ড্যাপ ঢাকার ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি করবে না, উল্টো চাপ কমবে। আবাসনের ব্যবস্থা হবে অনেক মানুষের। জানা গেছে, আবাসন ব্যবসায়ীদের প্রধান দাবি ছিল ‘ফার’ বাড়ানোর। সেই দাবি মেনে নিতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তে দ্বিমত নগরবিদদের। তাদের মতে আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবির মুখে এভাবে ছাড় দিলে পরিকল্পিত নগর গড়ার পরিকল্পনায় বিরাট অন্তরায় দেখা দেবে।
গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সম্প্রতি খসড়া ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০২৪ ও বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) (২০২২-২০৩৫) সংশোধনবিষয়ক কমিটির একটি সভা রাজউকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেই সভায় ‘ফার’-এর বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে আলোচনা হয়েছে। এরিয়া ‘ফার’ এর বিষয়ে রাজউক-২ করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সেটি ন্যূনতম তিন করার প্রস্তাব করে। এরপর সেটি নিয়ে কাজ করে রাজউক। ফার বাড়িয়ে খসড়া ওয়েব সাইটে প্রকাশ করে জনমত যাছাইয়ের জন্য।
নতুন প্রস্তাবনায় এরিয়াভিত্তিক ফারের প্রস্তাবনা আগে যেখানে ১ দশমিক ৩ ছিল সেখানে ৩ দশমিক ০০ থেকে শুরু করা হয়েছে। কাঠা প্রতি প্রাপ্ত ফ্লাটের সংখ্যা যেখানে ড্যাপে ছিল ১ দশমিক ২০, বর্তমানে তা বাড়িয়ে ২ দশমিক ৩০ থেকে শুরু করা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে ধরা যাক, ড্যাপে বাড্ডা এলাকার এরিয়া ফার ছিল ২ দশমিক ০ এবং কাঠা প্রতি প্রাপ্ত ফ্লাটের সংখ্যা ছিল ১ দশকি ৬০। ড্যাপের সংশোধনী প্রস্তাবে বাড্ডার ফার প্রস্তাব করা হয়েছে ৩ দশমিক ৪০ এবং কাঠা প্রতি প্রাপ্ত ফ্ল্যাটের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩ দশমিক ০০।
এভাবে প্রস্তাবিত সংশোধনীতে রাজউক আওতাধীন প্রতিটি এলাকায় ফারের মান ও কাঠাপ্রতি প্রাপ্ত ফ্লাটের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। এছাড়া, রোডভিত্তিক ফারের মানও উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ানো হয়েছে। দেয়া হয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইনসেনটিভ প্রস্তাবনা। সরাসরি সংশোধিত গেজেট প্রস্তাবের পরিবর্তে পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে সংশোধিত প্রস্তাবনা গণশুনানির জন্য ১৫ দিন জনসাধারণের জন্য রাজউকের ওয়েবসাইটে উন্মুক্ত রাখা হয়েছে। যদি কারো কোনো যৌক্তিক মতামত থাকে তা লিখিত আকারে রাজউক গ্রহণ করবে এবং সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করবে।
ড্যাপ সংশোধনীর ক্ষেত্রে রাজউকের এই উদ্যোগের সমালোচনা করছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। প্রস্তাবিত সংশোধনীকে তারা আবাসন ব্যবসায়ীবান্ধব হিসেবে উল্লেখ করছেন। বলছেন, এতে ঢাকা মহানগরীকে ফেলে দেয়া হচ্ছে ঝুঁকির মুখে। নগর পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান ভোরের কাগজকে বলেন, ড্যাপের সংশোধনী তিন বছর পর শুরু হওয়ার কথা ছিল। অথচ এরই মধ্যে রিহ্যাব ও স্থাপতি ইনস্টিটিউটের চাপে এক দফা সংশোধনী হয়েছে। নতুন করে আবার সংশোধনীটাও এই গোষ্ঠীর স্বার্থেই করা হচ্ছে। ভালো কোনো উদ্দেশ্যে বা শহরের জনগণের স্বার্থে হচ্ছে না। কিছু আর্কিটেক্ট, ইঞ্জিনিয়ার ও রাজউকের ভেতরের একটি চক্র এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। কিন্তু এতে করে শহরের বাস যোগ্যতায় কি প্রভাব পড়বে, সেটা নিয়ে তাদের কোনো চিন্তা নেই। শুনেছি রাজউকের অভ্যন্তরীণ মিটিংয়ে ৩-এর নিচে ফার না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের দাবি হলো, ইচ্ছামতো তাদের ভবন বানাতে দিতে হবে। তিনি বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীরা রাজউক চেয়ারম্যানকে বোঝাতে চাইছে- ঢাকা শহরে বহুতল ভবন বানানো হলে আবাসন সমস্যা সমাধান হবে। তাদের দাবি মেনে যদি ছোট ছোট প্লটে বহুতল ভবন করা হয়, তাহলে এই শহর আর টিকবে না। অলরেডি ট্রাফিক জ্যামের কারণে ঢাকা শহরে চলা যায় না। ঢাকা শহরে যে ঘনত্ব থাকার কথা, তার চেয়ে তিন চার গুণ বেশি আছে। বিশ্বের কোনো শহরেই এরকম ঘনত্ব নেই। অথচ আমরা রাজউকের দায়িত্বশীলদের কথার সুরে আবাসন ব্যবসায়ীদের কথার প্রতিধ্বনী পাই। শহরের বাসযোগ্যতা, উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তাদের মুখে কোনো কথা নেই। সাধারণ মানুষের যে আবেদন- বাসযোগ্য শহর গড়া, সেটা রাজউক করছে না। রাজউক ব্যবসায়ীদের পক্ষে দাঁড়িয়েছে। কাজেই ভবিষ্যতে রাজউককে এর দায় নিতে হবে।
পরিবেশবান্ধব ও বাসযোগ্য ঢাকা করতে ভবনের নকশার অনুমোদন দেয় রাজউক। এক্ষেত্রে ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮’ মেনে চলতে হয়। বিদ্যমান বিধিমালায় পুরান ঢাকার কোনো এলাকার রাস্তা যদি ৩০ ফুট চওড়া হয় এবং সেই রাস্তার পাশে কারো ৫ কাঠা জায়গা থাকে, তাহলে তিনি সেখানে যে উচ্চতার ভবন করতে পারেন, গুলশান বা সাভারেও একই উচ্চতার ভবন নির্মাণ করা যায়। বর্তমানে রাজউকের আওতাধীন সব এলাকাতেই এফএআরের (ফার) মান সমান। ফার হচ্ছে কোনো একটি প্লট বা জমির আয়তনের বিপরীতে নির্মিত ইমারতের সব ফ্লোর বা তলায় সর্বমোট কত আয়তনের ভবন নির্মাণ করা যায়, তার সূচক। ফারের মাধ্যমে ভবনের উচ্চতা, ফ্ল্যাটের আয়তন, কতগুলো ফ্ল্যাট হবে- সেটা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয় নতুন বিধিমালায়। তবে ভবনের উচ্চতা কমে যায়। ফলে, আবাসন ব্যবসায় চরম ধস নামে। নতুন বিধিমালা অনুযায়ী ছোট প্লটে আর বড় ভবন করার সুযোগ নেই। সবশেষ ইমারত নির্মাণ বিধিমালায় কোনো এলাকার ফার আড়াই (২ দশমিক ৫) ও সেখানে প্লটের ফার যদি ৩ নির্ধারণ করা হয়, তবে ড্যাপের মতে সর্বনিম্ন ফার কাউন্ট করতে হবে। অর্থাৎ এখানে কাউন্ট হবে আড়াই। এতে কমে আসবে বিল্ডিংয়ের উচ্চতা। রাস্তা হবে প্রশস্ত।
আবাসন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন রিহ্যাবের সিনিয়র সহসভাপতি লিয়াকত আলী ভূঁইয়া ভোরের কাগজকে বলেন, কিছু কিছু নগরবিদ ড্যাপ সংশোধনের বিরোধিতা করছেন। কিন্তু ড্যাপ সংশোধন হলে নতুন ড্যাপে ঢাকার ওপর কোনো চাপ পড়বে না, উল্টো কমবে। কারণ আমরা চাচ্ছি, ভবন ওপরের দিকে বাড়বে, নিচের দিকে নয়। এটা হলে তখন ঢাকার ভেতরে আরো লোকের আবাসনের ব্যবস্থা হবে। আরো বেশি মানুষ ঢুকাতে পারব ঢাকায়। তখন লোকসংখ্যা কমে আসবে। আর ড্যাপের বর্তমান নিয়মে ঢাকার ওপর চাপ বেশি হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, সংশোধিত ড্যাপকেও আমরা বৈষম্যমূলক বলছি, কারণ গুলশানে একরকম, ধানমন্ডিতে একরম। অথচ মলিবাগ, খিলগাঁও, মিরপুরসহ নিম্ন এলাকায় ফার কমানো হয়েছে অনেক। এতে করে বিল্ডিং ও ফ্ল্যাট ছোট হয়ে যাবে।
উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, পুরান ঢাকার একটি পরিবারের ছয় ভাইবোন পরিকল্পনা করেছে- তারা বিল্ডিং করবে এবং ১০টা ফ্ল্যাট হবে। কিন্তু এখন যে ড্যাপ আছে, সেটা অনুযায়ী ৩ থেকে ৪টা ফ্ল্যাট হবে। তখন দেখা যাবে ভাইবোনের মধ্যে বনিবনা হবে না। একে অপরের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমায় চলে যাবে। তিনি বলেন, যারা বলেন, আবাসন ব্যবসায়ীদের স্বার্থে ড্যাপ সংশোধন করা হচ্ছে, এটা ভুল। কারণ আমরাই শুধু বিল্ডিং বানাব না, জনগণও বিল্ডিং বানাবে। এতেই তো স্পষ্ট যে জনগণও এর সুফলটা পাবেন। গুলশান-বনানীতে বেশি ফার দেবেন আর অন্য জায়গায় দেবেন না, সেটা তো হতে পারে না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একজন কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, বাংলাদেশ ন্যশন্যাল বিল্ডিং কোড-২০০৬ বাস্তবায়ন উপযোগী করে ঢাকার সব স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়ে রাস্তাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা বিধান বাতিল করে ফার-এর বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সে সময় ঢাকা মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৬ জারি করা হয়। ওয়ান ইলেভেনের সরকার ভবনের উচ্চতা আরো বাড়িয়ে ২০০৬ সালের বিধিমালা ২০০৭ সালে সংশোধন করে। এই সংশোধন পছন্দ না হওয়ায় রিহ্যাব ও একটি পেশাজীবী প্রতিষ্ঠানের যৌথ উদ্যোগে ২০০৮ সালে আবার বিধিমালার সংশোধনী আনা হয়।
২০০৮ সালে সংশোধনীর ফলে ঢাকা শহরে ব্যাঙের ছাতার মতো ব্যত্যয়কৃত ভবনের সংখ্যা ও জনসংখ্যার ঘনত্বই শুধু বেড়েছে। কিন্তু শহর বসবাস উপযোগী হয়নি। স্বার্থান্বেষী এই গ্রুপ ভবন ব্যত্যয় ও জনঘনত্ব বাড়ানোর জন্য শুধু রাজউককে দায়ী করে। রাজউকের সক্ষমতার অভাবে নাকি ঢাকা শহরে ভবন ব্যত্যয় সংঘটিত হয়েছে। একটি শহরের ৯৫ শতাংশ ভবনের ব্যত্যয় প্রমাণ করে ভবন ব্যত্যয়ের জন্য ভবন নির্মাণকারী এবং রাজউকসহ নির্মাণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবাই দায়ী। বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা-ড্যাপ (২০২২-৩৫) এর গেজেট জারির পর সুযোগ এসেছিল নাগরিক সুবিধা বাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এলাকাভিত্তিক ভবনের উচ্চতা ও জনঘনত্ব বাড়ানোর এবং প্রতি বছর গরমের সময় সংঘটিত অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনার। রাজউকের আওতাধীন সব এলাকায় এবং ১৬ ফুট রাস্তা পর্যন্ত যে হারে ফারের মান বাড়ানো হয়েছে তাতে শহরকে বাসযোগ্য করার শেষ সুযোগও হাতছাড়া হতে যাচ্ছে।
সেন্টার ফর হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চের নির্বাহী পরিচালক প্রকৌশলী মো. আবু সাদেক ভোরের কাগজকে বলেন, আমরা বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক সমালোচনা করি। কিন্তু তাদের কয়েকটি ভালো কাজের মধ্যে একটি হলো ড্যাপ প্রণয়ন (২০২২-২০৩৫)। একটা অপরিকল্পিত নগরীকে পরিকল্পিত নগরায়ণে রূপ দেয়ার একটা ভালো পদক্ষেপ এই ড্যাপ। যদিও কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতি এখানে আছে। ড্যাপ সংশোধনের দরকার হলে অন্তত ৫ বছর অপেক্ষা করা যেত। অথচ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা বিবেচনায় না নিয়ে ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থে ড্যাপের পরিবর্তন করা হচ্ছে।