ছাত্র আন্দোলনে হত্যা ও নির্যাতনের ঘটনায় জড়িতদের বিচার হওয়ার পর আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্য স্বাগত জানানো হবে বলে জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, তারা যে কারো মতো স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে। আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব।

বৃহস্পতিবার (২১ নভেম্বর) বিখ্যাত মার্কিন সাময়িকী টাইম ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা জানান তিনি।

ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ক্ষমতায় থাকাকালে আওয়ামী লীগ যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করেছে সেগুলোর বিচার শেষে দলটিকে নির্বাচন করতে দেয়া হবে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে স্বাগত জানানো হবে, যখন (দলটির) যারা হত্যা ও ক্ষমতার অপব্যহারের সঙ্গে জড়িত তাদের বিচার সম্পন্ন হবে। অন্যরা নির্বাচনে অংশ নিতে যতটা স্বাধীন তারাও ততটাই স্বাধীন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক অঙ্গনে লড়াই করব।

সাক্ষাৎকারে তিনি জুলাই-আগস্টের ছাত্র আন্দোলনের বিষয়ে বলেন, ঢাকার রাস্তাগুলো মাইলের পর মাইলজুড়ে শেখ হাসিনার কার্টুন আঁকা হয়েছে। এই আন্দোলনের মাধ্যমে জনগণ তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।

তবে দেয়াল চিত্রের ভাষা নিয়ে নোবেল বিজয়ী তরুণদের ক্ষমা করতে প্রস্তুত। টাইম ম্যাগাজিনকে তিনি বলেন, এই শব্দগুলো খুবই বিস্ফোরক। কিন্তু তরুণদের মস্তিষ্কে আছে আইডিয়া, উচ্চাশা আর স্বপ্ন। তারা এই ম্যুরালগুলোতে তাদের ভবিষ্যৎ কল্পনা করেছে, যা বাংলাদেশের আগে কখনো দেখা যায়নি।

ইউনূস বলেন, পূর্ববর্তী সরকার পুরোপুরি দমনমূলক পরিবেশ তৈরি করেছিল। হত্যা, গুম, প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে দিয়েছিল। এটি ছিল একটি ফ্যাসিবাদী শাসন।

নির্বাচনের আগে সংস্কারের বিষয়টি অন্য যে কোনো কিছুর চেয়ে যে গুরুত্বপূর্ণ সেটি পুনর্ব্যক্ত করেছেন ড. ইউনূস। তবে এই সংস্কারের জন্য মানুষের জীবনমান উন্নয়ন করা দরকার। যদি জীবনমান উন্নয়ন না হয় তাহলে মানুষ ধৈর্য্যহারা হয়ে যেতে পারেন; এমনকি বলতে পারেন আওয়ামী লীগের সময়ই ভালো ছিল।

এ বিষয়টি ড. ইউনূসের বেশ ভালো করেই জানা রয়েছে। যে কারণে সাধারণ মানুষের জীবনমান উন্নয়নের জন্য কাজ করবেন বলে জানান তিনি। প্রফেসর ইউনূস বলেছেন, এই পুরো অভ্যুত্থানের মূল হলো সংস্কার। এ কারণেই আমরা এটিকে বলছি বাংলাদেশ ২.০।

আরো পড়ুন : শেখ হাসিনাকে ফেরানোর নির্দেশনা নিয়ে যা জানালেন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে চলে যাওয়া এবং সেখান থেকে তার কথা বলার বিষয়টি নিয়ে নিজের অভিমত জানিয়েছেন প্রফেসর ইউনূস। তিনি বলেছেন, তাকে শুধু ভারত আশ্রয়ই দেয়নি। সবচেয়ে খারাপ বিষয় হলো, তিনি সেখান থেকে কথা বলছেন। যা আমাদের জন্য অনেক সমস্যার সৃষ্টি করছে। তার কণ্ঠ শুনলেই মানুষ অখুশি হয়। অর্থাৎ এই বিষয়টি আমাদের বন্ধ করতে হবে।

ড. ইউনূস বলেন, আওয়ামী সরকারের আমলে যেসব অর্থ পাচার হয়েছে সেগুলো তারা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। আর এক্ষত্রে ইউরোপিয়ান কমিশনের (ইসি) প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন তাকে সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেন, যেসব দেশকেই আমরা পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার কথা বলেছি, তারা আমাদের সাহায্য করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও তারা এই বিষয়টি করেছিল।

ড. ইউনূস বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর যখন তাকে দায়িত্ব নিতে বলা হয়, তখন প্রথমে তিনি দায়িত্ব নিতে চাননি। কিন্তু পরবর্তীতে গণঅভ্যুত্থানে নিহত মানুষ ও তাদের পরিবারের কথা চিন্তা করে প্রধান উপদেষ্টার শপথ নেন। তিনি বলেন, প্রথমে, আমি দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমি বলেছি, অন্য কাউকে খুঁজে বের করুন। কিন্তু পরবর্তীতে বলেছি, ঠিক আছে, আপনারা জীবন দিয়েছেন, আপনাদের বন্ধুরা জীবন দিয়েছেন। তাহলে আমি আমার সেরাটা চেষ্টা করব।

আরো পড়ুন : আ. লীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ নিয়ে পাল্টাপাল্টি বক্তব্য, কোনো মন্তব্য নেই নতুন সিইসির

যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে নোবেলজয়ী এই অর্থনীতিবিদের সম্পর্কের বিষয়টিও উঠে এসেছে টাইম ম্যাগাজিনের সাক্ষাৎকারে। এতে বলা হয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে প্রফেসর ইউনূসের ভালো সম্পর্ক রয়েছে। এ কারণে শেখ হাসিনার পতনের পরও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখতে পেরেছে।

কিন্তু ট্রাম্পের আবারো ক্ষমতায় আসার বিষয়টি গভীর চিন্তার উদ্রেক করেছে। এরমধ্যে আবার গত ৩১ অক্টোবর ট্রাম্প বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের ওপর কথিত নির্যাতন নিয়ে একটি পোস্ট দিয়েছেন। বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ এবং ভারতীয় আমেরিকানরা ট্রাম্পকে দিয়ে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে চাইছে; যে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সবচেয়ে বেশি তৈরি পোশাক রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এরমধ্যে ড. ইউনূসের সঙ্গে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত দ্বন্দ্ব আছে। ২০১৬ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটন ট্রাম্পের কাছে হেরে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় ড. ইউনূস বলেছিলেন তিনি কথাও বলতে পারছেন না।

তবে টাইম ম্যাগাজিনকে ড. ইউনূস বলেছেন, তার বিশ্বাস ট্রাম্পের সঙ্গে কাজ করার ক্ষেত্রে তিনি সহাবস্থান তৈরি করতে পারবেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প হলেন একজন ব্যবসায়ী। আমরাও একটি ব্যবসাতে আছি। আমরা তাদের বলছি না আমাদের অনুদান দিয়ে সহায়তা করে সমস্যা থেকে মুক্ত করুন। আমরা আসলে ব্যবসায়িক পার্টনার চাই।