পুলিশ নিয়োগে ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা
আসাদুজ্জামান কামালের বস্তায় বস্তায় 'ঘুষ সাম্রাজ্য' চলতো যেভাবে

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১৫ আগস্ট ২০২৪, ০৮:৪৭ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে সিন্ডিকেট করে বস্তায় বস্তায় ঘুষ বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
দুদক জানায়,স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই পুলিশ, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এবং ফায়ার সার্ভিস থেকে ঘুষ হিসেবে বস্তা বস্তা টাকা নিতেন আসাদুজ্জামান খান কামাল। এজন্য সাবেক একজন অতিরিক্ত সচিবের যোগসাজশে সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন তিনি। ইতোমধ্যে এ নিয়ে একাধিক অভিযোগ এসেছে।
অভিযোগ অনুসন্ধানে দুর্নীতি দমন কমিশনের উপপরিচালক মো. জাহাঙ্গীর আলমের নেতৃত্বে একটি টিম গঠন করা হয়েছে। দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা আকতারুল ইসলাম এই তথ্য জানিয়েছেন।
অভিযোগ সংক্রান্ত একটি লিখিত সারসংক্ষেপে বলা হয়েছে, সেই সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয় এবং ঝুঁকি এড়াতে টাকাগুলো দেশের বাইরে পাঠানো হয়।
পুলিশ নিয়োগ বিষয়ক অভিযোগও রয়েছে। জেলায় পুলিশ সুপার নিয়োগে সর্বনিম্ন ৮০ লাখ থেকে ২ কোটি টাকা পর্যন্ত নেয়া হতো। এছাড়া সিন্ডিকেটের আশীর্বাদ ছাড়া পুলিশের কেউ কোনো জেলায় বা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন না পাওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়।
এনজিও’র ‘নো অবজেকশন সার্টিফিকেট’ বা ‘এনওসি’ দিতেও ৮০ লাখ থেকে ১ কোটি টাকা পর্যন্ত ঘুষের অভিযোগ রয়েছে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। ২০১৮ সালে রাজধানীর উত্তরা এলাকার একটি উন্নয়ন সংস্থার এনওসি নিতে গেলে বিপত্তি শুরু হয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে। পুলিশের বিশেষ শাখা, জেলা প্রশাসক, এনএসআই ইতিবাচক প্রতিবেদন দাখিল করে।
তারপরও অদৃশ্য কারণে ফাইলটি মাসের পর মাস আটকে রাখা হয় মন্ত্রণালয়ে। বাধ্য হয়ে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে নির্বাচনের আগে মন্ত্রীকে ৮৫ লাখ টাকা দেয় সেই এনজিও। মনিপুরী পাড়ায় আসাদুজ্জামান কামালের বাসার সামনে টাকার ব্যাগটি দেয়া হয় তার পরিবারের এক সদস্যের কাছে।
২০২২ সালে গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) একজন কমিশনার নিয়োগে ৫ কোটি টাকার লেনদেনের বিবরণ তুলে ধরে বলা হয়, এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেয়া হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের ফার্মগেটের বাসায়।
২০২২ সালের ৩০ জুন গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের (জিএমপি) কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান ডিআইজি মোল্ল্যা নজরুল ইসলাম। ৫ কোটি টাকার বিনিময়ে তাকে গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে পদায়ন করা হয়। এর মাস খানেক আগে হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের কাছে ৫ কোটি টাকার একটি চেক দেন মোল্ল্যা নজরুল।
গাজীপুরের কমিশনার হিসেবে নিয়োগের পর হোটেল ওয়েস্টিনে হারুন অর রশীদের কাছ থেকে ৫ কোটি টাকার চেক ফেরত নেন। এর বদলে তিনি নগদ টাকা ২ কোটি আর বাকি ৩ কোটি টাকার আরেকটি চেক দেন। আর লেনদেনের এসব টাকা বস্তায় ভরে পৌঁছে দেয়া হতো আসাদুজ্জামান খান কামালের তেজগাঁওয়ের মনিপুরী পাড়া এলাকার বাসায়।
ফায়ার সার্ভিস এবং সিভিল ডিফেন্সে নিয়োগ মন্ত্রীর দপ্তর থেকে পাঠানো তালিকা অনুযায়ী করার কথাও বলা হচ্ছে। সেই অনুযায়ী নিয়োগ দিতে ফায়ার সার্ভিসকে বাধ্য করতেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। ২০২৩ সালে ২ অক্টোবর ৫৩৫ জনকে জনকে নিয়োগ দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। এর মধ্যে ছিলেন ৪৩৬ পুরুষ ফায়ার ফাইটার, ১৫ জন নারী ফায়ার ফাইটার এবং ৮৪ জন গাড়িচালক।
নিয়োগ কার্যক্রমের শুরুতেই মন্ত্রীর দপ্তর থেকে ২৫০ জনের একটি তালিকা পাঠানো হয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে। আসাদুজ্জামান কামালের নির্দেশে সেই তালিকা অনুসারে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয় ফায়ার সার্ভিস। সেই নিয়োগে জনপ্রতি ৮ থেকে ১২ লাখ টাকা নেন কামাল-হারুন সিন্ডিকেট।
পুলিশের বদলি সংক্রান্ত বাণিজ্যে আসাদুজ্জামান কামালের পুত্রের নামও এসেছে। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে কোনো কথা বলেননি তারা।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আসাদুজ্জামান কামাল ঘুষ-চাঁদাবাজির জন্য তখনকার অতিরিক্ত সচিব ড. হারুন অর রশীদ বিশ্বাসের নেতৃত্বে একটি চক্র গড়ে তোলেন। এই চক্রের সদস্যরা হলেন- যুগ্মসচিব ধনঞ্জয় কুমার দাস, মন্ত্রীর সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) মনির হোসেন, মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা শরীফ মাহমুদ অপু, প্রশাসনিক কর্মকর্তা মোল্লা ইব্রাহিম হোসেন।
টাকা আদায় বা উত্তোলনে মূল ভূমিকা পালন করতেন হারুন অর রশীদ বিশ্বাস। হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন এই কামাল-হারুন সিন্ডিকেট। একপর্যায়ে হারুন অর রশীদ অবসরে গেলেও মন্ত্রণালয়ের সব ঘুষ, দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনিই। আর ওই সব অর্থ নিরাপদে রাখতে পাঠানো হয়েছে দেশের বাইরে। টাকা দেশের বাইরে পাচারের ব্যবস্থা করতেন আসাদুজ্জামান কামালের ব্যাবসায়িক পার্টনার এস আলম গ্রুপের একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক।
আসাদুজ্জামান কামালের ছেলে সাফি মোদ্দাসের খান জ্যোতির ছিল আরেকটি চক্র। পিতা-পুত্রের দ্বন্দ্বও হয়েছে বিভিন্ন সময়। পুলিশের এক কর্মকর্তাকে বদলি করতে গিয়ে ব্যর্থ হন জ্যোতি। কামাল তাকে জানান, হারুন অর রশীদের সঙ্গে কথা বলতে। এ নিয়ে গত জুনে বাসায় কলহ তৈরি হয়। ক্ষুব্ধ হয়ে বাসায় ব্যাপক-ভাঙচুর করেন জ্যোতি।