আবেদ আলী সম্পর্কে আরো যা জানা গেল

কাগজ ডেস্ক
প্রকাশ: ০৯ জুলাই ২০২৪, ১০:৫৬ পিএম

ছবি: সংগৃহীত
ছোটবেলায় বাবা মারা যাওয়ার পর আট বছর বয়সে ঢাকায় চলে আসেন আবেদ আলী। শুরু করেন কুলির কাজ। এক পর্যায়ে তার এক বাল্যবন্ধু ঢাকায় এসে রিকশা চালাতে শুরু করলে আবেদ আলীও এই পেশায় আসেন।
কুলি থেকে রিকশাচালক পরে রিকশাচালক থেকে পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হয়ে কোটিপতি বনে যান সৈয়দ আবেদ আলী। নিজ এলাকায় তিনি দানবীর হিসেবে সুপরিচিত। হতে চেয়েছিলেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) পরীক্ষাসহ গত ১২ বছরে ৩০টি নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নফাঁসে জড়িত থাকার অভিযোগে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) কর্মকর্তাসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। এই ১৭ জনের মধ্যে রয়েছে আবেদ আলী এবং তার পুত্র সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম।
আবেদ আলী মাদারীপুরের ডাসার উপজেলার বালিগ্রাম ইউনিয়নের পশ্চিম বোতলা গ্রামের আব্দুর রহমান মীরের ছেলে। আবেদ আলীর বাবা পেশায় ছিলেন কৃষক। তারা এক বোন, তিন ভাই। বোনের স্বামী ও দুই ভাই কৃষিকাজ করেন।
১৯৯৯ সালে মাদারীপুর সদর উপজেলার খাগদী এলাকার হাবিবুর খা'র মেয়ে শিল্পীর সঙ্গে বিয়ে হয় আবেদ আলীর। আবেদ আলীর শ্বশুর পেশায় মাংস বিক্রেতা।
পরিবার সূত্রে জানা যায়, আবেদ-শিল্পী দম্পতির তিন সন্তান। তাদের বড় ছেলে সৈয়দ সোহানুর রহমান সিয়াম ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দুর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। প্রশ্নফাঁসের বিষয়টি আলোচনায় আসার পর তাকে বহিষ্কার করে ছাত্রলীগ। তিনি এলাকায় চলাফেরা করতেন 'কোটি টাকা' দামের গাড়িতে। 'দানশীল' হিসেবে এলাকায় পরিচিতি তৈরি করেছেন তিনি।
আবেদ আলীর ছোটভাই জাবেদ আলী গণমাধ্যমকে বলেন, কৃষিকাজের পাশাপাশি আমি মাঝে মধ্যে ইজিবাইক চালাই। আমাদের পরিবারে অভাব থাকায় বাবা মারা যাওয়ার পর মেজভাই (আবেদ আলী) ঢাকায় চলে যান। সেখানে যখন যে কাজ পেয়েছেন তাই করেছেন। এক সময় চাকরি পান পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হিসেবে।
পিএসসি চেয়ারম্যানের গাড়িচালকের চাকরি পাওয়ার আগে আবেদ আলী অর্থ কষ্টে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, 'আমি ১৯৯৭ সালে ঢাকায় গিয়ে চানাচুর বিক্রি করেছি কিছুদিন। তখন চানাচুর বিক্রির টাকা থেকে ভাইকে যতটা পারতাম সহযোগিতা করতাম।'
তিনি আরো বলেন, 'শুনেছি, প্রশ্নফাঁস করায় আমার ভাইকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি অপরাধী হলে সাজা হোক, কিন্তু অপরাধী না হলে তাকে যেনো সসম্মানে মুক্তি দেয়া হয়।'
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আবেদ আলীর এক বাল্যবন্ধু বলেন, 'সে জীবনে অনেক কষ্ট করে বড় হইছে। ঢাকায় আমরা একসঙ্গে রিকশা চালাইছি।' তার দাবি, 'আমার বন্ধু উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন করতে চাইছে, তাই হে সবার চক্ষুশূল হইছে। তার থেকেও অনেক বড় বড় দুর্নীতিবাজ আছে ডাসার উপজেলায়। তাদেরকে কিছু বলতেছে না। আমার বন্ধুর পিছনে কেনো লাগছে?'
১৯৯৭ সালে পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালক হিসেবে নিয়োগ পান আবেদ আলী। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, প্রথম ২০০৪ সালে ডাসার উপজেলার একজনকে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরে চাকরি নিয়ে দেন আবেদ আলী। এরপর তিনি এলাকার অনেকের 'চাকরির ব্যবস্থা' করে দিয়েছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ১৫ বছর আগে পিএসসির চেয়ারম্যানের গাড়িচালকের চাকরি ছেড়ে দেন আবেদ আলী। গাড়িচালক হলেও এলাকায় নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দিতে আবেদ আলী। পরিবার ও প্রতিবেশীরা ছাড়া সবাই জানতেন তিনি ঢাকার একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী।
আরো জানা যায়, কালকিনি ভেঙে ডাসারকে নতুন উপজেলা হিসেবে ঘোষণা করা হলে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য প্রচারণা শুরু করেন আবেদ আলী। এলাকায় 'দানবীর' হিসেবে ভাবমূর্তি তৈরির চেষ্টায় ছিলেন তিনি। এলাকায় তিনি ও তার ছেলে সিয়াম 'কোটি টাকা' দামের দুটি গাড়ি নিয়ে চলাফেরা করতেন। স্থানীয় মসজিদ, মন্দির, এতিমখানা ও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনে টাকা দান করতেন।
স্থানীয়রা জানান, মসজিদ, মন্দির ও এতিমখানায় ৫০ হাজার থেকে লাখ টাকা পর্যন্ত দান করতেন তিনি। গত শীতে ডাসার উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নে বিতরণ করেছেন কম্বল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পশ্চিম বোতলা বাজারের এক ব্যবসায়ী বলেন, যে যা চাইত, আবেদ আলীর কাছে পাইত। সে ঢাকায় ব্যবসা করত, মাদারীপুরেও তার টেম্পুর ব্যবসা ছিল। তার ২৫টা টেম্পু ছিল।
ওই ব্যবসায়ী দাবি করেন, 'শুনছি, আবেদ আলী এলাকার ছেলেমেয়েদের চাকরি পেতে সহযোগিতা করত। খুশি হয়ে কেউ ২০ হাজার, ৫০ হাজার, কেউবা ১ লাখ টাকা আবার কেউবা এর বেশি দিত আবেদ ভাইকে। কখনো শুনি নি যে চাকরি দিতে কারো কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন।'
এছাড়াও আবেদ আলী তার গ্রামে তিন কোটি টাকা ব্যয়ে একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি তৈরি করেছেন। বাড়ির সামনে রয়েছে আম বাগান। তবে তার দুই ভাইয়ের আবাস এখনো দোচালা টিনের ঘরেই।
বাড়ির সামনে দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে দ্বিতল মসজিদ নির্মাণ করেছেন আবেদ আলী। মসজিদের ইমাম মজিবুর রহমান বলেন, 'এই মসজিদ আবেদ ভাই একাই নির্মাণ করেছেন। প্রতি মাসে আমাকে ১০ হাজার টাকা এবং মোয়াজ্জেমকে তিন হাজার টাকা বেতন দেন।' নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হিসেবে প্রতি শুক্রবার ডাসার উপজেলার বিভিন্ন মসজিদে জুম্মা নামাজ আদায় করতেন আবেদ আলী। নামাজ শেষে মসজিদে বড় অংকের টাকা দান করতেন তিনি।
ডাসার ইউনিয়নের কমলাপুর বাজার সংলগ্ন একটি সেতুর একপাশে ১০০ গরু পালনের জন্য খামার গড়ে তুলেছেন আবেদ আলী। সেতুর অপর পাশে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান তৈরির জন্য ভবন নির্মাণের কাজ শুরু করেছেন। অবশ্য সরকারি জায়গা হওয়ায় উপজেলা প্রশাসনের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়।
এ বিষয়ে ডাসার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কানিজ আফরোজ বলেন, 'কমলাপুর বাজার সংলগ্ন এলাকায় সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের জমিতে আবেদ আলী নামে একজন ভবন তুলছিলেন। আমরা নির্মাণ কাজ বন্ধ করে অসমাপ্ত ভবনটি ভেঙে ফেলার জন্য সড়ক ও জনপদ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলীকে চিঠি দিয়েছি।'