বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও অজিত দোভালের হাতে লাল ফাইল

শ্যামল দত্ত, নয়াদিল্লি থেকে
প্রকাশ: ২২ জুন ২০২৪, ১১:৫৭ পিএম

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে শনিবার নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে সৌজন্য সাক্ষাত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নয়াদিল্লির হায়দ্রাবাদ হাউসে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যখন জয়েন্ট প্রেস স্টেটমেন্ট দেয়ার জন্য সংবাদ সম্মেলন কক্ষে প্রবেশ করলেন তখন দুজনেরই মুখ ছিল হাস্যোজ্জ্বল। প্রথমেই অত্যন্ত সাবলীল ও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে ১৫ মিনিট ধরে বক্তব্য রাখলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্কের নানা বিশ্লেষণ যেমন ছিল; তেমনি আগামীতে দুদেশ কীভাবে সেই সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে চায় সেই প্রসঙ্গও ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণভাবে।
মোদির বক্তব্যের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল উল্লেখ করার মতো। যেমন- তিনি বলেছেন, ১৯৬৫ সালের আগে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে যোগাযোগব্যবস্থা ছিল তা পুনর্বহাল করা হয়েছে। মেডিকেল ভিসার জন্য ই-ভিসা চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বলেছেন, রংপুরে একটি নতুন অ্যাসিস্ট্যান্ট হাইকমিশন অফিস তৈরির উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তির প্রায় ৩০ বছর পূর্ণ হতে চলেছে।
মেয়াদ পূর্তির আগেই এটি নিয়ে আলোচনা শুরু করা হবে। তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি ও অন্যান্য ব্যবস্থাপনা পর্যালোচনার জন্য একটি টেকনিক্যাল কমিটি অচিরে কাজ শুরু করবে বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এমনকি বাংলাদেশ এবং ভারতের খেলা প্রসঙ্গটিও তার বক্তব্য থেকে বাদ যায়নি। তিনি উভয় দলের জন্য শুভকামনা চেয়েছেন। তার বক্তব্যে ইন্দোপ্যাসিফিক ও ভারত মহাসাগর এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দুই দেশের কাজ করার অঙ্গীকারের কথা পুনরায় ব্যক্ত করেছেন।
নরেন্দ্র মোদি আরো বলেছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরপর তিনবার তিনটি সরকার শপথ গ্রহণের পর প্রথম সরকারপ্রধান হিসেবে ভারত সফর করেছেন। এরমধ্য দিয়েই বোঝা যায় ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্কের গভীরতা কতটুকু। তিনি সামরিক খাতে সহযোগিতা ও আগামীতে ২০২৬ সালে বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হওয়ার পর দুই দেশের মধ্যে সহযোগিতা বাড়ানোর অঙ্গীকার করেছেন।
নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের পরপরই প্রায় এগারো মিনিট বক্তব্য রেখেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। দুই দেশের মধ্যে দশটি যৌথ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হওয়ার জন্য তিনি ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জানান এবং বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির অংশীদার হওয়ায় ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান। তিনি হিন্দি ভাষায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানান।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভারত সফরের দ্বিতীয় দিনে অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন বিভিন্ন কর্মসূচিতে। সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে তাকে আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা জানান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তারপর রাজারহাটে গিয়ে মহাত্মা গান্ধীর সমাধিস্থলে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানান শেখ হাসিনা। এরপরই দুই দেশের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। বৈঠক শেষে জয়েন্ট প্রেস স্টেটমেন্টে অংশ নিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির দেয়া মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই ভোজসভায় পুরো খাবারটি ছিল ভেজিটেরিয়ান আইটেম এ সাজানো। এরপর উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনখর এবং পরে রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সেখান থেকে দেশে ফেরার জন্য সরাসরি বিমানে আরোহণ করেন শেখ হাসিনা।
এই বৈঠকের ফলাফল নিয়ে ভারতের সাংবাদিক এবং কূটনৈতিক মহলে নানা আলোচনা চলছে। কী কারণে ১১ দিনের মাথায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফরে এলেন তা নিয়ে চলছে চুলচেরা পর্যালোচনা। শুধু এই দশটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করার জন্যই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এসেছেন; নাকি অন্য কোনো বিষয়ও ছিল তা নিয়ে নানা কৌতূহল অনেকের মধ্যে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদির মধ্যে একটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছে; যেখানে ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ছিলেন বলে অনেকে নিশ্চিত করেছেন। অজিত দোভালকে জয়েন্ট প্রেস স্টেটমেন্টের সময় উপস্থিত প্রতিনিধি দলের মধ্যেও দেখা গেছে এবং তার হাতে একটি লাল ফাইল সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। শুরু হওয়ার আগে অজিত দোভালকে সালমান এফ রহমানের সঙ্গে একান্তে আলোচনা করতেও দেখা গেছে।
এই ধরনের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে কিছু বিষয় থাকে আলোচনার যা সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে; আবার কিছু বিষয় থাকে একান্ত আলোচনার, যা অনেকের অগোচরে হয়। ফলে সেই অগোচরের বিষয়টি এখন অগোচরে থেকে গেছে কিনা সেটা হয়তো পরবর্তী সময় বলে দেবে।
প্রধানমন্ত্রী আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহের শেষে চীন সফরে যাবেন। ফলে চীন সফরের আগে ভারতের সঙ্গে যে কোনো আলোচনা যদি কারো কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়, তা অবশ্য ফেলে দেয়ার মতো নয়।
এদিকে জয়েন্ট স্টেটমেন্টের পরপরই ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিনয় পত্রা এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, অচিরেই তিস্তা নদীর পানি ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণ নিয়ে একটি টেকনিক্যাল কমিটি দ্রুত কাজ শুরু করবে। তিনি গণমাধ্যমকে আরো জানান মেডিকেল ই-ভিসা দ্রুত চালু হবে এবং ভিসা সমস্যার একটা সমাধান করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হবে।