সবার দৃষ্টি এখন নয়াদিল্লিতে

শ্যামল দত্ত, নয়াদিল্লি থেকে
প্রকাশ: ২১ জুন ২০২৪, ১১:১৩ পিএম

ফাইল ছবি
মাত্র ১২ দিনের মধ্যে একই দেশে দুবার সফর করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এমন কোনো রেকর্ড নেই বললেই চলে। ফলে কী কারণে তিনি এই সফরে এলেন, সফরের এজেন্ডা কী বা অন্য কী কী বিষয়ে আলোচনা হতে পারে, তা নিয়ে নানা জল্পনা-কল্পনার শেষ নেই। দিল্লির সাংবাদিক-বুদ্ধিজীবীদের একটাই প্রশ্ন, নেপথ্যে কি কিছু আছে? প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গীদের তালিকা দেখে কেউ কেউ এর উত্তর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন।
এরকম একটি সংক্ষিপ্ত সফরে ১৯৯৮ সালের জুন মাসে ভারত সফরে এসেছিলেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেই সফরটি ছিলো আরো সংক্ষিপ্ত। মাত্র ৮ ঘণ্টার জন্য তিনি ভারত সফরে আসেন। ভারতীয় উপমহাদেশে তখন পারমাণবিক যুদ্ধের দামামা।
অটল বিহারী বাজপেয়ি তখন ক্ষমতায়। ভারত পোখরানে ১৯৭৪ সালের পর দ্বিতীয় দফায় ১৯৯৮ সালের মে মাসে পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়; পাল্টা পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাকিস্তান তার নিজের শক্তির জানান দেয়। এরকম একটি উত্তেজনাকর মুহূর্তে উপমহাদেশের শান্তি রক্ষার জন্য একটি আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি প্রথমে ভারত সফরে আসেন। পরের সপ্তাহে তিনি পাকিস্তান সফরে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফের সঙ্গে আলোচনার জন্য। আর এই আঞ্চলিক কূটনীতি কিছুটা হলেও পরিস্থিতি শান্ত করতে সহায়তা করে।
এই সময় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে নয়াদিল্লি ও পাকিস্তান যাওয়ার সুযোগ হয়েছিলো আমার। সফরসঙ্গী আরো দুই সাংবাদিক ছিলেন বর্তমান জাতীয় সংসদের সদস্য ও সাংবাদিক নেতা মুহাম্মদ শফিকুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রীর সাবেক তথ্য উপদেষ্টা ও বাংলাদেশ অবজারভার সম্পাদক ইকবাল সোবহান চৌধুরী। শেখ হাসিনার এই শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগে স্বাগত জানিয়েছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ি ও পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নেওয়াজ শরীফ।
কিন্তু এবারের প্রেক্ষাপটটি একেবারেই ভিন্ন। ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আছে ২০১৪ সাল থেকে; অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে ২০০৯ সাল থেকে। দুটি সরকারের মধ্যে বন্ধুত্ব ও আত্মবিশ্বাসের সম্পর্ক প্রায় দশক পেরিয়ে গেছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এটিকে বলে থাকেন সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়। এটি খুবই উল্লেখ করার মতো, ভারতের প্রতিবেশী সবগুলো রাষ্ট্রের সঙ্গে কোনো না কোনো টানাপড়েন থাকলেও বাংলাদেশের সঙ্গে তার সম্পর্ককে অনেকে রোল মডেল হিসেবে দেখে থাকেন। তিস্তার পানি বণ্টন কিংবা সীমান্ত হত্যা নিয়ে অস্বস্তিকর কিছু বিষয় থাকলেও শুধু উপমহাদেশে নয়; সারা পৃথিবীতে এরকম দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের নজির খুবই কম। যে কারণে ১২ দিনের মাথায় যদি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো ভারত সফরে আসেন, সেটিকেও দেখা হয় ভিন্নভাবে। গত ৮ জুন তিনি ভারতবর্ষে এসেছিলেন অন্যান্য অতিথিদের সঙ্গে তৃতীয় দফায় নরেন্দ্র মোদির প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানে। অন্যদিকে ভারতে নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সরকার তৃতীয়বার ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রথম কোনো সরকার প্রধান হিসেবে আমন্ত্রিত হয়ে এলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মধ্য দিয়েই দুদেশের মধ্যে সম্পর্কের গভীরতা কেউ যদি মাপার চেষ্টা করে, তাহলে সেটা বোধহয় অন্যায় হবে না।
দুটি দেশের নতুন দুটি সরকার ক্ষমতায় এসেছে। বাংলাদেশে গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে চতুর্থবারের মতো নির্বাচিত হয়েছে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। অন্যদিকে তৃতীয়বারের মতো ভারতে বিজেপির ক্ষমতা আরোহন সেটাও নজিরবিহীন। এরকম একটা অবস্থায় দুটি দেশ আগামীতে কীভাবে একে অপরের হাত ধরে এগিয়ে যাবে তার সূচনালগ্ন নির্ধারণ করতে দুই রাষ্ট্রপ্রধান একসঙ্গে বসতেই পারেন, এটাই হয়তো স্বাভাবিক। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুধু দ্বিপক্ষীয় ফ্রেমওয়ার্কের মধ্যে বন্দি নয়; আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশের ভূখন্ড তিনি কোনো বিদেশি শক্তির অপকর্মের জন্য ব্যবহৃত হতে দেবেন না। সেই নীতি বাংলাদেশ এখনো পর্যন্ত অনুসরণ করছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে। ভারতের প্রায় পেটের ভেতরে থাকা বাংলাদেশ এখন প্রায় নির্ঝঞ্ঝাট ও খুবই শান্তির একটি জায়গা। দীর্ঘ সময়কাল ধরে এখান থেকে যে বিদ্রোহীদের তৎপরতা চলেছে ভারতের সাত রাজ্যে; তা এখন প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী ভারতের রাজ্যগুলোতে এখন যে উন্নয়নের জোয়ার চলছে তার কৃতিত্ব শেখ হাসিনাকে প্রকাশ্যে দিয়েছেন এসব রাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্ব।
ভারত আর পূর্ব অবস্থায় ফেরত যেতে চায় না যে কারণেই শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি তাদের অগাধ আস্থা। যদিও আজ তাকে কেউ কেউ ভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন। কারো কারো মতে, বাংলাদেশের নির্দিষ্ট একটি সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ভারতকে রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে কিনা সেটিও ভেবে দেখার প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী মনোভাব এখনো প্রবল এবং সম্পর্কের চরিত্রের সার্বজনীনতা নিয়েও নানা বিশ্লেষণ রয়েছে।
যাই হোক, কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা জানেন বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক এখন শুধুমাত্র দ্বিপক্ষীয় লেন্সে দেখার বিষয় নয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে দুদেশের অবস্থান রয়েছে। সেসব বিষয় নিয়ে আগামীতে নতুন কি মেরুকরণ হবে বা দুই দেশের কি অভিন্ন অবস্থান হবে তা নিয়ে আলোচনা হবে, এমন মন্তব্য কূটনৈতিক মহলের।
প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী হিসেবে ভারত গিয়েছেন অর্থনৈতিক সংশ্লিষ্ট বিশিষ্ট ব্যক্তিরা, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরও। বাংলাদেশের অস্থির অর্থনৈতিক খাত আলোচনায় প্রাধান্য পাবে সেটি বোঝা যায় তার প্রতিনিধি দলের চরিত্র দেখে। শুক্রবার (২১ জুন) সফরের প্রথমদিনে প্রথম বৈঠকটি হয়েছে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সুব্রামানিয়াম জয় শংকরের সঙ্গে। প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফর শুরু হয়েছে এই বৈঠকের মধ্য দিয়ে। প্রথম দিনে প্রধানমন্ত্রীর আর কোনো কর্মসূচি নেই। ব্যবসায়ীরা ৪৫ মিনিটের জন্য কনফারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রিস নেতাদের সঙ্গে একটি বৈঠক করেছেন; যেখানে প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাদ্য উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আইসিটিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলক, বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম ও ব্যবসায়ী নেতারা উপস্থিত ছিলেন।
শনিবার (২২ জুন) প্রধানমন্ত্রী তার দিন শুরু করবেন রাষ্ট্রপতি ভবনে অআনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে। ওইদিন হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হবে এবং সেখানে দুজনের মধ্যে একান্তে আলোচনা হবে বলেও জানিয়েছেন কূটনৈতিক সূত্র।
প্রধানমন্ত্রী আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে দ্বিপক্ষীয় সফরে চীন সফরে যাবেন। তার আগে ভারতে এই সফরের দিকে কৌতুহল নিয়ে তাকিয়ে আছেন কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। তিস্তা নদীর অববাহিকা উন্নয়ন নিয়ে ভারত এবং চীনের উভয়ের আগ্রহ সবারই জানা। ভারত ইতোমধ্যে তার আগ্রহের কথা জানিয়েছে। চীনও এক্ষেত্রে তাদের আগ্রহ আগেই প্রকাশ করেছে। দীর্ঘ ১০ বছরেও যখন বাংলাদেশ-ভারত তিস্তা সমস্যা সমাধান করতে পারেনি; তখন এই প্রকল্পে চীনের যুক্ত হওয়া রাজনৈতিকভাবে নানা গুরুত্ব রাখে।
এছাড়া বাংলাদেশের অর্থনৈতিক খাতের যে দুর্বলতা তা মোকাবিলার জন্য বাংলাদেশ ভারতের সহযোগিতা চাইতে পারে এমন আলোচনা আছে। যে কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব তার সফর সঙ্গীর তালিকায় আছেন। মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি বাংলাদেশ ভারত উভয়ের জন্য উদ্বেগজনক। সে ক্ষেত্রে উভয় দেশে একটি অভিন্ন অবস্থানে আসতে পারে। পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে যোগাযোগ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশের উপর দিয়ে ভারতের রেল চলাচলের একটি প্রস্তাবও বিবেচনাধীন। নতুন বিশ্ব পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে একটি যৌথ উদ্যোগ তৈরি হতে পারে সেটা হয়তো দেখা যাবে শনিবারের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর কূটনৈতিক মহলের ধারণা এমনটাই।