বন্দিজীবন, তবুও স্বস্তি পূর্ব রাজাবাজারবাসীর

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ২৯ জুন ২০২০, ১১:৩৩ এএম

এলাকার ৮টি গলির ৭টির মাথাই বাঁশ, টিন ও কাঠ দিয়ে পোক্ত করে এঁটে দেয়া। ১টি গলি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত থাকলেও তার মুখে পুলিশ ও স্বেচ্ছাসেবকদের কড়া পাহারা। বেশ কিছুক্ষণ পর পর দুয়েকজন করে ঢুকছেন অথবা বের হচ্ছেন ওই গলি থেকে। কিছু বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে বেশ কৌত‚হলী ভঙ্গিতে নিচে লকডাউন পরিস্থিতি দেখছেন কেউ কেউ। মোটামুটি বন্দিজীবন। আছে নানা অভিযোগও। তবুও লকডাউনে করোনা সংক্রমণ কমে যাওয়ায় বেশ স্বস্তিতে দিন কাটাচ্ছেন রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারের বাসিন্দারা।
করোনার সংক্রমণের বিস্তার ঠেকাতে ঢাকার যে এলাকাকে প্রথম রেড জোন হিসেবে চিহ্নিত করে পরীক্ষামূলক লকডাউন করা হয়েছে গতকাল রবিবার সেই পূর্ব রাজাবাজার এলাকা সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ওয়ার্ড কাউন্সিলের নেতৃত্বে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং স্বেচ্ছাসেবকরা দোকানসহ সব কিছু বন্ধ রাখা এবং মানুষের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করছেন। ভেতরে ভ্যান এবং পিকআপে করে চাল, ডাল, সবজি বা মাছ, মাংস বিক্রির ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। এলাকার বাসিন্দাদের সহায়তায় পর্যায়ক্রমে সময় ভাগ করে কাজ করছেন ১২০ জন স্বেচ্ছাসেবী। প্রথম অবস্থায় ৮০ জন কাজ করলেও পরে স্বেচ্ছাসেবী বাড়ানো হয়েছে। পুরো এলাকাকে নিয়ন্ত্রণ করছে একটি কন্ট্রোল রুম। এলাকার বাসিন্দারা যে কোনো প্রয়োজনে দিন কিংবা রাত যে কোনো সময়ই কন্ট্রোল রুমে ফোন করলেই স্বেচ্ছাসেবীরা তাদের প্রয়োজন মেটাতে তৎপর হচ্ছেন। জরুরি প্রয়োজন ছাড়া কেউ ওই এলাকায় ঢুকতে বা বের হতে পারছেন না। যাওয়া-আসার পথে নাম এবং ফোন নম্বর লিপিবদ্ধ করতে হচ্ছে খোলা থাকা একমাত্র গলির মুখে চেয়ার টেবিল নিয়ে বসে থাকা স্বেচ্ছাসেবীদের রেজিস্ট্রারে। বাকি ৭টা গলির মুখ বন্ধ থাকলেও বাঁশ, টিন ও কাঠের ফাঁকা স্থান দিয়ে বিভিন্ন জিনিসপত্র আনা-নেয়া করছেন এলাকাবাসী। এমনকি বিশেষ প্রয়োজনে আত্মীয়স্বজনরাও এসে দেখা করছেন ওইসব গলির মুখেই।
এই এলাকার বাসিন্দা মাসুম খন্দকার বলেন, শুরুর দিকে দেখেছি, স্বেচ্ছাসেবীরা মাইকিং করছে বা আমাদের বিভিন্ন তথ্য জানাচ্ছে। প্রথম দুই-তিন দিন আমরা সেটা ফিল করেছি। কিন্তু এরপর ১০ বা ১২ দিন ধরে তাদের উপস্থিতি আমরা টের পাচ্ছি না। সে রকম সাপোর্টও পাচ্ছি না। আরেকটা বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবীরা যেসব মাছ, মাংস নিয়ে আসে সেগুলোর দাম খুবই চড়া। এসব নিয়ে ভীষণ ভোগান্তি যাচ্ছে। তবে স্বস্তি হলো এলাকার সংক্রমণ কমছে। কিন্তু নগরের সব খুলে রেখে একটা এলাকা লকডাউন কতটা কার্যকর হবে সেই বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে।
আরেক বাসিন্দা নাফিসা ইসলাম ভোরের কাগজকে বলেন, আমি একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করি। লকডাউনের কারণে অফিসে যেতে পারছি না বিধায় বিনা বেতনে আমাকে ছুটিতে থাকতে হচ্ছে। অফিস তো লকডাউন বুঝছে না। খুবই অস্থির অবস্থায় আছি। তাছাড়া মাঝে মাঝে এমন কিছু জিনিসের দরকার হয় যা স্বেচ্ছাসেবীদের বলা সম্ভব না। অবশ্য মেয়ে স্বেচ্ছাসেবী হলে বলা যেত।
ডিএনসিসির স্বাস্থ্য বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, গত ১০ জুন থেকে ১৪ দিনের জন্য পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন শুরু হয়। পরে আরও ৭ দিন বাড়ানো হয়। লকডাউন শুরুর দিন থেকে ২১ জুন পর্যন্ত ১১ দিনে মোট ২০৫ জনের করোনা পরীক্ষা করা হয়। এ থেকে ৪০ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। যা মোট আক্রান্তের সাড়ে ১৯ শতাংশ। এই ১১ দিনের মধ্যে প্রথম সাত দিনে (১০ জুন থেকে ১৬ জুন) ১৩১ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। তার মধ্যে ৩৩ জনের শরীরে করোনা ভাইরাসের উপস্থিত শনাক্ত হয়। যা আক্রান্তের ২৫ শতাংশ। আর শেষ ৫ দিনে (১৬ জুন থেকে ২১ জুন) পরীক্ষা করেছেন ৭৪ জন। তার মধ্যে ৭ জনের পজিটিভ আসে। যা আক্রান্তের সাড়ে ৯ শতাংশ। এর মধ্যে ১৮ জুন ২২ জনের পরীক্ষা করা হয়েছে। এতে কারও শরীরে করোনা শনাক্ত হয়নি। ২০ জুন ১৯ জনের পরীক্ষা হলেও ওই দিনও কারও করোনা শনাক্ত হয়নি। এই পুরো সময়ে উপসর্গ নিয়ে যারাই পরীক্ষা করার জন্য এসেছেন সবার নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে।
পূর্ব রাজাবাজার এলাকার লকডাউনের সমন্বয়কারী ডিএনসিসির উপপ্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা লেফটেনেন্ট কর্নেল মো. গোলাম মোস্তফা সারওয়ার বলেন, সার্বিক পর্যালোচনা করে দেখেছি আক্রান্তের হার শুরুর তুলনায় শেষের দিকে অনেক কমে এসেছে। যা লকডাউনের কার্যকারিতার ফসল বলে আমরা মনে করি। তিনি বলেন, এভাবে জোনভিত্তিক লকডাউন যদি সঠিকভাবে পালন করা যায় তাহলে এটি সারাদেশের জন্য মডেল হতে পারে। যা পরীক্ষামূলক এই লকডাউনে আমরা দেখতে পেয়েছি।
পূর্ব রাজাবাজার প্রসঙ্গে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, পূর্ব রাজাবাজার লকডাউন করার জন্য আমাদের কাছে চিঠি আসার পর আমরা সব গাইডলাইন মেনে লকডাউন কার্যকর করি। এতে অনেক চ্যালেঞ্জও ছিল। এলাকার স্বেচ্ছাসেবক থেকে শুরু করে সবাই সব শ্রেণির মানুষ আমাদের সহযোগিতা করেছেন। আমরা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানিয়ে দিয়েছি তারা যেন ২১ দিন পর আমাদের লকডাউনের ফলাফল নিয়ে একটা চিত্র উপস্থাপন করে দেন। যেটা আমরা নাগরিকদের সামনে প্রকাশ করব। তবে আমরা প্রাথমিকভাবে যে তথ্য পাচ্ছি সেটা নিঃসন্দেহে ইতিবাচক।
অন্যদিকে লকডাউনের উদ্দেশ্য পুরোপুরি সফল হয়েছে বলে জানিয়েছেন ২৭নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ফরিদুর রহমান খান ইরান। তিনি বলেন, ১৪ দিন ভাইরাস থাকে শরীরে, সেই হিসাবে ১৪ দিন কড়া লকডাউনে ছিল এলাকাটি। পরে আরো ৭ দিন বাড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে ওই এলাকায় যারাই শনাক্ত হয়েছেন বা সুস্থ হয়েছেন সবই আমরা জানতে পেরেছি। সেখানে খুব অল্পসংখ্যক ছাড়া বেশির ভাগ মানুষই এখন সুস্থ।
পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউনে দায়িত্বরত শেরে বাংলা নগর থানার এসআই মো. তৌহিদুল ইসলাম বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত মোতাবেক শৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্ব পালন করছি। মাঝে মাঝে এলাকাবাসী বিক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন সেটা গিয়ে সামাল দেই। তিনি বলেন, এখানে লকডাউন ভালোই চলছে তবে এলাকাবাসী এবং স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব দেখতে পাচ্ছি।