মতিঝিল মডেল স্কুলে সভাপতির টর্চার সেল

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ১০ ডিসেম্বর ২০১৯, ০৯:৪৬ এএম

রাজধানীর মতিঝিল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি আওলাদ হোসেনের কুকীর্তি ফাঁস করে দিয়েছেন প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীরা। তার অপসারণ ও নতুন সভাপতি মনোনয়ন দাবিতে গতকাল সোমবার মানববন্ধন করেছেন তারা। একইসঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইনের কাছে তার বিরুদ্ধে তিন পাতার অভিযোগ দিয়েছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা।
উল্লেখ্য, গত ১১ বছর ধরে আওলাদ হোসেন ওই প্রতিষ্ঠানের সভাপতি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির প্রধান শাখা মতিঝিল কলোনিতে অবস্থিত, আরেকটি শাখা ক্যাম্পাস বাসাবো এলাকায়। বর্তমানে ১১ হাজার ৩ শতাধিক শিক্ষার্থী পড়ছে।
দুর্নীতিবাজ, উগ্র, সাম্প্রদায়িক, শিক্ষক নির্যাতনকারী, স্বেচ্ছাচারী, মামলাবাজ, নিয়োগ-বাণিজ্যের হোতাসহ বিদ্যালয়ের সুনাম নষ্টকারী শিরোনাম দিয়ে আওলাদ হোসেনের বিরুদ্ধে গতকাল সোমবার সকালে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে শিক্ষক-কর্মচারী ও অভিভাবকরা মানববন্ধন করেন। শিক্ষকরা জানান, স্কুলে ‘টর্চার সেল’ খুলে শিক্ষকদের অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন সভাপতি। কথায় কথায় শিক্ষকদের বরখাস্ত করেন। জানতে চাইলে সিনিয়র সচিব মো. সোহরাব হোসাইন ভোরের কাগজকে বলেছেন, অভিযোগ পেয়েছি। এখন আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আওলাদ হোসেন বলেন, ‘নারায়ে তাকবির-আল্লাহু আকবর’ ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ এমন স্লোগান দিয়ে শিক্ষক-কর্মচারীরা আমার বিরুদ্ধে নেমেছে। শিক্ষকরা যে টর্চার সেলের কথা বলেছেন এবং সেই সেলে নির্যাতন হওয়ার কথা বলেছেন তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। তিনি বলেন, শিক্ষকরা তার মানসম্মান নিয়ে টানাটানি করছেন। তাদের কারণে সমাজে বেইজ্জত হয়ে এখন দায়িত্ব ছাড়ার কথা ভাবছেন তিনি। দায়িত্ব ছাড়ার বিষয়টি তিনি স্থানীয় সাংসদ রাশেদ খান মেননকেও জানিয়েছেন।
নির্যাতিত শিক্ষকরা বলছেন, প্রায় ১১ বছর ধরে আওলাদ হোসেন প্রতিষ্ঠানটি লুটেপুটে খাচ্ছেন। মহানগর আওয়ামী লীগের পদে থাকায় ভয়ে অনেকে মুখ খুলছেন না। নির্যাতিত শিক্ষকদের অভিযোগ, সভাপতি স্কুলের ভেতরে একটা টর্চার সেল তৈরি করেছেন। যেখানে ঢোকার সময় মনে হবে বেহেশতখানায় ঢুকছেন। কিন্তু বের হওয়ার সময় কাঁদতে কাঁদতে বের হতে হয়।
বছরের পর বছর ধরে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ দিয়ে চলছে প্রতিষ্ঠানটি। এতে দায়িত্বপ্রাপ্তদের যখন খুশি তখন পরিবর্তন করা হচ্ছে। ফলে শিক্ষকদের মধ্যে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আর এসব কারণে এক সময়ে ভালো ফল করা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির এসএসসি পরীক্ষার ফল ধারাবাহিকভাবে খারাপ হচ্ছে। ২০১৪ সালে এই প্রতিষ্ঠান থেকে এসএসসি পরীক্ষায় যেখানে জিপিএ-৫ পেয়েছিল এক হাজার ১৩০ জন শিক্ষার্থী সেখানে চলতি বছর ২২৫ জনে এ প্লাস পেয়েছে।
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ সেলিনা শামসী প্রায় সাতজন শিক্ষক-কর্মচারী নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে মাউশি সচিবের কাছে সভাপতির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেন। এ সময় তিনি সচিবের কাছে সভাপতির নানা কীর্তির বর্ণনাও দেন।
প্রতিষ্ঠানটির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষক শুকদেব ঢালী বলেন, সভাপতি আওলাদ হোসেন তাকে টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করেছেন। একপর্যায়ে ‘মালাওনের বাচ্চা’ গালি দিয়ে চাকরি ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বলেন। সভাপতির পদত্যাগ দাবি করে তিনি বলেন, আওলাদ হোসেন থাকলে এই প্রতিষ্ঠানে চাকরি করা সম্ভব হবে না। তবে এমন বক্তব্যের বিরোধিতা করে আওলাদ হোসেন বলেছেন, শুকদেব ঢালী মিথ্যা কথা বলেছেন। স্কুলে আমি সাম্প্রদায়িক কোনো আচরণ করিনি।
আরেক শিক্ষক সেলিনা আক্তার জাহান বলেন, ঘোরেফিরে প্রায় সব শিক্ষক-কর্মচারীকে টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। স্কুলের ফান্ড শূন্য করে তিনি ঢাকার ভিন্ন এলাকায় চারটি বাড়ি করেছেন। আমরা বিচার চাই। আমাদের বাঁচান, আমাদের প্রতিষ্ঠানকে বাঁচান।
রণজিৎ কুমার নামে কলেজ শাখার আরেক শিক্ষক বলেন, হিন্দু শিক্ষকদের গালিগালাজ করা আওলাদ হোসেনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ওমর ফারুক নামে স্কুল শাখার আরেকজন শিক্ষক বলেন, আওলাদ হোসেন তাকে দুবার বরখাস্ত করেছিলেন। পরে আওলাদকে টাকা দিয়ে বরখাস্তের আদেশ প্রত্যাহার করিয়েছি। টাকা দিলেন কেন-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, চাকরি চলে গেলে খাব কি এই চিন্তা করে টাকা দিয়েছি।
আরেকজন শিক্ষক বলেন, সভাপতি আওলাদ হোসেন প্রতিদিন সকাল ৭টায় স্কুলে ঢুকেন এবং রাত ৮টায় বেরিয়ে যান। দিনভর তার জন্য স্কুলের ফান্ডের টাকা দিয়ে ঢাকা শহরের বড় বড় হোটেল থেকে ভালো ভালো খাবার আনতে হয়।
এদিকে মানববন্ধনে অংশ নেয়া শিক্ষকরা বলেছেন, একটি নতুন ভবনের কাজে ১ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন সভাপতি আওলাদ হোসেন। পরীক্ষার ফি বাবদ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা প্রায় ৮০ লাখ টাকা সভাপতিকে দিতে হয়েছে। অবৈধভাবে শিক্ষক নিয়োগ দিয়েও টাকা আত্মসাৎ করেছেন তিনি।