×

জাতীয়

চিকিৎসা গবেষণায় আগ্রহ কম: বরাদ্দ সীমিত

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ১৩ মার্চ ২০২৩, ০৮:৩২ এএম

চিকিৎসা গবেষণায় আগ্রহ কম: বরাদ্দ সীমিত

ছবি: সংগৃহীত

   

প্রণোদনা স্বল্পতা প্রাইভেট প্র্যাকটিসে মনোযোগ বেশি অবকাঠামো সীমিত

বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন বিশ্বের অনেক দেশের কাছেই রোল মডেল। কিছু ক্ষেত্রে দুর্বলতা যে নেই তা নয়। তবে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে গবেষণার ক্ষেত্রে এখনো বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। দেশে চিকিৎসা খাতে উল্লেখযোগ্য গবেষণা না থাকায় বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানসহ নীতি নির্ধারণী পর্যায় থেকে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন। সংশ্লিষ্টদের মতে, গবেষণার জন্য বরাদ্দ স্বল্পতা, অবকাঠামোগত সমস্যা, প্রয়োজনীয় জনবল এবং গবেষকদের মূল্যায়ন না থাকায় আগ্রহ হারাচ্ছেন চিকিৎসকরা। ফলে দেশের মানুষের কল্যাণে চিকিৎসা গবেষণা উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পারছে না।

সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, গবেষণার জন্য আলাদা টাকা বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে। রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা ফান্ড। গবেষণার জন্য বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়েও বিশেষ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এছাড়া গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু ট্রাস্ট ফান্ড’ নামে একটি আলাদা তহবিলও করে দেয়া হয়েছে। জানা যায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন অনুদান দেয়। কিন্তু এর আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) ছাড়া কোনো মেডিকেল কলেজ এটি পেত না। ফলে চিকিৎসকদের বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল (বিএমআরসি) অথবা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের শরণাপন্ন হতে হতো।

বিএমআরসির সূত্র জানায়, বাজেটে বিএমআরসির জন্য যে পরিমাণ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়, তা দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেয়া হয়। বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মসূচি চালানো, মেডিকেল শিক্ষার্থীদের ছোটখাটো গবেষণার জন্য থিসিস গ্র্যান্ট বা মঞ্জুরি দিতে হয়। ফলে বড় গবেষণা করার মতো তেমন সক্ষমতা থাকে না। তাছাড়া মেডিকেল শিক্ষক-চিকিৎসকরাও গবেষণায় তেমন আগ্রহী নন। এদিকে বিএসএমএমইউর উপাচার্য ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি এক

অনুষ্ঠানে বলেছেন, গবেষণার ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীদের হার অনেক কম। চলতি মার্চ মাসের ২ তারিখ বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ফেলোশিপ অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের স্বাস্থ্য খাতে প্রত্যাশিত গবেষণা না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, চিকিৎসকদের একটি শ্রেণি শুধু টাকা কামাই করতেই ব্যস্ত। এর ফলে গবেষণা হয় না। সরকারি চাকরিও করবে, আবার প্রাইভেটে প্র্যাকটিসও করবে। এভাবে একসঙ্গে চাকরি আর প্র্যাকটিস করলে সেখানে আর গবেষণা হয় না। চিকিৎসা খাতে গবেষণাটা আমাদের খুবই দরকার। স্বাস্থ্যবিজ্ঞানে আরো বেশি যেন গবেষণা হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে।

২০২১ সালে এক সংবাদ সম্মেলনেও এ বিষয়ে আক্ষেপ প্রকাশ করে একই বক্তব্য দিয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী। সেই সময় তিনি বলেছিলেন, হাতেগোনা কয়েকজন মেডিকেল বিষয়ে গবেষণা করেন। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছেন, সেখানে দিচ্ছি গবেষণা করতে। গবেষণা করতে টাকার অভাব হবে না। ফান্ড তো রয়েছেই, শুধু উদ্যোগের অভাব। গবেষণায় অনীহার কারণ সম্পর্কে সরকারপ্রধান বলেছিলেন, এর কারণ- মিলিটারি রুলাররা যখনই ক্ষমতায় আসে তখনই বিলাসিতার দিকে মানুষকে ঠেলে দেয়। মানুষের মধ্যে আদর্শ নেই, বিলাসিতার দিকে দৃষ্টি চলে গেছে বেশি। টাকায় লোভটা একটু বেশি দেখা দিলে এ সমস্যাটা বেশি দেখা দেয়।

এছাড়া বিভিন্ন ফোরামে দেশের চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য খাতকে আরো সমৃদ্ধ করতে গবেষণার বিষয়ে সহযোগিতা চান প্রধানমন্ত্রী। ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুর দিকে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের (ডব্লিউএইচএফ) প্রেসিডেন্ট ডা. জগৎ নরুলা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে চিকিৎসাবিজ্ঞান নিয়ে মৌলিক গবেষণা এবং দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে সহযোগিতা চেয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

চিকিৎসাবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী ভোরের কাগজকে বলেন, চিকিৎসকদের মধ্যে যারা শিক্ষক-গবেষক হতে চায়, তারা যতদিন পর্যন্ত যথাযথ প্রণোদনাসহ নন-প্র্যাকটিসিং বা ইনস্টিটিউশনাল প্র্যাকটিসের মাধ্যমে শিক্ষা এবং গবেষণায় পূর্ণ মনোনিবেশ না করবে ততদিন পর্যন্ত চিকিৎসা বা স্বাস্থ্য গবেষণায় আশানুরূপ ফল পাওয়া যাবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ অবশ্য মনে করেন পর্যাপ্ত ফান্ডের অভাব গবেষণায় পিছিয়ে থাকার বড় কারণ নয়। মূল সমস্যা হলো মেডিকেল প্রফেশনালদের মধ্যে গবেষণার সংস্কৃতি বিকশিত না হওয়া।

তিনি ভোরের কাগজকে বলেন, সামগ্রিকভাবে মেডিকেলবিষয়ক গবেষণার ক্ষেত্রে দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া চিকিৎসকদের মধ্যে গবেষণার প্রতি আগ্রহ কম। যেহেতু একাডেমিক গবেষণার উৎকর্ষ পরিমাপের সবচেয়ে উত্তম মাপকাঠি হলো দেশি-বিদেশি স্বীকৃত জার্নালে প্রকাশনা থাকা। তাই প্রকাশনাকেই একাডেমিক গবেষণার চূড়ান্ত প্রতিবেদন হিসেবে গণ্য করতে হবে। তবে জার্নাল প্রকাশনা যেহেতু সময়সাপেক্ষ এবং নানারকম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যেতে হয়, তাই ফান্ড দেয়ার প্রক্রিয়াকে দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে- গবেষণার উপকরণ খরচ এবং প্রকাশনার জন্য প্রণোদনা।

তিনি আরো বলেন, দেশে এখন অজস্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান বা কনসালটিং ফার্ম রয়েছে। কিন্তু এগুলোর বেশির ভাগই নামসর্বস্ব, যাদের কোনো স্থায়ী জনবল নেই। এগুলো মূলত ভাড়া করা পরামর্শকদের ওপর নির্ভর করে। টিকে থাকার জন্য নানারকম দুর্নীতির আশ্রয় নিচ্ছে। এতে নামসর্বস্ব গবেষণা হচ্ছে। যার অধিকাংশই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায়। পলিসি ডকুমেন্ট তৈরি না করেও গবেষণাকর্ম সম্পাদনের নজিরও আমাদের দেশে আছে। গবেষণা ফান্ড ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম সঠিকভাবে সম্পাদন, গবেষণাকর্মের বিভিন্ন ধাপ দেখভাল এবং মূল্যায়নের জন্য একটি শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান থাকা জরুরি বলে মনে করেন তিনি। বিএমআরসি এক্ষেত্রে এগিয়ে থাকলেও নিজস্ব জনবলকাঠামোর যথেষ্ট অভাব রয়েছে। সক্রিয়তা ও গতিশীলতার অভাব তো আছেই। পরবর্তী ধাপে থাকা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটেও সক্ষমতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএমআরসির এক কর্মকর্তা ভোরের কাগজকে বলেন, অনেক প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি গবেষণায় আগ্রহী হলেও অনেক সময় সেই কাজটা আগায় না। গ্লোব বায়োটেক করোনা টিকা তৈরি কাজ শুরুর বিষয়টিই দেখুন না। সরকারের ধীরগতির কারণে এই কাজটি মুখ থুবড়ে পড়েছে। অথচ দেশের ক্রান্তিকালে একটা প্রতিষ্ঠান সাহস করে এগিয়ে এসেছিল। দেশে বর্তমানে ৩৭টি সরকারি ও ৭১টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ রয়েছে। এর মধ্যে শুধু বিএসএমএমইউ ছাড়া কোনো মেডিকেল কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা হচ্ছে না। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অবকাঠামো উন্নয়ন, জনবল নিয়োগ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। ফলে গবেষণা কার্যক্রমে তেমন ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর মধ্যেও কিছু মেডিকেল কলেজের শিক্ষক-চিকিৎসক কাজ করলেও নানা কারণে তা সহজে আলোর মুখ দেখছে না।

বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ এন্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. রোমেন রায়হান মনে করেন চিকিৎসা গবেষণায় অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে চিকিৎসকদের গবেষণামুখী করা।

তিনি বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত হলেও প্রতি বছরই সরকারি খাতে গবেষণার জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়ছে। গবেষণা খাতে বরাদ্দ অর্থের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের উচিত বাংলাদেশের জন্য কোন কোন গবেষণা বর্তমানে এবং নিকট ভবিষ্যতের জন্য জরুরি, সেই খাতগুলো চিহ্নিত করা এবং চিকিৎসা গবেষণা খাতের সিংহভাগ অর্থ সেইসব গবেষণার জন্য বরাদ্দ রাখা। এখনো চিকিৎসকরা গবেষণা করেন মূলত তাদের পদোন্নতির উদ্দেশ্য সামনে রেখে, যা পর্যাপ্তসংখ্যক রিসার্চ আর্টিকেল ছাপার পরই থেমে যায়। চিকিৎসা গবেষণা নিয়ে পিছিয়ে পড়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে গবেষকদের করা গবেষণার ফলাফল স্বাস্থ্যনীতিতে প্রতিফলিত না হওয়া। এক্ষেত্রে দায় মূলত গবেষকদের। তারা আন্তর্জাতিক জার্নালে তাদের গবেষণার ফল প্রকাশ করেই দায় শেষ করেন। যার তথ্য সাধারণ জনগণ বা নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছায় না বললেই চলে। গবেষকদের উচিত সংবাদমাধ্যমকে সঙ্গে নিয়ে তাদের গবেষণাপ্রাপ্ত জ্ঞান সাধারণ জনগণ ও নীতিনির্ধারকদের জানানো।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App