বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের দাম বছরের সর্বনিম্ন অবস্থানে

কাগজ প্রতিবেদক
প্রকাশ: ৩০ নভেম্বর ২০২২, ০৯:০৯ এএম

ফাইল ছবি
অর্থনীতির বৈশ্বিক মন্দার সময়েও অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দামে বড় দরপতন হয়েছে। গত দুই সপ্তাহ ধরে টানা কমে নেমে প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত তেল ৭৫ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম নেমে এসেছে ৮১ ডলারে। যা চলতি ২০২২ সালের মধ্যে সবচেয়ে কম।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানিয়েছে, গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল ডব্লিউটিআই অপরিশোধিত তেল ৭৪ ডলার ৯২ সেন্টে বিক্রি হয়েছে। ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেল বিক্রি হয়েছে ৮১ ডলার ৮১ সেন্টে। দুই সপ্তাহ আগে ব্রেন্ট ক্রুডের দাম ৯০ ডলারের বেশি ছিল। ডব্লিউটিআই ক্রুডের দাম ছিল ৮৫ ডলারের বেশি।
গত বছরের ২২ ডিসেম্বর ইউএস ওয়েস্ট টেক্সাস ইন্টারমিডিয়েট (ডব্লিউটিআই) অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৭৫ ডলার ৬০ ডলার। আর চলতি বছরের ৪ জানুয়ারি ব্রেন্ট অপরিশোধিত তেলের দাম ছিল ৮০ ডলার ৯৬ সেন্ট। বিশ্বের বৃহত্তম অপরিশোধিত তেল আমদানিকারক দেশ চীনে করোনার কঠোর নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে রাস্তায় বিক্ষোভের কারণে গত সোমবার তেলের দাম বছরের সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে এসেছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স। চীনে জ্বালানির চাহিদা কমে যেতে পারে এ আশঙ্কায় তেলের দাম কমছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
মূলত বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কায় জ্বালানি তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ চীনের বিভিন্ন শহরে এখনো লকডাউন চলছে। কোথাও কোথাও লকডাউনবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। কিন্তু সরকার অনড়। সে কারণে দেশটিতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড স্থিমিত হয়ে পড়েছে। বিশ্বব্যাংক-আইএমএফসহ বিভিন্ন সংস্থা বলছে চীনে জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবার বেশ খানিকটা কমবে। অন্যদিকে আমেরিকান মুদ্রা ডলার দুই দশকেরও বেশি সময়ের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে পৌঁছেছে। ক্রমবর্ধমান সুদের হার বড় অর্থনীতিকে মন্দার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। এ আশঙ্কায় তেলের দাম কমছে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বড় বড় দেশ ঋণের সুদের হার বাড়িয়েই চলেছে। অন্য বড় অর্থনীতির দেশগুলোও সেই একই পথ অনুসরণ করছে। আর এটিই বিশ্ব অর্থনীতিকে মন্দার দিকে ঠেলে দিচ্ছে বলে জানিয়েছে রয়টার্স।
গত ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরতে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার বাড়াচ্ছে। এর জেরেই বিশ্ব অর্থনীতি মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ‘বিশ্বে কী মন্দা আসন্ন’ শীর্ষক ওই গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, করোনা মহামারির ধকল কাটতে না কাটতেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় সংকটে বিশ্ব অর্থনীতি। দিন দিন বাড়ছে মূল্যস্ফীতি। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো নীতি সুদহার একযোগে বাড়িয়েই চলেছে। এর জেরে বিশ্ব অর্থনীতি ২০২৩ সালে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
এছাড়া চীনের বড় বড় শহরে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে এখনো লকডাউন শুরু হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চাহিদা কমায় জ্বালানি তেলের দাম কমেছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থাটি। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূলত দুটি কারণে তেলের দাম নিম্নমুখী হয়েছে। প্রথমত, বিশ্ব অর্থনীতির অবস্থা মোটেও ভালো নয়। উন্নত দেশগুলোতে মন্দার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। এতে স্বাভাবিকভাবেই তেলের চাহিদা কমছে। দ্বিতীয়ত, ডলারের ঊর্ধ্বমুখী দর।
ডলার প্রাইস ইনডেক্সের তথ্যানুসারে, চলতি বছর ডলারের দর ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ডলারের দর বাড়লে আমদানি মূল্য বেড়ে যায়, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর বড় ধরনের চাপ তৈরি করে। সে জন্য ডলারের দর বাড়লে উন্নয়নশীল দেশগুলো জ্বালানি তেল আমদানি হ্রাস করে, বাংলাদেশও যা করেছে। ডলার বাঁচাতে দেশে তেলভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম না কমলে বিদ্যুৎ উৎপাদন হ্রাস করা হবে। বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম গড়ে প্রতি ব্যারেল ১০০ ডলারের কাছাকাছি ওঠানামা করছিল, ঠিক তখন বাংলাদেশে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম একলাফে ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৫১ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়।
গত ৫ আগস্ট রাতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হয়, ডিজেল ও কেরোসিনের প্রতি লিটারের দাম ৩৪ টাকা বাড়িয়ে ১১৪ টাকা, পেট্রল ৪৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩০ টাকা আর অকটেন ৪৬ টাকা বাড়িয়ে ১৩৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। ওই দিন মধ্যরাত থেকে নতুন দর কার্যকর করা হয়। এরপর থেকেই বাস, ট্রাক, অ্যাপের প্রাইভেটকার, মোটরসাইকেল, লঞ্চ ও হিউম্যান হলারের ভাড়া বেড়ে যায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম আগে থেকেই বাড়তি ছিল, জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে তা আরো এক দফা বাড়ে।
এদিকে মন্দাভাবের কারণে বিশ্ববাজারে দাম কমার ধারা কত দিন অব্যাহত থাকবে, তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ আছে।
বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, দাম কমতে থাকলে ওপেক তেল উত্তোলন আরো হ্রাস করবে। এতে দাম খুব একটা নাও কমতে পারে। ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে শুরু করে। করোনা মহামারির মধ্যেও টানা বেড়েছে তেলের দাম। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় তা আরও ঊর্ধ্বমুখী হয়। গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে দুই ধরনের তেলের দামই ৮০ ডলার ছাড়িয়ে যায়। রাশিয়া গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে হামলা করলে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তেলের দাম। একপর্যায়ে প্রতি ব্যারেল ১৩৯ ডলারে গিয়ে ঠেকেছিল। এরপর থেকে বিভিন্ন উদ্যোগে ওঠানামার মধ্যেই তেলের দর ১১০ থেকে ১১৫ ডলারের মধ্যে ছিল। গত মে মাসের শেষের দিকে তেলের দাম বেড়ে ১২০ ডলার ছাড়িয়ে যায়।