×

জাতীয়

জলাধারে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে

Icon

কাগজ প্রতিবেদক

প্রকাশ: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০৮:৪০ এএম

জলাধারে ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ নিয়ে বিতর্ক তুঙ্গে

ছবি: ভোরের কাগজ

   

রাজধানীর কুড়িলে ‘জলাধার’ ভরাট করে একটি ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণ নিয়ে শুরু হয়েছে নানা আলোচনা-সমালোচনা। রেল মন্ত্রণালয় জায়গাটি লিজ দেয় মিলেনিয়াম হোল্ডিং কোম্পানিকে। হোটেল কর্তৃপক্ষ সেখানে কাজ শুরু করেছে। টানানো হয়েছে বড় একটি বিলবোর্ড। চলছিল মাটি ভরাটের কাজ। জায়গাটি জলাধার উল্লেখ করে সেখানে হোটেল নির্মাণ থেকে বিরত থাকার দাবি জানান স্থানীয় বাসিন্দারা। সামাজিক মাধ্যমে প্রতিবাদসহ মানববন্ধনও করেন তারা। বিষয়টি ঢাকা উত্তরের মেয়রের নজরে আসায় গত ২৭ জানুয়ারি জায়গাটি উদ্ধারে অভিযান চালান তিনি। তার দাবি, এটি একটি জলাধার- যা নিকুঞ্জের মানুষকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করে আসছে। এখানে হোটেল হলে বর্ষার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকবে না। তাই নগরবাসীর স্বার্থে এখানে হোটেল করতে দেয়া হবে না। রেলওয়ে এখানে হোটেল নির্মাণের অনুমতি দিয়ে ঠিক করেনি। তিনি চান এখানে খেলার মাঠ হবে, খোলামেলা থাকবে জায়গাটি। আর রেলওয়ে বলছে, সবকিছু যাছাই করে, নিয়ম মেনেই ফাইভ স্টার হোটেল করার অনুমতি দেয়া হয়েছে। নগরবিদরাও বলছেন, জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ। এটি খোলামেলা থাকাই উচিত। এখানে হোটেল করতে দেয়া ঠিক হবে না। মিলেনিয়াম কোম্পানিকে অন্য কোথাও জায়গা দেয়ার পরামর্শ তাদের।

যেভাবে ফাইভ স্টার হোটেলের অনুমোদন দিল রেল মন্ত্রণালয় : রেলওয়ে মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ঢাকায় হোটেল হিলটন নামে একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের জন্য মিলেনিয়াম হোল্ডিং লিমিটেড কোম্পানি ২০০৬ সালের ১৩ এপ্রিল রেলের জমি বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করে। বড় মগবাজারে ৪ দশমিক ১৬ একর রেলের জমি হোটেলের জন্য ৬০ বছর মেয়াদে লিজ বরাদ্দ দেয় মন্ত্রণালয়। যার চুক্তি স্বাক্ষর ও রেজিস্ট্রিও হয়। কিন্তু হাতিরঝিল প্রকল্প নেয়ায় ২০০৭ সালে রেলওয়ের ওই বরাদ্দ আদেশ বাতিল করে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার। অবশ্য হাজী ক্যাম্পের পাশেই তাদের ৫ একর জমি বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু মিলেনিয়াম হোল্ডিং তাতে আপত্তি জানায়। তারা মূল বরাদ্দকৃত জায়গা অথবা ডাউন টাউন এলাকায় জমি বরাদ্দের অনুরোধ জানায়। এরপর ঢাকা জেলা জজ আদালতে রেলওয়ে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আরবিট্রেশন মামলা দায়ের করে মিলিনিয়াম কর্তৃপক্ষ। ১০ একর রেলের জমি অথবা ১ হাজার ৩৫৪ কোটি ৯৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৯৩ টাকা ক্ষতিপূরণ দাবি করে তারা। সেই সঙ্গে ১৫ ভাগ সুদ। আরবিট্রেশন ট্রাইব্যুনাল ২০১১ সালের ১৭ জুলাই মিলেনিয়াম কোম্পানির অনুকূলে একটি এওয়ার্ড দেন। এতে দক্ষিণখান মৌজায় রেলওয়ের ৮ দশমিক ৭৫ একর জমি ৬ মাসের মধ্যে কোম্পানিকে হস্তান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেই জমির মালিকানা নিয়ে বিরোধ থাকায় তা মিলেনিয়াম কোম্পানিকে বরাদ্দ দেয়া হয়নি। পরবর্তীতে কোম্পানি কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ৫ দশমিক শূন্য ৯ একর জমি বরাদ্দ চেয়ে পুনরায় আবেদন করে। কিন্তু ডুয়েলগেজ লাইন নির্মাণসহ ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কারণে সে জমি বরাদ্দ দেয়া হয়নি। ২০১৭ সালে তৎকালীন রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক ফাইভ স্টার হোটেলের জন্য কুড়িল এলাকায় ১ দশমিক ৮৪ একর রেলের এই জমিটি দীর্ঘমেয়াদি লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন। আদালতের আদেশের আলোকে ২০১৮ সালে রেলমন্ত্রী তা অনুমোদন দেন। জুড়ে দেয়া হয় কিছু শর্ত। এরপর দেয়া হয় জমির লাইন্সেস। মিলেনিয়াম কোম্পানি তাদের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করে।

হোটেল নির্মাণ না করতে দেয়ায় অনড় ডিএনসিসি : গত ২৭ জানুয়ারি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণের জন্য বিলবোর্ড টানিয়ে গড়ে ওঠা স্থাপনা মেয়রের উপস্থিতিতে গুঁড়িয়ে দেন স্থানীয়রা। এ সময় হোটেল নির্মাণের বিরোধিতা করে মানববন্ধন করেন তারা। এ সময় ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেছিলেন, কুড়িল বিশ্বরোডের পাশের এই জলাধার যুগ যুগ ধরে নিকুঞ্জের মানুষকে জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা করে আসছে, এটি ভরাট হলে নিকুঞ্জসহ এয়ারপোর্ট রোডে বর্ষার পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ রয়েছে নগরীর কোনো জলাধার ভরাট করে স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না। তিনি অভিযোগ করেন, জলাধারের জায়গা সরজমিন পরিদর্শন না করেই রেলওয়ে বরাদ্দ দিয়েছে। ১ দশমিক ৮৪ একরের এই জলাধার রক্ষায় প্রয়োজনে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলেন তিনি। সে সময় সমস্যার সম্ভাব্য প্রতিকার নিয়ে রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজনের সঙ্গেও মুঠোফোনে কথা বলেন। এরপর মেয়র নিজের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজে একটি স্ট্যাটাস দিয়ে লিখেন, জনৈক সম্মানিত নাগরিক ফেসবুক গ্রুপে উদ্বেগ জানিয়েছেন কুড়িল ফ্লাইওভার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাঝখানে বাণিজ্যিক ভবন নির্মিত হতে যাচ্ছে। বিষয়টি ডিএনসিসি কর্তৃপক্ষের নজরে আসে এবং সঙ্গে সঙ্গে সেখানে অভিযান চালানো হয়। ওই স্থানে পর্যাপ্ত ড্রেনেজ ব্যবস্থা, জলাধার, পার্ক এবং পাবলিক স্পেস নির্মাণের পরিকল্পনা আছে ডিএনসিসির।

অনুমোদন নেয়া হয়নি রাজউকের : এদিকে মিলেনিয়াম হোল্ডিং লিমিটেড হোটেল নির্মাণে প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করে। হোটেলের সাইনবোর্ডও টানিয়েছে তারা। নির্মাণ করেছে অস্থায়ী অফিস। কিন্তু রাজউক থেকে কোনো অনুমোদন নেয়নি কোম্পানিটি। এ বিষয়ে রাজউক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নূরী বলেন, হোটেল নির্মাণের জন্য কোনো নকশার অনুমোদন দেয়া হয়নি। তিনি বলেন, জায়গাটি যোগাযোগের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রেল কেন হোটেল নির্মাণের অনুমতি দিল, সেটা তারাই ভালো বলতে পারবে। তবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র এ বিষয়ে যে অবস্থান নিয়েছেন, তার যৌক্তিকতা আছে। এটা জলাভূমি না হলেও এর উপর দিয়ে কুড়িল ফ্লাইওভার গেছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হচ্ছে। মেট্রোরেল হবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন সম্প্রসারণ হবে। কাজেই এই জায়গাটা ফাইভ স্টার হোটেলের জন্য উপযোগী নয়। এটা জলাশয় হোক বা জলাবদ্ধতা হোক- যোগাযোগের জন্য জায়গাটা সব সময় খোলামেলা রাখা দরকার।

মিলেনিয়াম হোল্ডিংস লিমিটেডের বক্তব্য : এ বিষয়ে মিলেনিয়াম হোল্ডিংস কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদে ন্যাম সম্মেলনের কথা বিবেচনায় রেখে ‘হিলটন ঢাকা’ নামে একটি ফাইভ স্টার হোটেল নির্মাণের পরিকল্পনা করে মিলেনিয়াম হোল্ডিংস লিমিটেড। ২০০১ সালে ন্যাম সম্মেলন বাতিল হয়। ২০০৬ সালে হিলটন ইন্টারন্যাশনাল ইউএসের সঙ্গে ৬০ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে কোম্পানিটি। চুক্তি অনুযায়ী, মেয়াদকাল শেষ হলে সম্পূর্ণ হোটেল প্রকল্পটি বিনামূল্যে বাংলাদেশ রেলওয়ের হবে। কুড়িল মৌজায়, রেলের অব্যবহৃত ৫ দশমিক ৪৫ একর একটি জমি বিকল্প বরাদ্দ চেয়ে মিলেনিয়াম হোল্ডিংস তৎকালীন রেলমন্ত্রীর কাছে আবেদন করে। সেখানে রেলওয়ের আন্তর্জাতিক মানের হোটেল করার পরিকল্পনা ছিল। সব যাছাই-বাছাই শেষে জমিটি পায় মিলেনিয়াম হোল্ডিংস। জমিটির চতুর্দিকে আবদ্ধ। এটি কোনো প্রাকৃতিক জলাধার নয়। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন ২০০০ অনুযায়ী এটি জলাধার নয়। জমিটি পতিত জমি। রাজউকের ওয়েবসাইটে এটি ড্যাপের আর্বান প্রকল্প। জমিটি বৈধ ও প্রকল্পের জন্য উপযুক্ত। এটি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লা ফেলার স্থান ছিল। মিলেনিয়াম হোল্ডিংস জায়গাটি পরিষ্কার করে। সাইট অফিস ও প্রকল্প পরিচিতির সাইনবোর্ড স্থাপন করে।

মিলেনিয়াম হোল্ডিং লিমিটেডের সিইও মো. ইকবাল ভোরের কাগজকে বলেন, রেলওয়ের সমস্ত শর্ত পূরণ করে প্রতি বছর ৬৩ লাখ টাকা হিসাবে শুরুতেই ৫ বছরের ফি আমরা দিয়েছি। এখন তো তা অনেক বেড়ে গেছে। এই জায়গাটি যাছাই-বাছাই করে আমাদের দেয়া হয়েছে। মেগা প্রকল্প যেগুলো নেয়া হচ্ছে, সেগুলোর ক্ষেত্রে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা সেভাবেই সেখানে স্থাপনা করছি। সুতরাং আমরা কোনো অন্যায় বা অনৈতিক কিছু করছি না।

কী আছে পরিবেশ আইনে : বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ এর (১)আইন ধারায় আছে কোনো ধরনের জলাশয় সম্পর্কিত বাধা-নিষেধ, বলবৎ বা অন্য কোনো আইনে যাহা কিছু থাকুক না কেন, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গা ভরাট বা অন্য কোনোভাবে শ্রেণি পরিবর্তন করা যাবে না। তবে শর্ত থাকে, অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থে অধিদপ্তরের ছাড়পত্র গ্রহণক্রমে জলাধার সম্পর্কিত বিধিনিষেধ শিথিল করা যাবে।

নগরবিদরা যা বলছেন : নগরবিদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, জোয়ার সাহারার এই জায়গাটি গুরুত্বপূর্ণ ইন্টারজাংশন। এটি একটি ডোবা। এখানে ইন্টারন্যাশনাল হোটেল হওয়া উচিত নয়। কারণ খিলক্ষেত ও নিকুঞ্জ এলাকার পানি এই পথ দিয়ে বের হয়ে তিনশ ফুট সড়কের পাশে যে নতুন ক্যানেল খোড়া হয়েছে, সেদিক দিয়ে প্রবাহিত হয়। তাই আমি মনে করি এটা জলাভূমি হিসেবে থাকা ভালো। এটি একটি ড্রেনেজ চ্যানেল। কাজেই সেটি উন্মুক্ত থাকাই ভালো। তিনি আরো বলেন, রেলের প্রচুর অব্যবহৃত জমি আছে। মিলেনিয়াম হোল্ডিংস লিমিটেডকে তারা অন্য একটি ভালো জায়গা দিলে, এই পরিস্থিতি হতো না।

নগরবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, আমি মনে করি এখানে পরিবেশ ও জলাধার সংরক্ষণ আইনের লঙ্ঘন হয়েছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছে। রেল মন্ত্রণালয় তাদের ভুল স্বীকার করে এখান থেকে সরে যাওয়া উচিত। আর মিলেনিয়াম হোল্ডিং লিমিটেডকে রেল মন্ত্রণালয় অন্য কোথাও জায়গা দিতে পারত। কারণ তাদের অনেক জমি আছে। তবে এখন যে সমস্যা তৈরি হয়েছে, তা সমাধান করতে সিটি করপোরেশন ও রাজউকের সঙ্গে রেল কর্তৃপক্ষের বসা উচিত। এর মধ্য দিয়ে একটা সমাধান বের হয়ে আসবে।

সাবস্ক্রাইব ও অনুসরণ করুন

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সহজ ও গতিশীল করার সুপারিশ

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি ছানোয়ারসহ ৩ নেতা রিমান্ডে

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

অপারেশন ডেভিল হান্ট : সারাদেশে আরো ৫২৯ জন গ্রেপ্তার

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

হত্যা মামলায় মেনন, ইনু,ফারজানা ও শাকিল রিমান্ডে

সব খবর

সম্পাদক : শ্যামল দত্ত

প্রকাশক : সাবের হোসেন চৌধুরী

অনুসরণ করুন

BK Family App