বাংলাদেশ টেলিভিশনের সংস্কার: মান ও আয় বাড়ানো এখন গুরুত্বপূর্ণ

জাহিদ হোসাইন খান
প্রকাশ: ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০৮:৪৬ পিএম

জাহিদ হোসাইন খান, এমফিল গবেষক, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি), এশিয়ার অন্যতম প্রাচীন টেলিভিশন স্টেশন। ১৯৬৪ সাল থেকে বিটিভি বাংলাদেশের কোটি কোটি জনগণের সংবাদ ও বিনোদনের অনন্য এক উৎস। ২০০০ সালের আগ পর্যন্ত বিটিভি একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল হিসেবে জনপ্রিয়তা ধরে রেখেছিল। বাংলাদেশ টেলিভিশন দেশের আধুনিক সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম। কিন্তু প্রযুক্তির অগ্রগতি এবং প্রতিযোগিতার বাজারে টিকে থাকতে হলে বিটিভিকে তার আর্থিক অবস্থার উন্নয়ন ও মানোন্নয়নে মনোযোগী হতে হবে।
অনুষ্ঠানের মান বাড়ানো এখন গুরুত্বপূর্ণ
টেলিভিশনের কাজ সংবাদ ও অনুষ্ঠান নিয়ে। সংবাদ ও অনুষ্ঠানের মান উন্নয়ন বেশি গুরুত্বপূর্ণ। বিটিভির অনুষ্ঠান নির্মাতাদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণের আয়োজন করা জরুরি। আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠান নির্মাণের জন্য বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় গণমাধ্যম যেমন বিবিসি, সিএনএন, আল-জাজিরা ইত্যাদি থেকে অভিজ্ঞ প্রশিক্ষক আনার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযোজক, পরিচালক, স্ক্রিপ্টরাইটারসহ অনুষ্ঠান নির্মাণে জড়িত সবাইকে টেলিভিশন অনুষ্ঠান প্রযোজনার সর্বশেষ কৌশল ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞান প্রদান করা যাবে। এর ফলে অনুষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়ন হবে এবং দর্শকদের কাছে আরও বেশি জনপ্রিয় হবে।
বিটিভির দর্শকদের আন্তর্জাতিক মানের অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ দেওয়া প্রয়োজন। বিদেশি জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো বাংলা ভাষায় ডাবিং করে প্রচারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এতে দর্শকদের রুচির বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পাবে এবং বিটিভি বিদেশি অনুষ্ঠান প্রচারের মাধ্যমে বিজ্ঞাপন থেকে বাড়তি আয় করতে সক্ষম হবে। যেমন, দক্ষিণ কোরিয়ার ড্রামা বা আমেরিকার জনপ্রিয় শো বিভিন্ন দেশে ডাবিংয়ের মাধ্যমে সফলভাবে প্রচারিত হয়েছে। বিটিভির দর্শকদের চাহিদা এবং বর্তমান টেলিভিশন ট্রেন্ডের ওপর ভিত্তি করে একটি গবেষণা সেল তৈরি করতে হবে। এই সেলটি নিয়মিতভাবে দর্শকদের পছন্দ, সামাজিক ট্রেন্ড এবং প্রতিযোগী চ্যানেলগুলোর অনুষ্ঠানমালা পর্যবেক্ষণ করবে। গবেষণার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে নতুন অনুষ্ঠান তৈরির কৌশল প্রণয়ন করা হবে। উদাহরণস্বরূপ, নেটফ্লিক্স এবং অ্যামাজন প্রাইমের মতো প্ল্যাটফর্মগুলো গবেষণার ভিত্তিতে কনটেন্ট তৈরি করে তাদের দর্শকদের সন্তুষ্ট করছে।
বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলোতে দেশীয় সংস্কৃতিকে আরও বেশি যুক্ত করা যেতে পারে। যেমন, নাটক, সঙ্গীত বা টক শোতে দেশের বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব এবং বিভিন্ন খাতের বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এতে অনুষ্ঠানগুলো আরও বেশি গভীরতা পাবে এবং দর্শকরা বিনোদনের পাশাপাশি শিক্ষণীয় বিষয়গুলো সম্পর্কে জানতে পারবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতের জনপ্রিয় অনুষ্ঠান ‘কৌন বানেগা ক্রোড়পতি’তে শিক্ষামূলক এবং বিনোদনমূলক বিষয়গুলো মিশ্রিত থাকে, যা বিটিভি অনুকরণ করতে পারে। অনুকরণ না করলেও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান ফ্র্যাঞ্চাইজি গ্রহণ করে প্রচার করা যেতে পারে।
বিটিভির সংবাদ সম্প্রচার আরও মানসম্মত এবং পেশাদার করতে সাংবাদিকদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা দরকার। আন্তর্জাতিক প্রশিক্ষকদের সহায়তায় নিউজ প্রোডাকশন, ফিল্ড রিপোর্টিং এবং নিউজ উপস্থাপনা বিষয়ে সাংবাদিকদের আধুনিক কৌশল শেখানো হবে। এতে সংবাদগুলোর বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়বে এবং দর্শকদের আকর্ষণ আরও বৃদ্ধি পাবে। বিশ্বের অনেক বড় গণমাধ্যম যেমন বিবিসি এবং সিএনএন নিয়মিতভাবে তাদের সাংবাদিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। বিটিভির জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য বড় ধরনের রিয়েলিটি শো এবং অনুষ্ঠান আয়োজনের দিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। যেমন, সঙ্গীত প্রতিযোগিতা, কৌতুক প্রতিযোগিতা, নাচের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি রিয়েলিটি শো আয়োজন করা যেতে পারে। এই ধরনের অনুষ্ঠানগুলো বিভিন্ন স্পন্সরশিপ এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহী করতে সক্ষম হবে, যা বিটিভির আয়ের পথ খুলে দেবে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ যেমন ভারত, পাকিস্তান সফলভাবে এই ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে থাকে এবং বিশাল অংকের রাজস্ব আয় করে।
বিটিভির আয়ের বর্তমান অবস্থা
২০১৬ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ২০১০-১১ অর্থবছরে বিটিভির বিজ্ঞাপন থেকে আয় ছিল ১১৭ কোটি টাকা, যা কমে ২০১৪-১৫ সালে ৫২ কোটি টাকায় নেমে আসে। ২০১০-১১ অর্থবছরে লোকসান ছিল ৪৩ কোটি টাকা, যা ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বেড়ে ১০১ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২০-২১ সালে বিটিভির আয় হয় মাত্র ৩৪ কোটি টাকা, ব্যয় হয় ২৮০ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ সালে আয়ের পরিমাণ ছিল ২৯ কোটি টাকা, ব্যয় ২৬০ কোটি টাকা। আয় বাড়ানোর জন্য বিটিভির বিভিন্ন সুযোগ থাকলেও তা সঠিকভাবে কাজে লাগানো হয়নি।
আয়ের উৎস বাড়ানোর সুযোগ
বিটিভির আয়ের পথ উন্মুক্ত করতে হলে সৃজনশীলতা, প্রযুক্তির ব্যবহার এবং বাজার বিশ্লেষণের ওপর জোর দিতে হবে। বিটিভির প্রযোজক ও নির্মাতাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে উন্নতমানের অনুষ্ঠান নির্মাণে সহায়তা করতে হবে। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের প্রশিক্ষকদের যুক্ত করা যেতে পারে। বাংলা ভাষায় ডাবিং করে আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠান প্রচারের সুযোগ দিতে হবে। দর্শকদের চাহিদার ওপর ভিত্তি করে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা এবং বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানগুলোতে বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের যুক্ত করতে হবে। উন্নতমানের অনুষ্ঠানগুলো দর্শকদের আকর্ষণ করবে, যা বিজ্ঞাপনদাতাদের আগ্রহ বাড়াবে। ভারতের দূরদর্শন এর উদাহরণ, যারা মানোন্নয়ন করে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে রাজস্ব বাড়িয়েছে।
বিটিভির অভিজ্ঞ কর্মীবাহিনী ব্যবহার করে টেলিভিশন প্রযোজনা বিষয়ক টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণ দেওয়া যেতে পারে, যা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন সংগ্রহের মাধ্যমে আয় বাড়াবে। জাপানের এনএইচকে এই মডেল অনুসরণ করে সফলতা পেয়েছে। বিটিভির স্টুডিওগুলো বিভিন্ন সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে শুটিংয়ের জন্য ভাড়া দেওয়া যেতে পারে, যা আয় বাড়ানোর একটি কার্যকর উপায়।
বিটিভির জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো ওটিটি প্ল্যাটফর্মে প্রচার করে ডিজিটাল সাবস্ক্রিপশন এবং ভিউ-ভিত্তিক আয়ের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব। বিটিভির আর্কাইভে অনেক মূল্যবান ফুটেজ রয়েছে, যা গবেষক ও নির্মাতাদের নির্ধারিত ফিয়ের বিনিময়ে ব্যবহারের সুযোগ দিয়ে আয় বাড়ানো সম্ভব। বিভিন্ন রিয়েলিটি শো বা ধারাবাহিক অনুষ্ঠানের জন্য স্পন্সরশিপ গ্রহণ করে আয় বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
বিটিভির প্রজন্মের প্রধানতম বিনোদনের উৎস ছিল একসময়। বর্তমান প্রযুক্তি ও প্রতিযোগিতার যুগে টিকে থাকতে হলে বিটিভিকে তার ঐতিহ্য রক্ষা করে যুগোপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে।
লেখক: জাহিদ হোসাইন খান, এমফিল গবেষক, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ই–মেইল: zahid.pen@protonmail.com